উমর ফারুক আলহাদী : মিসেস রহমান। ষাটোর্ধ্ব একজন মহিলা। তিনি ডায়বেটিস রোগী। তাকে সার্বক্ষণিক ওষুধপত্র ব্যবহার করতে হয়। তিনি নিয়মিত ইনস্যুলিন নেন। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরার সময় প্রায় ৩ মাসের ওষুধপত্র নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু শাহজালাল বিমানবন্দরে আসার পর জীবন রক্ষাকারী এসব ওষুধপত্রও তাকে হারাতে হয়েছে। ইত্তেহাদ এয়ারলাইন্সে একটি ফ্লাইটে মঙ্গলবার দিবাগত রাত ৮টা ২০ মিনিটে মিসেস রহমান শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। সেখানে প্রায় সোয়া ২ ঘণ্টা অপেক্ষা পর ১০টা ৩৫ মিনিটে তার একটি লাগেজ খুঁজে পান বেল্টে। কিন্তু লাগেজ কাটা এবং তালাও কাটা। কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনী এবং সিসি ক্যামেরার মনিটরিংয়ের মধ্যেই লাগেজ চোরেরা তার মূল্যবান জিনিসিপত্র ও জীবন রক্ষাকারী ওষুধপত্র লাগেজ থেকে নিযে যায়। ল্যাপটপ, আই ফোন, স্বর্ণালঙ্কারসহ প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকার মালামাল নিয়ে গেছে লাগেজ কাটা পার্টি। গতকাল বুধবার মিসেস রহমানের ছেলে এভাবেই কথিত কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনীর শাহজালাল বিমানবন্দরের ভেতরে লাগেজের মালামাল খোয়া যাওয়ার ঘটনাটি বর্ণনা করেন। তিনি অভিযোগ করেন, বিমানবন্দরের ভেতরে একটি স্পর্শকাতর এলাকা থেকে যদি এভাবে লাগেজ কাটা হয়, তাহলে এত সব নিরাপত্তার প্রয়োজন কি? এ প্রশ্ন মিসেস রহমানের ছেলের। শুধু তিনিই নন, আরো অনেকেই এ ধরনের অভিযোগ করেছেন।
কিছুদিন আগে উত্তরার ব্যবসায়ী জুনায়েদ হোসেন মালয়েশিয়া থেকে শাহজালাল বিমানবন্দরে আসেন। তিনি প্রায় দুই ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর তার লাগেজ পান। কিন্তু লাগেজ খুলে তিনি হতবাক। তিনি দেখেন কে বা কারা তার লাগেজের ভেতর তালা কাটার মেশিন রেখে দিয়েছে। তার ধারণা, লাগেজের তালা কাটতে গিয়ে তাড়াহুড়া করে ভুলে লাগেজের তালা কাটা মেশিনটি রেখে গেছে।
বিমানবন্দর থেকে বছর দেড়েক আগে জনপ্রশাসন মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ এবং সাবেক বিমানমন্ত্রী জি এম কাদেরসহ অনেক ভিইপির লাগেজ খোয়া যাওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে জানা গেছে, প্রতিদিন গড়ে ২০০ লাগেজ খোয়া যাচ্ছে কিংবা লাগেজ কেটে মালামাল নিয়ে যাচ্ছে লাগেজ কাটা সিন্ডিকেটের সদস্যরা। এ ব্যাপারে অভিযোগ করেও কোনো সুফল পাচ্ছেন না ভোক্তভোগীরা। তারা বলছেন, কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনী! আছে সিসি ক্যামেরা, আছেন সিভিল এভিয়েশন, বিমান, কাস্টমস, এপিবিএন ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য। আছেন বিশেষ নিরপত্তা বাহিনী। তারপরও থেমে নেই লাগেজ কাটা পার্টির তৎপরতা। কথিত এত সব নিরাপত্তার মধ্যেও প্রতিদিনই খোয়া যাচ্ছে শত শত লাগেজ। মন্ত্রী, এমপি, ভিআইপি, ব্যবসায়ীসহ সাধারণ যাত্রী কেউ রেহাই পাচ্ছেন না লাগেজ কাটা পার্টির হাত থেকে। লাগেজ কেটে নিয়ে যাচ্ছে যাত্রীদের মূল্যবান জিনিসপত্র। মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, আইপ্যাট, স্বর্ণালঙ্কার। এমনকি জীবন রক্ষাকারী ওষুধপত্রও চুরি হয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন গড়ে ২শ’ লাগেজে চুরি হওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
অভিযোগকারীরা বলছেন, অরক্ষিত হয়ে পড়ছে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। নিরাপত্তাহীন এ বিমানবন্দর এখন ভয়াবহ হুমকির মুখে। লাগেজ কাটা চক্রটি এতটাই বেপরোয়া যে, মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে যেকোনো ধরনের নাশকতা ঘটাতেও পারে। কারণ যেখানে মন্ত্রী-এমপিদের লাগেজ অনায়াসে নিয়ে যাচ্ছে, সেখানে লাগেজের ভেতর বিস্ফোরক দ্রব্য ঢুকিয়ে নাশকতা সৃষ্টি করা কিংবা যেকোনো যাত্রীর লাগেজে বিস্ফোরক দিয়ে তাকে ফাঁসিয়ে দেয়াও অসম্ভব কিছু নয়। এমন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন ভোক্তভোগীরা। তাদের অভিযোগ, সিসি ক্যামেরায় লাগেজ চুরির দৃশ্য ধরা পড়লেও এদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যস্থা নেয়া হচ্ছে না। ফলে দিন দিন নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ছে দেশের প্রধান আন্তর্জাতিক এ বিমানবন্দরটি। তবে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা কর্মকতৃারা বলছেন, লাগেজ চুরির ঘটনা আগের চেয়ে অনেক কমেছে।
জানতে চাইলে বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, লাগেজ চুরি, লাগেজ পেতে বিলম্ব কিংবা যাত্রীদের লাগেজ খোয়া যাওয়ার ঘটনা নতুন নয়। দীর্ঘ দিন থেকেই এ ধরনের ঘটনা ঘটে আসছে। সব কিছু রাতারাতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। আমরা চেষ্টা করছি, এখন অনেকটা কমে আসছে। মন্ত্রী মেনন বলেন, লাগেজ বিড়ম্বনা কমাতে হলে বিমানের গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং জয়েন্ট ভেঞ্চারে দিতে হবে। এ জন্য প্রচেষ্টা চলছে। তিনি বলেন, বিমানবন্দরের নিরাপত্তাব্যবস্থা অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে ভালো। এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী মেনন বলেন, সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে অপরাধীদের শনাক্ত করে ইতোমধ্যেই বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, আমি নিজেও প্রায়ই বিমানবন্দরের সার্বিক পরিস্থিতি দেখতে পরিদর্শনে যাই।
লাগেজ ঠিক সময়ে পাওয়া যায় নাÑ হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাত্রীদের এমন অভিযোগ দীর্ঘদিনের। সাম্প্রতিক সময়ে বিমানবন্দরে কর্মরত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের তৎপরতায় বিষয়টি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলে সংশ্লিষ্টরা দাবি করছেন। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ব্যবহার করে বাংলাদেশে আসা যাত্রীদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগ হলো, অনেক অপেক্ষার পর যখন লাগেজ পান তখন অনেকেরই লাগেজ কাটা থাকে।
জানা গেছে, শাহজালালে অন্তত অর্ধশত লাগেজ পার্টি গ্রুপ সক্রিয়। বিমানবন্দরে কর্মরত পুলিশ, কাস্টম ও সিভিল এভিয়েশনের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী গ্রুপগুলোকে সহযোগিতা করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বিমানবন্দরে দায়িত্বপ্রাপ্ত কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর ছত্রছায়ায় লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড শাখার মাধ্যমে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট লাগেজ চুরির সঙ্গে জড়িত। প্রতিদিন গড়ে ২০০ লাগেজ হারানোর অভিযোগ আসছে। হাতেগোনা কিছু লাগেজ পাওয়া গেলেও অধিকাংশই পাওয়া যায় না।
বিমানবন্দরের কর্মকর্তারা বলছেন, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অনেক সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে জেল-জরিমানা করা হয়েছে। গত ৬ মাসে এই সংখ্যা কমে এসেছে। তবে এ ধরনের অপরাধমূলক কর্মকা- একেবারে কমে গেছে এটা বলা যাবে না।
বিমানবন্দর সূত্র বলছে, ঢাকায় এমন ঘটনা আর তেমন ঘটছে না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিমানবন্দরের এক কর্মকর্তা বললেন, ঢাকাতে এখন লাগেজ কাটা হয় না। কুয়ালালামপুর, দুবাই এবং থাইল্যান্ডে এ ঘটনা ঘটে। সেখান থেকে কাটা লাগেজ ঢাকাতে আসে। বুকিং লাগেজে করে অনেকে ট্যাক্সেবল দামি জিনিস নিয়ে আসে। অনেক যাত্রী ট্যাক্স ফাঁকি দেয়ার জন্য এই কাজ করে। কুয়ালালামপুর, দুবাই বা থাইল্যান্ডে কার্গো বা লাগেজ সরবরাহের কাজে যারা থাকে তারা বেশিরভাগই এই উপমহাদেশের। বিশেষ করে ভারত, শ্রীলংকা বা পাকিস্তানের। তারা জানে বাংলাদেশের মানুষ বুকিং লাগেজে অনেক দামি জিনিসপত্র নিয়ে যায়। তাই বিমানে উঠানোর আগেই সেই লাগেজ কেটে মূল্যবান সামগ্রী সরিয়ে রাখে।
বিমানবন্দরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মুহাম্মদ ইউসুফ জানালেন, এই অভিযোগ তারা পেয়েছেন এবং বিষয়টি কর্তৃপক্ষকেও জানানো হয়েছে। তিনি জানালেন, অনেক সময় বিশেষ করে ট্রানজিট ফ্লাইটে এ ধরনের ঘটনা ঘটে। অনেক যাত্রী মনে করেন হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে লাগেজ কাটা হয়। এটি সম্মানিত যাত্রীদের ভুল ধারণা। তাহলে করণীয় কি? এমন প্রশ্নের জবাবে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মুহাম্মদ ইউসুফ বলছেন, ‘লাগেজ র্যাপিং করে নেয়া ভালো। সে ক্ষেত্রে বুকিং লাগেজ কাটার সম্ভাবনা খুব কম থাকে।
বিমানবন্দরে কর্মরত একাধিক কর্মকর্তা জানান, দীর্ঘদিন ধরে যারা বিমানবন্দরে কাজ করে তারা লাগেজ ধরলেই বুঝতে পারে লাগেজের কোথায় মূল্যবান জিনিস আছে। তারপর তারা সেখান থেকে কেটে মূল্যবান জিনিসপত্র লাপাত্তা করে ফেলে। মূল্যবান জিনিসপত্র হাতব্যাগে রাখাই নিরাপদ।
সাইদুল আলম ইতালি থেকে বাংলাদেশে আসেন গত ৪ মার্চ, সঙ্গে ছিল তিনটি লাগেজ। বিমানবন্দরে নামার পর দু’টি লাগেজ পেলেও অন্যটি পাননি। এক সপ্তাহ পর ফের শাহজালাল বিমানবন্দরে এলে কর্তৃপক্ষ এক মাস পর খোঁজ নিতে বলেন। নির্দিষ্ট সময় পর গেলে তিনি লাগেজটি বুঝে পান। কিন্তু সেটি হাতে নিয়েই বোকা বনে যান। কারণ, ইতোমধ্যে লাগেজটি কেটে ফেলা হয়েছে। ভেতরের মূল্যবান মালামালও খোয়া গেছে। পরে সেই কাটা লাগেজ নিয়েই গ্রামের বাড়ি কুমিল্লায় ফিরতে হয় তাকে।
সিঙ্গাপুর প্রবাসী আবিদুর রহিম সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটে ঢাকায় আসেন গত বছরের নভেম্বরে। তার সঙ্গে ছিল আটটি লাগেজ। চারটি লাগেজ তৎক্ষণাৎ পেয়ে গেলেও অন্যগুলো পাচ্ছিলেন না। যোগাযোগ করেন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে। কর্তৃপক্ষ জানায়, বিমানবন্দরেই আছে আপনার লাগেজগুলো। সাত দিন পর জানানো হবে। পরে ফোন পেয়ে আবিদুর রহিম আবার আসেন বিমানবন্দরে। কিন্তু লাগেজ আর ফেরত পাননি। লাগেজ কোথায় আছে তাও জানাতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। প্রায় বছর গড়ালেও লাগেজ খোয়া যাওয়ার সেই রহস্য আজো উদ্ঘাটিত হয়নি।
সাইদুল ও রহিমের মতোই শত শত যাত্রী প্রতিনিয়ত বিমানবন্দরে এরকম হয়রানির শিকার হচ্ছেন। সাধারণ যাত্রীদের পাশাপাশি ভিআইপিরা পর্যন্ত হয়রানির শিকার হয়েছেন। অথচ শাহজালাল বিমানবন্দরে বিদেশফেরত যাত্রীদের হাজার হাজার লাগেজ আটকা পড়ে আছে। আর যাত্রীরা তাদের লাগেজ খুঁজে খুঁজে হয়রান হচ্ছেন। দিনের পর দিন ধরনা দিয়েও হারানো লাগেজের দেখা মিলছে না।
জানা যায়, বছর দুয়েক আগে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের লাগেজও একবার পড়েছিল ওই চক্রের কবলে। অনেক দিন পর সেই লাগেজ উদ্ধার হলেও তাতে কিছুই ছিল না। তৎকালীন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামও হয়রানির শিকার হয়েছেন। তার লাগেজ হারানোর পর থানায় জিডি পর্যন্ত হয়েছিল। ওই ঘটনায় তখন ব্যাপক তোলপাড় হয়। সাবেক বিমানমন্ত্রী জি এম কাদেরের লাগেজও হারিয়ে গিয়েছিল। এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী কড়া হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। কিন্তু এরপরও হয়রানির অবসান হয়নি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন