দুই
তাদের জীবন-যাপন রীতি থেকে মনে হয়, তারা এ জীবনের পরে আরো একটি জীবনে বিশ্বাসী ছিল। অন্য দিকে গ্রিক জাতির স্থাপত্য শিল্পের দিকে তাকালে মনে হয়, তারা তা অতি সূ²ভাবে সুন্দর ও সুনিপুণভাবে তৈরি করেছে। কারণ তারা কেবল দুনিয়ার এ জীবনেই বিশ্বাসী ছিল। তাদের জীবনযাপন রীতিতে যুক্তির প্রখরতা ও বস্তবাদী দর্শনের প্রতিফলন হয়েছে। ‘‘ড. হামদি কোমাইস, আত্তাযাওয়াক আল ফান্নি ওয়া দাওরুল ফান্নান ওয়াল মুস্তামতে, আল-হাইয়্যাতুল ‘আম্মা লি শুয়ূনুল মাতাবে আল আছারিয়া, তা. বি., পৃ. ৬৭।’’
মোট কথা হলো, যে কোন জাতির স্থাপত্য শিল্পে তাদের ধর্ম বিশ্বাস ও ধর্মীয় দর্শনের প্রতিফলন ঘটে। তেমনিভাবে শিল্পীর ব্যক্তিগত অভিব্যক্তি ও চিন্তা ভাবনার প্রতিফলনও ঘটে। আর যে যুগে তা নির্মিত হয়েছে সে যুগের মন মানসিকতা চিন্তা-ভাবনাও তাতে সুষ্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়। তাই প্রত্যেক জাতি ও প্রত্যেক যুগের আলাদা বিশেষ স্থাপত্য শিল্প তৈরি হয়। তাতে তাদের চিন্তা দর্শন, ধর্মীয় বিশ্বাস ও অর্থনৈতিক ভাবনার প্রতিফলন ঘটে এবং তাদের জীবনবোধ ও সৌন্দর্যবোধ প্রতিভাত হয়।
স্থাপত্য শিল্প সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি ঃ স্থাপত্য শিল্প সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি ইতিবাচক; নেতিবাচক নয়। ইসলাম মুসলিমদেরকে স্থাপত্য শিল্প নির্মাণের অনুমোদন দেয়। তাতে শৈল্পিক ভাবনার প্রতিফলন ঘটানোর অনুমোদনও দেয়। বাড়ি-ঘর এবং অট্টালিকা কারুকার্যময় করার অনুমতিও দেয়। তবে তা সবই হতে হবে অহংকার প্রকাশ না করার ও বিলাসিতা প্রকাশ না করার শর্তে এবং অপব্যয় ব্যতিরেকে। আল কুরআন এবং মহানবীর হাদীসে এর প্রতি বার বার ইঙ্গিত করা হয়েছে। আল-কুরআনে ‘হুসূন’ ‘‘আল-কুরআন, ৫৯ : ২’’ বা কিল্লা, সায়াসি ‘‘আল-কুরআন, ৩৩ : ২৬’’ বা দুর্গ, বুরুজ ‘‘আল-কুরআন, ৮৫ : ১’’ বা উচ্চ অট্টালিকা ও দুর্গ, কুসূর ‘‘আল-কুরআন, ৭ : ৭৪’’ বা অট্টালিকা, গুরুফ, ‘‘আল-কুরআন, ২৫ : ৭৫’’ বা কক্ষ, জুদুর ‘‘আল-কুরআন, ৫৯ : ১৪’’ বা দেয়াল, র্সাহ ‘‘আল-কুরআন, ২৭ : ৪৪’’ বা প্রাসাদ, কুরা মুহাস্সানা ‘‘আল-কুরআন, ৫৯ : ১৪’’ বা ‘সুরক্ষিত জনপদ’ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার হয়েছে। ‘‘ড. হাসান আল বাশা, মাদখাল ইলাল আসার আল ইসলামিয়া, কাহেরা : দারুন নাহদা, ১৯৯৬ খ্রি., পৃ. ২১’’ যেমন এক আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলেন, তোমরা যেখানেই থাক না কেন মৃত্যু তোমাদের নাগাল পাবে, যদিও তোমরা সুদৃঢ় দুর্গে অবস্থান কর। ‘‘আল-কুরআন, ৪ : ৭৮’’।
অর্থাৎ তোমরা সৃদুঢ় উচ্চ দুর্গে অবস্থান করলেও তোমাদের মৃত্যু অবশ্যই আসবে। তোমরা মৃত্যু থেকে কিছুতেই রেহাই পাবে না, পালাতে পারবে না। এ আয়াত থেকে প্রমাণ হয়, সুদৃঢ় উচ্চ দুর্গ ও অট্টালিকা নির্মাণ করা ও তাতে বসবাস করা বৈধ।
আল্লাহ তা’আলা অপর এক আয়াতে বলেন, তাকে বলা হল, ‘প্রাসাদটিতে প্রবেশ কর’। অত:পর যখন সে তা দেখল, সে তাকে এক গভীর জলাশয় মনে করল এবং তার পায়ের নলাদ্বয় অনাবৃত করল। সুলাইমান বললেন, ‘এটি আসলে স্বচ্ছ কাঁচ-নির্মিত প্রাসাদ। ‘‘আল-কুরআন, ২৭ : ৪৪’’
এ আয়াতটিও প্রমাণ করে যে, অতি উচ্চমানের শিল্পসম্মত সুরম্য বাড়ি ও প্রাসাদ নির্মাণ করা বৈধ। কারণ সুলাইমান আ. একটি স্বচ্ছ কাঁচের উচ্চমানের শিল্পসম্মত প্রাসাদ নির্মান করে তার তলদেশ দিয়ে পানি প্রবাহিত করেন। তা এমন সুকৌশলে নির্মাণ করেন যে, যারা এর সম্পর্কে অবগত নয়, তারা মনে করে যে, তা পানি। অথচ পানি এবং পথচারীর মধ্যে স্বচ্ছ কাঁচের আবরণ রয়েছে। ফলে তার পায়ে পানি লাগার কোন সম্ভাবনা নেই। এ থেকে বুঝা যায় যে, সুলাইমান আ. নির্মিত এ প্রাসাদটিতে অতি উচ্চমানের শিল্প নৈপুণ্যের সমাবেশ ঘটেছিল। এ ঘটনা প্রমাণ করে যে, এ জাতীয় শিল্পমানের প্রাসাদ তৈরি করা এবং প্রাসাদকে কারুকার্যময় করা, তাতে বসবাস করা ইসলামে বৈধ।
আল্লাহ তা’আলা আরো বলেন, আর স্মরণ কর, যখন আদ জাতির পর তিনি তোমাদেরকে স্থলাভিষিক্ত করলেন এবং তোমাদেরকে যমীনে আবাস দিলেন। তোমরা তার সমতল ভূমিতে প্রাসাদ নির্মাণ করছ এবং পাহাড় কেটে বাড়ি বানাচ্ছ। সুতরাং তোমরা আল্লাহ্র নিয়ামত সমূহকে স্মরণ কর এবং যমীনে ফাসাদকারীরূপে ঘুরে বেড়িয়ো না। ‘‘আল-কুরআন, ৭ : ৭৪।’’
উপর্যুক্ত আয়াতে ‘‘তোমরা তার সমতল ভূমিতে প্রাসাদ নির্মাণ করছ এবং পাহাড় কেটে বাড়ি বানাচ্ছ’’ একথা বলার পর ‘‘সুতরাং তোমরা আল্লাহর নিয়ামতসমূহকে স্মরণ কর’’ এ কথা বলা থেকে বুঝা যায়, প্রাসাদ আল্লাহ তা’আলার একটি বড় নিয়ামত। প্রাসাদ তৈরি করা বৈধ না হলে তাকে আল্লাহর নিয়ামত হিসেবে উল্লেখ করা হতো না।
অনুরূপভাবে রাসূলুল্লাহ স. ও তাঁর হাদীসে মু’মিনদেরকে এমন একটি অট্টালিকার সাথে তুলনা করেছেন, যার একটি অংশ অপর অংশকে শক্তিশালী করে। তিনি বলেন, নিশ্চয় এক মু’মিন অপর মু’মিনের জন্য অট্টালিকা স্বরূপ; যার এক অংশ অপর অংশকে শক্তিশালী করে। ‘‘ইমাম বুখারী, আস-সহীহ, অধ্যায় : আল-মাসাজিদ, পরিচ্ছেদ : তাশবীকুল আসাাবি ‘ফিল মাসজিদ ওয়া গায়রিহী, বৈরূত : দারু ইবনি কাছীর, ১৪০৭ হি./ ১৯৮৭ খ্রি., হাদীস নং- ৪৬৭।’’
রাসূলুল্লাহ স. তিনি সহ সকল নবী-রাসূলকে একটি সুউচ্চ ও সুন্দর অট্টালিকার সাথে তুলনা করে বলেন, তারা বললো, এ প্রাসাদের নির্মাণ কৌশল কতোই না চমৎকার হতো, যদি তাতে এই ইটটি বসানো হতো! ‘‘ইমাম আহমাদ, আল-মুসনাদ, বৈরূত : মুয়াস্সাসাতুর রিসালাহ, ১৪২০ হি./ ১৯৯৯ খ্রি., খ. ১৫, পৃ. ১৯৪, হাদীস নং- ৯৩৩৭; হাদীসটির সনদ সহীহ।’’
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন