রফিক মুহাম্মদ : সারাদেশে এবারই প্রথম দলীয় প্রতীকে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন হয়েছে। এতে গ্রামে গঞ্জে সর্বত্র প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল তাদের প্রতীক নিয়ে ভোটের মাঠে লড়াই করেছে। মোট ৪ হাজার ১শ’ ৪টি ইউনিয়ন পরিষদের মধ্যে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীরা ২৬৫৪টি ইউনিয়নে এবং ধানের শীষের প্রার্থীরা মাত্র ৩৬৭ ইউনিয়ন পরিষদে জয় লাভ করেছে। এ তথ্য অনুযায়ী আওয়ামী লীগের (নৌকা মার্কার) বিপুল বিজয় হয়েছে। আর বিএনপির (ধানের শীষের) বলা যায় একেবারে ভরাডুবি হয়েছে।
তবে এ নির্বাচন নিয়ে বিশ্লেষকদের রয়েছে একে বারেই ভিন্ন মত। এ বারের নির্বাচনে যে অনিয়ম কারচুপি এবং সহিংসতা হয়েছে তাতে আপাতত দৃষ্টিতে আওয়ামী লীগে বিপুল বিজয় পেলেও রাজনৈতিকভাবে তাদের পরাজয় হয়েছে এমনটাই মনে করেন নির্বাচন বিশ্লেষকরা। ৬ ধাপের নির্বাচনের সহিংসতায় সারাদেশে ১৩৫ জন নিহত হয়েছেন। আর আহত হয়েছেন সহ¯্রাধিক মানুষ। ব্যাপক সহিংসতার এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ইমেজ অনেকটাই ক্ষুন্ন হয়েছে। অন্যদিকে বিএনপি এ নির্বাচনে তাদের ভরাডুবি নয় রাজনৈতিক বিজয় হয়েছে বলেই মনে করছে। নির্বাচন বিশ্লেষক সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার এ নির্বাচনকে ইতিহাসের সবচে খারাপ এবং রক্তঝরা নির্বাচন বলে অখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেছেন, এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের আপাত দৃষ্টিতে বিপুল বিজয় হলেও রাজনৈতিকভাবে তাদের পরাজয় হয়েছে।
এ বিষয়ে বিএনপির সিনিয়র যুগ্মমহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী বলেন, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের প্রকৃত চেহারা জনগণের সামনে উন্মোচিত হয়েছে। এত রক্তপাত, জালজালিয়াতির ভোট আওয়ামী লীগের দ্বারাই সম্ভব এটা প্রমাণ হয়েছে। তিনি বলেন, বিএনপিসহ ২০দলীয় জোট নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে যে আন্দোলন করছে তার যথার্থতা দেশবাসী এবং বিশ্ববাসীর কাছে প্রমানিত হয়েছে। আওয়ামী লীগের অধীনে নিরপেক্ষ সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় এটা এখন প্রমানিত। নির্বাচন বিশ্লেষকরাও মনে করেন বিএনপি পরাজিত হলেও তারা রাজনৈতিকভাবে লাভবান হয়েছে। নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিএনপি প্রমাণ করতে পেরেছে এ সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। এটা অবশ্যই তাদের এক ধরনের বিজয়। তবে এ নির্বাচনে বিএনপি সাংগঠনিকভাবে ক্ষতি গ্রস্থ হয়েছে। নির্বাচন বিশ্লেষক ড. তোফায়েল আহমদ বলেন, প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে নানা অনিয়মের কারণে বিএনপি সাংগঠনিকভাবে আরও বিপর্যস্ত হয়েছে।
বিএনপি বর্তমানে সাংগঠনিকভাবে সুসংগঠিত নয়। সরকারের জুলুম নির্যাতন, হামলা-মামলায় দলের বেশিরভাগ নেতাকর্মী ফেরারি। ফলে দলটি ৬ ধাপে অনুষ্ঠিত চার হাজারের অধিক ইউপির মধ্যে পাঁচ শতাধিক ইউপিতে প্রার্থীই ছিল না বিএনপির। সরকারদলীয় প্রার্থীদের ভয়ভীতি ও প্রশাসনের হয়রানির কারণে কিছু ইউপিতে প্রার্থীই দিতে পারেনি দলটি। আবার তুচ্ছ অজুহাতে এবং প্রস্তাবক-সমর্থকদের সমর্থন প্রত্যাহার করানোর মাধ্যমে মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়েছে অনেক ইউপিতে। নতুন করে হাজারো মামলায় আসামি হয়েছে হাজার হাজার নেতাকর্মী। দ্বিতীয় ধাপের পর বর্জনের হুমকি দিলেও শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে যুক্ত থেকেছে বিএনপি। সারাদেশে ধানের শীষের প্রার্থীর মাত্র ৩৬৭টি ইউপিতে বিজয়ী হয়েছে। এ অবস্থায় ইউপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং আপাত দৃষ্টিতে দলের এই ভরাডুবি নিয়ে দলটির নেতাকর্মীদের মধ্যে চলছে চুলচেড়া বিশ্লেষণ। দলের সিনিয়র নেতারা এ নির্বাচনকে দেখছেন ভিন্ন দৃষ্টিতে। তারা বলছেন, বিএনপি সাংগঠনিকভাবে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও রাজনৈতিকভাবে দল খুবই লাভবান হয়েছে। সব সময় ফলাফলের মাধ্যমে সাফল্যের বিচার হয় না। এ নির্বাচনের কারচুপি সহিংসতা, ফলাফল দখলের মাধ্যমে সরকারদলই বিএনপির আন্দোলনের দাবিকে আরও জোরালো করেছে। যা বিএনপির প্রতি সাধারণ মানুষের সমর্থন বাড়ানোর পাশাপাশি নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি আরও জোরালো করেছে।
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, গণতন্ত্রের অন্যতম একটি ধাপ হচ্ছে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন। আমরা গণতন্ত্রের স্বার্থে ইউপি নির্বাচনে অংশ নিয়েছি। তবে এবারে যা হয়েছে তা নির্বাচনের নামে প্রহসন মাত্র। সরকারের নির্দেশে প্রশাসনের পক্ষপাত দুষ্টতা, নির্বাচন কমিশনের আজ্ঞাবহ ভূমিকা ও সরকারদলীয় প্রার্থীদের নৈরাজ্য, ভোট লুটপাট ও অনিয়মের কারণে এটা প্রহসনে পরিণত হয়েছে। এবারের ইউপি নির্বাচন গ্রাম-বাংলাকে রক্তেরঞ্জিত করেছে। সার্বিকভাবে যে সহিংসতা হয়েছে তার কোনো তুলনা হয় না। এ নির্বাচন দেশের নির্বাচনের ইতিহাসে একটি কলঙ্কময় অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হবে। নির্বাচনের নামে আওয়ামী লীগ সরকার কীভাবে হত্যাযজ্ঞ পরিচালিত করে সেটা প্রমাণ হয়েছে। এ সরকারের অধীনে কোন নির্বাচন সুষ্ঠু হবেনা দেশে ও আন্তর্জাতিকভাবে তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
অন্যদিকে স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের মতে সাংগঠনিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিএনপি। তিনি বলেন, ইউপি নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিকভাবে লাভবান হয়েছে বিএনপি। কিন্তু সাংগঠনিকভাবে ক্ষতির শিকার হয়েছে। তিনি বলেন, ইউপি নির্বাচন নিয়ে সরকারের প্রতারণা ও নির্বাচন কমিশনের ন্যক্কারজনক ভূমিকায় প্রমাণ হয়েছে- এ সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। এ সরকার ও কমিশনের অধীনে জনগণ ভোট দিতে পারবে না। এ বিষয়ে একটি কমন সেন্টিমেন্ট (সাধারণ মনোভাব) সব মানুষের মধ্যে প্রতিষ্ঠা হয়েছে। সরকার কি কি ধরনের অপকর্ম করতে পারে তার অনেকটাই প্রকাশ ঘটেছে। রাজনৈতিকভাবে বিএনপির এটুকুই লাভ। গয়েশ্বর রায় বলেন, সাধারণত নির্বাচনের মাধ্যমে সাংগঠনিকভাবে লাভবান হয় যে কোনো রাজনৈতিক দল। নেতাকর্মীদের মধ্যে যোগাযোগ বাড়ে এবং সম্পর্কের উন্নতি হয়। কর্মীরা সংগঠিত হওয়ার মাধ্যমে সমর্থনকে মজবুত করেন। কিন্তু এবার হয়েছে উল্টো। বিএনপি নেতাকর্মীরা সংঘটিত হতে পারেনি। মামলার ভারে আগে থেকেই বিপর্যস্ত নেতাকর্মীরা হাজারখানেক নতুন মামলার আসামি হয়েছেন।
ইউপি নির্বাচন বিএনপির প্রতি মানুষের সমর্থন বাড়ানোর পাশাপাশি দলের সাংগঠনিক ভিতকে মজবুত করেছে বলে মনে করেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদ। তিনি বলেন, দলীয় প্রতীকে ইউপি নির্বাচনের পক্ষে ছিল না বিএনপি। আমরা প্রথম থেকেই এটার প্রতিবাদ করেছি। যেসব যুক্তিতে বিএনপি প্রতিবাদ করেছিল শেষপর্যন্ত সেটাই প্রমাণিত হয়েছে। তিনি বলেন, প্রশাসনের পক্ষপাত ও নির্বাচন কমিশনের নির্লিপ্ততার সুযোগ নিয়ে সরকারদলীয় প্রার্থীরা জোর-জুলুম ও অনিয়মের মাধ্যমে ভোট ডাকাতি করেছে। বেশির ভাগ ইউপি চেয়ারম্যান পদেই তারা বিজয় ছিনিয়ে নিয়েছে। এর মাধ্যমে দৃশ্যত সরকার লাভবান হয়েছে বলে মনে হতে পারে। কিন্তু আখেরে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সরকারই। সারা দেশের মানুষের কাছে সরকারের নগ্নরূপ প্রকাশ ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনই সুষ্ঠু হবে না বলে বিএনপির যে দাবি তা সরকারই প্রতিষ্ঠিত করেছে। যা বিএনপির দাবিকে সুসংহত করেছে।
তবে বিএনপির তৃণমূলের অনেক নেতা মনে করেন প্রার্থী নির্বাচনে নানা অনিয়মের মাধ্যমে দলের ত্যাগি এবং বিশস্ত অনেক নেতাকে দূরে ঠেলে দেয়া হয়েছে। প্রার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিএনপি প্রথমে থানা বিএনপির সভাপতি, সেক্রেটারি এবং ইউনিয়ন কমিটির সভাপতি, সেক্রেটারি ও সাংগঠনিক সম্পাদকের মতামতের ভিত্তিতে প্রার্থী চূড়ান্ত করা হবে। শেষ পর্যন্ত দলটি এ সিদ্ধান্তে থাকতে পারেনি। দ্বিতীয়বার এর সাথে সর্বশেষ ওই এলাকায় যিনি এমপি নির্বাচন করছেন তারও মতামত নেয়ার শর্ত জুড়ে দেয়। এতে করে এমপি প্রার্থীরা তাদের আজ্ঞাবহ পছন্দের লোকদের মনোনয়ন দিয়েছেন। ফলে অনেক স্থানে যোগ্য ও ত্যাগি নেতারা বঞ্চিত হয়েছেন। এতে করে দলটির তৃণমূলেও এখন অনেকটা বিভক্তি তৈরী হয়েছে বলে অনেক নেতা মনে করেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন