শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

চট্টগ্রামে বিদ্যুৎ পানির সংকট রোজাদারদের চরম দুর্ভোগ

প্রকাশের সময় : ৮ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

রফিকুল ইসলাম সেলিম : রাতে-দিনে দফায় দফায় বিদ্যুতের আসা-যাওয়া। ভ্যাপসা গরমে প্রাণ ওষ্ঠাগত। তার ওপর পানির তীব্র সংকট। চট্টগ্রামে বিদ্যুৎ-পানির কষ্টে চরম দুর্ভোগে রোজাদারেরা। প্রথম রোজার তারাবী ও সেহেরীতেও লোডশেডিং আর পানি সংকটের মুখোমুখি হতে হয়েছে নগরবাসীকে। মহানগরীর প্রায় প্রতিটি এলাকায় লোডশেডিং করা হচ্ছে। পানির জন্য হাহাকার চলছে অনেক এলাকায়। পানির অভাবে প্রয়োজনীয় ওজু গোসলসহ রান্না-বান্না ব্যাহত হচ্ছে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডÑপিডিবি’র কর্মকর্তারা বলছেন, রোজায় বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েছে। সেই তুলনায় উৎপাদন বাড়েনি। আর তাই লোডশেডিং করতে হচ্ছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে সার কারখানা বন্ধ করা হয়েছে। সিএনজি ফিলিং স্টেশনগুলো বিকাল ৩টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত টানা বন্ধ থাকছে। তবুও পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না। জাতীয় গ্রিড থেকে গ্যাস সরবরাহ কমে যাওয়ায় গ্যাসনির্ভর সব বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু রাখা যাচ্ছে না। কাপ্তাই হ্রদের পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় ওই পানিবিদ্যুৎ মহাপ্রকল্পের উৎপাদনও কমে গেছে।
পিডিবির হিসাবে চট্টগ্রামে এখন পিক আওয়ারে ৮শ থেকে সাড়ে ৮শ বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। চাহিদা স্বাভাবিক সময়ে সাড়ে ৯শ মেগাওয়াট হলেও রমজানে চাহিদা বেড়ে এক হাজার মেগাওয়াট ছেড়েছে। ফলে লোডশেডিং বাড়ছে। পিডিবির হিসাবে লোডশেডিংয়ের পরিমাণ কম হলেও বাস্তবে তা অসহনীয়। লোডশেডিংয়ের চেয়ে সরবরাহ ও সঞ্চালণ লাইনে ক্রটির কারণে মহানগরীর অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ বিভ্রাট হচ্ছে। অনেক এলাকায় রাতে দিনে ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে।
পিডিবি’র হিসাবে সোমবার রাতে পিক আওয়ারে চট্টগ্রাম অঞ্চলের সরকারি-বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো থেকে ৮৩৯ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ মিলেছে। গ্যাসের চাপ কমে যাওয়ায় রাউজান তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন কমে যায়। ২১০ মেগাওয়াট ক্ষমতার এক নম্বর ইউনিট থেকে সরবরাহ মিলেছে মাত্র ৮০ মেগাওয়াট। একই উৎপাদন ক্ষমতার দুই নম্বর ইউনিট থেকে মিলেছে ১০০ মেগাওয়াট। শিকলবাহা ৬০ মেগাওয়াট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি গ্যাসের অভাবে বন্ধ। একই এলাকার ১৫০ মেগাওয়াট পিকিং পাওয়ার থেকে পাওয়া যায় ১০০ মেগাওয়াট। সেখানকার ৫৫ মেগাওয়াট রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে সরবরাহ পাওয়া যায় ৪৩ মেগাওয়াট। ফার্নেসওয়েল চালিত প্রতিটি ১০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার তিনটি সরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্র দিনের বেলার প্রায় পুরোটাই বন্ধ থাকছে। পিকআওয়ারে এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু করা হয়। সোমবার রাতে এই তিনটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মধ্যে হাটহাজারী কেন্দ্র থেকে ৭৯ মেগাওয়াট, দোহাজারী থেকে ৮৫ মেগাওয়াট এবং জুলধা থেকে ১০১ মেগাওয়াট সরবরাহ পাওয়া গেছে।
আরপিসিএল থেকে ২৬.২ মেগাওয়াট, রিজেন্ট পাওয়ার থেকে ২১.৫ মেগাওয়াট, ইউনাইটেড থেকে ১৬ মেগাওয়াট, বারাকা পতেঙ্গা থেকে ৪৭ মেগাওয়াট ও ১১০ মেগাওয়াট ক্ষমতার এনার্জিপ্যাক থেকে ১০২ মেগাওয়াট সরবরাহ পাওয়া যায়। হ্রদে পানির উচ্চতা কমে যাওয়ায় কাপ্তাই বিদ্যুৎ প্রকল্পের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এই প্রকল্পের ৫টি ইউনিট পুরোদমে চালু করা যাচ্ছে না। সোমবার কাপ্তাই এক নম্বর ইউনিট থেকে ৩৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া গেছে।
বাকি চারটি ইউনিট বন্ধ ছিল। তার আগের দিন এক, দুই ও চার নম্বর ইউনিট চালু রেখে বিদ্যুৎ সরবরাহ পাওয়া গেছে ৭১ মেগাওয়াট। গতকাল কাপ্তাই হ্রদের পানির উচ্চতা ছিল ৭৫.৮৪ এমএসএল। এই সময়ে পানির উচ্চতা থাকার কথা ৭৭.৩০ এমএসএল। বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে যাওয়ায় লোডশেডিং বেড়েছে। দেশের অন্য এলাকায়ও বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় জাতীয় গ্রিড থেকে চট্টগ্রাম সরবরাহও কমে গেছে।
পিডিবির একজন কর্মকর্তা জানান, রমজানে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় বিদ্যুৎ সংকট বেড়েছে। তিনি বলেন, গ্যাসের অভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে গেছে। সরকার গ্যাস সরবরাহ বাড়াতে উদ্যোগ নিয়েছে। আশা করি খুব সহসা বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহ বাড়বে।
এদিকে বিদ্যুতের সাথে পাল্লা দিয়ে চট্টগ্রাম নগরীতে পানি সংকটও বাড়ছে। এমনিতেই রেশনিং করে নগরীতে পানি সরবরাহ দিচ্ছে চট্টগ্রাম ওয়াসা। রমজান মাসে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় রেশনিংয়েও পরিস্থিতি সামাল দেয়া যাচ্ছে না। চট্টগ্রাম ওয়াসার হিসেবে নগরীতে দৈনিক পানির চাহিদা ৫০ কোটি লিটারের বেশি। ওয়াসা সরবরাহ দিতে পারে ২০ কোটি লিটার। প্রচ- গরম আর লোডশেডিংয়ের কারণে ওয়াসার পানি উৎপাদন, উত্তোলন ও সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘিœত হচ্ছে। প্রতিদিন ১৭ কোটি লিটারের কাছাকাছি পানি সরবরাহ দিতে পারছে ওয়াসা। এতে করে মহানগরীর অপেক্ষাকৃত কিছু ও দূরবর্তী এলাকায় পানি সরবরাহ মারাত্মক বিঘিœত হচ্ছে। অনেক এলাকায় সপ্তাহে একদিনও পানি সরবরাহ যাচ্ছে না।
চকবাজারের উর্দূগলির বাসিন্দা মোঃ কাশেমী জানান, তাদের এলাকায় সপ্তাহে একদিন ওয়াসার পানি যায়। ওই পানি সংরক্ষণ করে সীমিত আকারে ভাড়াটিয়াদের মধ্যে সরবরাহ করে বাড়িওয়ালারা। ফলে এলাকায় পানি সংকট চরমে উঠেছে। রান্নাবান্না তো দূরের কথা প্রয়োজনীয় ওযু, গোসলও করা যাচ্ছে না।
আগ্রাবাদ হাজিপাড়ার বাসিন্দা মনসুর আহমেদ বলেন, সপ্তাহে একদিন ওয়াসার পানি পাওয়া যায়। গত কয়েকদিনে পানি আসলেও তা বেশিক্ষণ থাকছে না। যেটুকু পানি ধরা যাচ্ছে তা দিয়ে দুই দিন চলা যাচ্ছে না। ওয়াসার পানি কিনতেও পাওয়া যাচ্ছে না। এতে করে ভাড়াটিয়ারা চরম দুর্ভোগে পড়েছে। অনেকে বাসা ছেড়ে দিতে চাচ্ছে। একই অবস্থা নগরীর লালখান বাজার, বাঘঘোনা, টাইগারপাস, আগ্রাবাদ, মুহুরিপাড়া, বেপারীপাড়া, রঙ্গিপাড়া, দাইয়াপাড়া, শান্তিবাগ, ছোটপোল, বড়পোল, পশ্চিম মাদারবাড়ি, পাঠানটুলি, মোগলটুলি, আলকরণ, পাথরঘাটা, বাকলিয়া, রাজাখালী চাক্তাই এলাকায়। যেসব বাসাবাড়িতে ওয়াসার লাইন রয়েছে তারা চরম সংকটে রয়েছে। সপ্তাহে দু’একদিন ওয়াসার পানি আসছে লাইনে। বাড়ির মালিকরা রাত জেগে পানির জন্য পাহারা দিচ্ছে, কিন্তু পানি আসছে না। মাঝেমধ্যে লাইনে পানি এলেও তা বেশিক্ষণ থাকছে না।
চট্টগ্রাম ওয়াসার কর্মকর্তারা বলছেন, দীর্ঘদিন যাবৎ বড় কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন না হওয়ায় ওয়াসার সক্ষমতা বাড়েনি। বর্তমান সরকারের সময়ে কয়েকটি বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ এগিয়ে চলছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত পানি সংকট থাকবে। ওয়াসার ডিপটিউবওয়েলগুলো বেশিরভাগ পুরনো হয়ে যাওয়ায় এবং পানির উচ্চতা কমে যাওয়ায় পানি উৎপাদন কমে গেছে। সম্প্রতি ৬টি নতুন নলকূপ বসানো হয়েছে।
চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী জানান, রমজানে সংকট মোকাবিলায় ওয়াসার পক্ষ থেকে বেশকিছু ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তিনটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা হয়েছে। গ্রাহকদের প্রয়োজন অনুযায়ী পানি সরবরাহ করতে পানিবাহী ১৪টি গাড়ি সচল রাখা হয়েছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন