সোমবার ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

রাইড শেয়ারিং যখন ভাড়ায়

আবদুল্লাহ আল মামুন | প্রকাশের সময় : ৪ আগস্ট, ২০১৯, ১২:০১ এএম

রাইড শেয়ারিং সেবায় প্রাইভেট কার ও মোটরসাইকেল ছাড়াও এখন যুক্ত হয়েছে সিএনজি অটো রিকশা ও মাইক্রোবাস। তবে মোটরসাইকেলের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। ঢাকা শহরের ‘যানজট কমানো’ এবং ব্যক্তিগত গাড়ির ‘অবসরকালীন ব্যবহার’ রাইড শেয়ারিং- এর মূল লক্ষ্য হলেও মূলত ঘটছে উল্টো ঘটনা।

বর্তমানে অনেকেই গাড়ি কিনে ড্রাইভার রেখে রাইড শেয়ারিং-এ ভাড়ায় দিচ্ছেন। আবার কেউ দৈনিক চুক্তি ভিত্তিতে ভাড়া দিচ্ছেন। এক একজন বিনিয়োগকারীর গাড়ি বা মোটরসাইকেলও একাধিক। যার কারণে রাজধানীতে প্রাইভেট কার ও মোটরসাইকেল অনেক বেশি বেড়ে গেছে। যানজট নিরসন ও যাত্রী ভোগান্তি লাঘবে রাইড শেয়ারিং সেবা চালু হলেও সেই উদ্দেশ্যই এখন ব্যহত হওয়ার পথে। বিআরটিএ সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ঢাকায় এখন এক লাখ ২৫ হাজারেরও বেশি রাইড শেয়ারিং-এর গাড়ি আছে। এরমধ্যে মোটরসাইকেল আছে ১ লাখ ৪ হাজার ৩৮৯ এবং কার ১৮ হাজার ২৫৩টি। আর বিআরটিএ’তে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করা ঢাকা ও চট্টগ্রামে অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ার কোম্পানি আছে ১৬টি। এরমধ্যে উবার, পাঠাও সহজ, ওভাইসহ আরো দু-একটি প্রতিষ্ঠানের সেবা চলমান আছে।

একই সূত্র জানায় ঢাকা শহরে প্রতিদিন ৩০ হাজারেরও বেশি রাইড শেয়ারিং হয়। ২০১৮ সালে এ সংখ্যা অনেক কম ছিল। গত এক বছরে রাইড শেয়ারিং-এর প্রবৃদ্ধি শতকরা ১০০ ভাগেরও বেশি। এ সংখ্যা বেড়েই চলছে। যানজট কমানোর যে মূল উদ্দেশ্য নিয়ে এই সেবাটি যাত্রা শুরু করেছিল সেটি কোনভাবে প্রতিফলিত হয়নি। উল্টো রাইড শেয়ারিং সেবায় নতুন নতুন গাড়ি ও মোটরসাইকেল যোগ হয়ে যানজট ও জনভোগান্তি আরো বহুগুন বেড়ে গেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আন্তর্জাতিকভাবে রাইড শেয়ারিংয়ের অর্থ হচ্ছে- কোনো ব্যক্তির গাড়িতে তার ব্যবহারের পর যে বাড়তি আসন থাকে, সেটি তিনি শেয়ার করবেন। অথবা অবসরকালীন সময়ে গাড়িটি যাত্রীবহনে ব্যবহার করা। কিন্তু বাংলাদেশে হচ্ছে উল্টোটি। এছাড়া অ্যাপে চলতে গিয়ে প্রতিনিয়ত যাত্রী হয়রানির ঘটনা ছাড়াও চালকদের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে।

অধুনা বন্ধ হয়ে যাওয়া রাইড শেয়ারিং কোম্পানি চলোডটকম-এর প্রধান নির্বাহী দেওয়ান শুভ বলেন, রাইড শেয়ারিং-এর ধারণাটি হল- ব্যক্তিগত গাড়ি অবসরে শেয়ার করা। এর ফলে অবসর সময়ে কিছুটা অতিরিক্ত আয় হবে এবং যাত্রীদের জন্য কিছুটা সুবিধা হবে। কিন্তু বাংলাদেশে যেটা হচ্ছে সেটি মূল লক্ষ্যের উল্টো। তিনি বলেন, এখানে ইনভেস্টররা নতুন গাড়ি কিনে ব্যবসার জন্য রাইড শেয়ারিংয়ে যোগ দিচ্ছেন। কারোর ১০টি গাড়িও আছে। যেগুলো সারাদিনই রাইড শেয়ার করে। ফলে রাজধানীতে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন গাড়ি আসছে। এতে যানজট না কমে বরং অনেকগুণ বেড়ে যাচ্ছে। মূল নীতির জায়গায় থাকলে ব্যক্তিগত গাড়ি যেগুলো আছে সেগুলোই রাইড শেয়ার করতো। তাতে বরং যানজট কমতো। তিনি আরও বলেন, এখন অবস্থা এমন যে- বিনিয়োগকারীরা ট্যাক্সি ক্যাবের ব্যবসা না করে এখন অনলাইন প্লাটফর্মে ব্যবসা করছে। এটা ট্যাক্সিক্যাব ব্যবসার নতুন রূপ ছাড়া আর কিছুই না বলে তিনি মন্তব্য করেন।

বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে অনেকেই রাইড শেয়ারকে ট্যাক্সিক্যাব ব্যবসা হিসেবে নিয়েছেন। আগে ব্যক্তিগত লাইসেন্সে কমার্শিয়াল ভাবে গাড়ি ব্যবহার করা যেত না। কিন্তু এখন সেটা করা যায়। কিন্তু এটা যদি শুধু ব্যবসার উদ্দেশ্যে হয় তাহলে ব্যক্তিগত গাড়িই লাইসেন্স করা হচ্ছে পুরোপুরি বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে। এর ফলে রাজধানীতে দৈনিক নতুন নতুন গাড়ি যোগ হচ্ছে এবং যানযটও অনেকগুণ বেড়ে যাচ্ছে।

ভোক্তভোগীরা বলেন, বর্তমানে রাইড শেয়ারিংয়ে সার্ভিসে গ্রাহকেরা অভিযোগ জানাতে গিয়েও নানা অসুবিধায় পড়েন বা প্রতিকার পাননা। বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের কাস্টমার কেয়ার ও কল সেন্টার না থাকায় চালকরা স্বেচ্ছাচারী আচরণ করতে পারছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেউ চাইলেই গাড়ি কিনে যেন রাইড শেয়ারিং-এ দিতে না পারেন সেরকম একটি নীতিমালা থাকা প্রয়োজন। এছাড়া এক ব্যক্তি একটার বেশি গাড়ি রাইড শেয়ারিং-এ দিতে পারবেন না। এতে সেবাটির মূল উদ্দেশ্য ব্যহত হবে না। বিশেষজ্ঞদের পাশাপাশি নগরবাসীরা বলেন, যথাযথ শক্ত নীতিমালা না থাকায় এখন অনেকেই ইচ্ছেমত চালক বনে যাচ্ছেন। এসব চালকদের প্রশিক্ষণ ও ব্যবহার পেশাগত না থাকায় দুর্ঘটনা ও নাগরিক ভোগান্তি বাড়ছে। পথঘাট না চেনা ঢাকার বাইরের গাড়ি ও চালকরা এ ভোগান্তি বাড়িয়েছে। তাদের মতে, সেবাটি বর্তমানে ট্যাক্সি ক্যাবের অনলাইন সংস্করণ হিসেবে রূপ নিয়েছে।

এ বিষয়ে বিআরটিএর পরিচালক মাহবুব ই রাব্বানি বলেন, ট্যাক্সি ক্যাব কমার্শিয়াল লাইসেন্স-এর আওতায় যাত্রী পরিবহণ করে। আর রাইড শেয়ারিং হল ব্যাক্তিগত লাইসেন্সে কমার্শিয়াল অপারেশন। তবে অনেক ইনভেস্টর সেবাটির ভিন্নরূপ ব্যবহার করছে।

যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, রাইড শেয়ারিং নীতিমালা তৈরির সময় সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে যথাযথ আলোচনা না হওয়ায় বিষয়টি অস্পষ্ট রয়ে গেছে। সব পক্ষের সমন্বয়ে সঠিক নীতিমালার মাধ্যমে আইনের আওতায় এনে মনিটরিং করা হলে যাত্রী ভোগান্তি কমবে। একইভাবে মূল উদ্দেশ্য তথা যানজট লাঘব করা সম্ভব হবে।

প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালে উবার বাংলাদেশে প্রথম অ্যাপস-এর মাধ্যমে রাইড শেয়ারিং শুরু করে। পরে ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিআরটিএ রাইড শেয়ারিং-এর একটি নীতিমালা প্রকাশ ও কার্যকর করে। এই নীতিমালার অধীনে এ পর্যন্ত ১৬টি প্রতিষ্ঠান নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে। বিআরটিএ সূত্র জানায়, এক বছর আগে রাইড শেয়ারিং নীতিমালা মন্ত্রিসভার অনুমোদন পেয়েছে এবং গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানে সে অনুসারে সেবা পরিচালনার প্রক্রিয়াও চলছে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানগুলোকে নীতিমালা ও যথাযথ মনিটরিংয়ের আওতায় আনতে ইতোমধ্যে পুলিশ, র‌্যাব ও আবেদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে বিআরটিএর দফায় দফায় বৈঠক হয়েছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন