রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামী জীবন

কাবার পথে চলে মুসাফীর

আলহাজ্ব মাওলানা এম. এ. মান্নান (রহ:) | প্রকাশের সময় : ২ আগস্ট, ২০১৯, ১২:০২ এএম

আল্লাহ পাক কাবা ঘরের মর্যাদা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, “সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য পথ প্রদর্শক।”
হেদায়েতের দুইটি অর্থ: (১) পথ নির্দেশ করা, যা মঞ্জিলে মাকসুদে পৌঁছে, (২) সরাসরি মঞ্জিলে মাকসুদে পৌঁছে দেয়া। কাবা শরীফের বেলায় উভয় অর্থই প্রযোজ্য। কেননা কাবাকে তাজিমকরা, তার প্রতি ঈমান আনা, জিয়ারত করা মানুষের জীবনের উদ্দেশ্যকে সফল করে। অর্থাৎ আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি লাভের কারণ হয়।

দ্বিতীয়ত: কাবা ঘর আল্লাহ পাকের কুদরতে যে সব নিদর্শনা আছে তা দেখেও হেদায়েত লাভ করা যায়। বিস্ময়কর নিদর্শনগুলোর মধ্যে একটি হল ‘মাকামে ইব্রাহীম’। ‘মাকামে ইব্রাহীম’ হল একটি পাথর যার ওপর দাঁড়িয়ে হযরত ইব্রাহীম (আ:) কাবা ঘর নির্মাণ করেছিলেন। এক রাওয়ায়েতে আছে, নির্মাণের উচ্চতার সাথে সাথে পাথরটি আপান-আপনি উঁচু হয়ে যেত এবং নিচে অবতরণের সময় নিচু হয়ে যেত। এই পাথরটির গায়ে এখনও হযরত ইব্রাহীম (আ:) এর পদ চিহ্ন আছে। একটি অচেতন পাথরের পক্ষে প্রয়োজন অনুসারে উঁচু হওয়া এবং নিচু হওয়া এবং মোমের মত নরম হয়ে নিজের মধ্যে পদচিহ্ন গ্রহণ করা এসব হল আল্লাহ পাকের অপার কুদরত। এতে কাবা ঘরের শ্রেষ্ঠত্বই প্রমাণ করে। প্রথমে এই পাথরটি কাবা ঘরের দরজার কাছে ছিল। এখন তওয়াফকারীদের সুবিধার্থে কাবা ঘরের পূর্ব দিকে সামান্য দূরে স্থাপন করা হয়েছে। তওয়াফ শেষ করে এই পাথরের পিছনে দুই রাকাত নামাজ আদায় করতে হয়। এই পাথরটিকে একটি সুন্দর কাঁচপাত্রে সংরক্ষিত করা হয়েছে। যাতে জিয়ারতকারীদের নিজ চক্ষু দ্বারা দর্শন করে মনের তৃপ্তি মিটাতে পারে।

হযরত ইব্রাহীম (আ:) স্বীয় পুত্র, হযরত ইসমাইল (আ:) এবং হযরত জিব্রাইল (আ:) এর সাহায্য নিয়ে পবিত্র কাবা ঘর নির্মাণ করে দু’হাত তুলে আল্লাহ পাকের দরবারে এই বলে দোয়া করলেন যে, “হে আল্লাহ! এ স্থানকে আপনি শান্তিধাম বানিয়ে দিন এবং এর অধিবাসীদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও কিয়ামতে বিশ্বাস করে তাদেরকে ফল দ্বারা রিজিক প্রদান করুন। নিশ্চয়ই আপনি শ্রবণকারী, সর্বজ্ঞ। প্রভু! আপনি আমাদের উভয়কে আপনার আজ্ঞাবহ করুন এবং আমাদের বংশধর থেকেও একটি অনুগত দল সৃষ্টি করুন। আমাদেরকে হজ্বের রীতিনীতি বলে দিন এবং আমাদেরকে ক্ষমা করুন, নিশ্চয়ই আপনি তওবা কুবলকারী দয়ালু। হে প্রভু! তাদের মধ্য থেকেই তাদের জন্য একজন নবী প্রেরণ করুন। যিনি তাদের নিকট আপনার আয়াত সমূহ তালাওয়াত করবেন। তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেবেন এবং তাদেরকে পবিত্র করবেন। নিশ্চয়ই আপনি পরাক্রমশালী হেকমত ওয়ালা।” উপরোক্ত দোয়া সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, আল্লাহপাকের পক্ষ থেকে এই দোয়া কবুল করা হয়েছে এবং কাক্সিক্ষত নবীকে শেষ জামানায় প্রেরণ করা হবে (ইবনে কাসীর)। এরপর আল্লাহ পাক হযরত ইব্রাহীম (আ:) কে বললেন, “এবং মানুষের মধ্যে হজ্বের জন্য ঘোষণা প্রচার কর। তারা তোমার নিকট আসবে পায়ে হেঁটে এবং সর্ব প্রকার কৃষকরা উটের পিঠে ছওয়ার হয়ে দূর দূরান্ত থেকে।” (সূরা: হজ্ব, আয়াত-২৭)

অর্থাৎ- মানুষের মধ্যে ঘোষণা করে দাও যে, তোমাদের ওপর হজ্ব ফরজ করা হয়েছে। (বাগভী) হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) বলেন যে, যখন হযরত ইব্রাহীম (আ:) কে হজ্ব ফরজ হওয়ার ঘোষণা প্রদানে নির্দেশ দেন তখন তিনি আল্লাহ পাকের দরবারে এই বলে আরজ করলেন যে, হে আল্লাহ এই স্থানটি জনমানবহীন, শুষ্ক মরু প্রান্তর। ঘোষণা শুনার মত কেউ নেই। যেখানে জনবসতি আছে, সেখানে আমার আওয়াজ কিভাবে পৌঁছবে? আল্লাহ পাক বললেন, “তোমার দায়িত্ব শুধু ঘোষণা করা, আর আমার দায়িত্ব হল সারাবিশ্বে তোমার এই ঘোষণা পৌঁছে দেয়া।”
হযরত ইব্রাহীম (আ:) ‘মাকামে ইব্রাহীম’ দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলেন, আল্লাহ পাক তা উচ্চ করে দেন। কোন কোন রেওয়াতে আছে। তিনি আবু কুবায়েছ পাহাড়ে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেছিলেন। দুই কানে আঙ্গুল রেখে ডানে বামে এবং পূর্ব পশ্চিমে মুখ করে বললেন, “লোক সকল! তোমাদের পালনকর্তা নিজের গৃহ নির্মাণ করেছেন এবং তোমাদের ওপর এই গৃহের হজ্ব ফরজ করেছেন। তোমরা সবাই পালনকর্তাার আদেশ পালন কর।” হযরত ইব্রাহীম (আ:) এর আওয়াজ আল্লাহপাক সারাবিশ্বে পৌঁছে দেন এবং তখনকার জীবিত মানুষই না বরং কিয়ামত পর্যন্ত যত মানুষ এ বিশ্বে আগমন করবে, সমস্ত মানুষের নিকট অর্থাৎ ‘রূহ’ জগতে এই আওয়াজ পৌঁছে দেন। যার ভাগ্যে আল্লাহ পাক হজ্ব লিখে দিয়েছেন তারা সবাই এই ডাক শুনে ‘লাব্বাহিক’ বলে উত্তর দিয়েছিল। হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) বলেন, “হযরত ইব্রাহীম (আ:) এর আওয়াজের জবাবই হচ্ছে ‘লাব্বাহিক’ বলার আসল ভিত্তি।” (মাজহারী)

হযরত আদম (আ:) যে কাবা ঘর নির্মাণ করেছিলেন, অথবা হযরত জিব্রাইল (আ:) বাইতুল মামুরের অনুরূপ একটি ঘর প্রতিস্থাপন করেছিলেন। তা হযরত নূহ (আ:) পর্যন্ত বহাল ছিল। অসংখ্য নবী রাসূল এবং আল্লাহ পাকের ‘অহদানিয়াত’ এ বিশ্ববাসীগণ এর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেছেন। তওয়াফ করেছেন, নামাজ আদায় করেছেন, হজ্ব সমাপন করেছেন, এই ছিলছিলা হযরত নূহ (আ:) পর্যন্ত বহাল ছিল। হযরত নূহ (আ:) এর তুফানের সময় এই ঘরকে আল্লাহ পাক আসমানে উঠিয়ে নিয়ে যান। তারপর বহু দিন ওখানে কোন ঘর ছিল না। হযরত ইব্রাহীম (আ:) এর উপর হুকুম হল, ওই স্থানে আবার ঘর তৈরি করতে। আল্লাহ পাক স্থানও নির্দিষ্ট করে দিলেন। সেখানে হযরত জিব্রাইল (আ:) কাবা ঘর প্রতিস্থাপন করেছিলেন।

হযরত ইব্রাহীম (আ:) কাবা ঘর পুননির্মাণ করে আল্লাহ পাকের নির্দেশে এই ঘরের তওয়াফের জন্য আহ্বান জানালেন। সেই থেকে এই ঘরে হজ্ব করা শুরু হল। হযরত ইব্রাহীম (আ:) এর নির্মাণের পর কয়েকবার এই কাবা ঘর মেরামত এবং পুননির্মাণ করা হয়েছে। তবে স্থান ও কাঠামো পরিবর্তন করা হয়নি। রাসূল পাক (সা:) এর কাছে আল্লাহ পাক এই ঘটনা বর্ণনা করে তার উম্মতের প্রতিও হজ্ব ফরজ তা জানিয়ে দিলেন। আল্লাহ পাক বলেন,
“মানুষের ওপর আল্লাহ পাকের এই অধিকার রয়েছে যে, যাদের এই ঘর পর্যন্ত পৌঁছাবার সামর্থ্য আছে তারা যেন এই ঘরের হজ্ব সমাপন করে। আর যারা এই নির্দেশ পালন করতে অস্বীকার করবে, তাদের জেনে রাখা প্রয়োজন যে, আল্লাহ পাক বিশ্ববাসীর প্রতি কিছুমাত্র মুখাপেক্ষী নন।” (সূরা- আলে ইমরান, আয়াত- ৯৭)

অর্থাৎ সামর্থ্যবান, আকেল, বালেগ এবং রাস্তায় কোন প্রতিবন্ধকতা না থাকলে হজ্ব করতেই হবে।
রাসূলে পাক (সা:) বলেছেন পাঁচটি স্তম্ভের ওপর ইসলাম প্রতিষ্ঠিত-
১. সাক্ষ্য দান করা যে, আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই এবং সাক্ষ্য দান করা যে মুহাম্মদ (সা:) আল্লাহ পাকের বান্দা ও রাসূল।
২. নামাজ প্রতিষ্ঠা করা।
৩. যাকাত প্রদান করা।
৪. রমজান মাসে রোজা পালন করা।
৫. আল্লাহর ঘরে হজ্ব সমাপন করা।

হযরত ওমর (রা:) বলেন, “আমার ইচ্ছে হয় যে, কিছু লোককে রাজ্যের শহরগুলোতে প্রেরণ করি যারা খুঁজে দেখবে কারা হজ্ব করার সামর্থ থাকা সত্তে¡ও হজ্ব করে না, তাদের ওপর ‘জিজিয়িা’ কর চাপিয়ে দেই। কেননা সামর্থ্য থাকা সত্তে¡ও যারা হজ্ব আদায় করে না, তারা মুসলমান নয়, তারা মুসলমান নয়।”
হযরত আলী (রা:) বলেন, “যে ব্যক্তি হজ্বের সামর্থ্য থাকা সত্তে¡ও হজ্ব পরিত্যাগ করে, সে ইহুদী হয়ে মরুক অথবা নাছারা হয়ে মরুক তাতে কিছুই যায় আসে না।” অর্থাৎ হজ্ব ফরজ হলে এ ব্যাপারে কোন প্রকার গড়িমসি করা যাবে না। যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি হজ্ব সমাপন করতে হবে। রাসূলে পাক (সা:) বলেছেন, “তোমরা ফরজ হজ্বের জন্য তাড়াতাড়ি কর। কারণ তোমরা কেউই জান না যে, তোমাদের ভাগ্যে কি আছে।” অর্থাৎ কোন প্রকার কালক্ষেপণ করা যাবে না।
রাসূলে পাক (সা:) আরও বলেছেন, “হে মানব সমাজ! আল্লাহ তোমাদের উপর হজ্ব ফরজ করেছেন, সুতরাং তোমরা হজ্ব পালন কর।” (মুসলিম)
(আলহাজ¦ মাওলানা এম. এ. মান্নান (রহ:)- এর রচনাবলী হতে সংগৃহীত)

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন