এ জগতে অর্থই সকল অনর্থের মূল, ব্যবসায়ীদের নগদ অর্থ নিয়ে কারবার, একটু অসৎ হলে নগদ টাকা হাতে এসে যায় এ অর্থের লোভ ত্যাগ করা অনেক কষ্টকর। তাই নবী (স.) বলেছেন- নিশ্চয় ব্যবসায়ীগণ পাপী হিসেবে কিয়ামত দিবসে উঠবে, কিন্তু যারা আল্লাহকে ভয় করেছে, সৎ ও সত্যবাদী হিসেবে ব্যবসা করেছে তারা ব্যতীত (তিরমিযী)। রমজান মাস আসে পরকালীন লাভের পাল্লা ভারী করতে। কিন্তু পরকাল বিমুখ, লোভী কিছু লোক রমজান মাসকে উপলক্ষ করে দুনিয়ার লাভের পাল্লা ভারী করার চেষ্টায় তৎপর হয়। পণ্য মজুদদারী, অতিরিক্ত মূল্যবৃদ্ধি করা, খাদ্যে ভেজাল দেয়া, মিথ্যা শপথ করে পণ্য বিক্রি, মধ্যসত্ত¡ ভোগী তৎপরতা ইত্যাদি এ সময় বৃদ্ধি পায়। ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা, ক্রয় বিক্রয় তথা ব্যবসা বাণিজ্য বিষয়ে রয়েছে ইসলামী বিধান। প্রথমে ব্যবসা সংক্রান্ত পবিত্র কুরআনের কিছু আয়াত পাঠকদের জন্য তুলে ধরছি- আল্লাহ পাক বলেন, “তোমরা ইনসাফ মোতাবেক যথাযথ ভাবে ওজন কর এবং ওজনে কম দিও না (সূরা রহমান, আয়াত- ০৯)। আফসোস সে সকল লোকদের জন্য যারা পরিমাপে দুর্নীতি করে, যারা মানুষের নিকট থেকে মেপে নিতে যথাযথভাবে নেয়। যখন মানুষকে মেপে দেয় তখন ওজনে কারচুপি করে। তারা কি মনে করে না যে, তারা পূনরুত্থিত হবে একটি মহান (কিয়ামত) দিবসে (সূরা মুতাফ্ফেফিন, আয়াত ১-৪)। তোমরা পরিমাপে ও ওজনে কম দিও না আমি তোমদেরকে ভালো অবস্থায় দেখতে পাচ্ছি এবং আমি তোমাদের জন্য আশংকা করছি বেষ্টনকারী আযাবের দিনের (সূরা- হুদ, আয়াত- ৮৪)। হে জাতি তোমরা পরিমাপ ও ওজন পরিপূর্ণ ভাবে ন্যায় সংগত ভাবে কর, মানুষকে তাদের জিনিসপত্র কম দিয়ে ক্ষতি গ্রস্থ কর না, পৃথিবীতে ফাসাদ ছড়িয়ে দিও না (সূরা- হুদ, আয়াত- ৮৫)। হে ঈমানদার গণ তোমরা অন্যায় ভাবে একে অপরের সম্পদ ভক্ষণ কর না। পরস্পর সম্মতিক্রমে ব্যবসা করবে স্বার্থের জন্য নিজেকে হত্যা কর না। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের প্রতি দয়াবান (সূরা নিসা, আয়াত -২৯)। তোমরা সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশ্রিত করো না এবং জেনে বুঝে সত্যকে গোপন করনা (সূরা- বাকারা, আয়াত- ৭২)। নবী (স.) এর অসংখ্য হাদিসে ক্রয় বিক্রয়ের নীতিমালা বর্ণিত রয়েছে। তন্মধ্যে কিছু অংশ পাঠকের জন্য তুলে ধরলাম- হযরত ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত একবার নবী (স.) বিক্রির জন্য রাখা এক স্তুপ (খেজুর) খাদ্যের পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলেন যে গুলো সুন্দর ভাবে সাজানো ছিল। নবী (স.) এর ভিতর হাত প্রবেশ করিয়ে দেখলেন ভেতরের গুলো ভিজা। নবী (স.) বিক্রেতাকে বললেন এরুপ কেন হল? বিক্রেতা বলল বৃষ্টি হয়েছিল তাই। তিনি বললেন- ভেজাগুলো উপরে রাখলেনা কেন? যেন মানুষ তা দেখতে পারে। যে ধোকা দেয় সে আমার উন্মত নয় (মুসলিম)। নবী (স.) বলেন- যে কোন ত্রæটি যুক্ত দ্রব্য ক্রেতার নিকট ত্রæটির বিষয়টি বর্ণনা না করে বিক্রি করবে সে আল্লাহর ক্রোধে নিমর্জিত থাকে। ফিরিস্তাগণ তার উপর লালন করতে থাকে (ইবনু মাজাহ)। নবী (স.) বলেন- তিন শ্রেণীর লোকদের সাথে কিয়ামত দিবসে আল্লাহ কথা বলবেন না, তাদের দিকে তাকাবেন না, তাদেরকে পবিত্র (ক্ষমা) করবেন না, তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি, আবু যর (রা.) বললেন- সে ক্ষতিগ্রস্থ শ্রেণী কারা? নবী (স.) বললেন- টাখনুর নিছে কাপড় পরিধানকারী পুরুষ, উপকার করে খোটা দানকারী, মিথ্যা শপথ করে পণ্য বিক্রয়কারী (মুসলিম)। নবী (স.) বলেন- তোমরা মিথ্যা শপথের মাধ্যমে ক্রয়-বিক্রয় হতে বিরত থাক কেননা তাতে বিক্রি (লাভ) বেশি হলেও তা বিনষ্ট হয় (মুসলিম)। আবু বকর (রা.) হতে বর্ণিত নবী (স.) গ্রামের লোকের পণ্য (তাদেরকে সরাসরি বিক্রির সুযোগ না দিয়ে) শহরে লোক কিনে (বিক্রি) করতে নিষেধ করেছেন (মুসলিম)। (এ হিসেবে শহরের বাহির থেকে কেহ মাল নিয়ে এলে বাধ্যতামূলক আড়তে উঠানো ঠিক নয়, কেননা আড়তে একবার দাম উঠবে, বেপারীরা নিয়ে আবার দাম উঠাবে এতে মূল্য বৃদ্ধি হয়, তাই গ্রামের লোকের ইচ্ছাধীন সে হয়ত খুচরা বাজারে বিক্রি করবে, ইচ্ছে করলে আড়তে বিক্রি করবে)। নবী (স.) বলেন- পাপী ব্যতিত আর কেহ (মূল্য বৃদ্ধির জন্য) মজুদদারী ব্যবসা করে না (মুসলিম)। নবী (স.) বলেন- তোমরা ওজনে কম দিও না। যখন ওজনে কম দেয়ার প্রচলন হবে তখন দুর্ভিক্ষ, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও নির্যাতন বৃদ্ধি পাবে (ইবনে মাজাহ)। নবী (স.) বলেন- যারা (মূল্যবৃদ্ধির উদ্দেশ্যে) খাদ্য মজুদ করবে দারিদ্র ও শে^ত রোগ তাদের মধ্যে চাপিয়ে দেওয়া হবে (ইবনে মাজাহ)। অপর বর্ণনায় আছে তাকে কিয়ামতের দিন আগুনের শলাকার মধ্যে নিক্ষেপ করা হবে। নবী (স.) বলেন- যে ব্যক্তি ৪০ দিন খাদ্য গুদামজাত রাখবে মানুষকে কষ্ট দিবে এ সম্পদ দান করে দিলে ও তার গুনাহ মাফের জন্য যথেষ্ট হবে না (মিশকাত)। নবী (স.) বলেন- গুদামজাতকারী কতই না নিকৃষ্ট আল্লাহ মূল্য কমিয়ে দিলে সে চিন্তায় পড়ে যায় আর বাড়িয়ে দিলে সে আনন্দিত হয় (শুয়াবুল ঈমান)। (যদি নিজের পরিবারের খাদ্যের প্রয়োজনে, নিজের উৎপাদিত খাদ্য অথবা মজুদ করলে বাজারের মূল্যবৃদ্ধিতে প্রভাব না পড়ে তবে ফিকাহ্বিদদের মতে, এ ধরণের গুদামজাত বৈধ)। নবী (স.) বলেছেন- সত্যবাদী বিশ^স্থ ব্যবসায়ী কিয়ামতের দিবসে নবীগণ, ছিদ্দিকগণ ও শহীদদের কাতারে অন্তর্ভুক্ত হবেন (তিরমিজি)। উল্লেখিত আয়াত ও হাদিসের আলোকে আমাদের ব্যবসায়িক জীবন পরিচালনা করা উচিৎ। দুনিয়ার অস্থায়ী জীবনের সামান্য সময়ের অর্থ সম্পদ লাভের তুলনায় পরকালের পাথেয় সংগ্রহকে বেশী গুরুত্ব প্রদান প্রত্যেক মোমিনের কর্তব্য। অতীত মনিষীগণ ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে কতুটুকু সতর্কতা অলম্বন করতেন তার কয়েকটি উদাহরণ দিচ্ছি- হযরত হাছান বিন সালেহ (রা.) একটি ক্রীতদাসী বিক্রির সময় ক্রেতাকে বললেন- এ দাসী থুথু ফেলতে থুথুর সাথে রক্ত ছিল এবং এটা তার জীবনে মাত্র একবার হয়েছিল। জীবনে একবার এরুপ হওয়ার বিষয়টি কোন দোষই নয়, এটা ক্রেতাকে না বললে ও চলত। বলাতে দাসীর মূল্য কমে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকার পর ও দোষ গোপন করার পাপের ভয়ে তিনি এ সামান্য ত্রæটিটুকু ও গোপন করেননি। একজন সৎ ব্যবসায়ী তার কর্মচারীকে দোকানে রেখে নামাজে গেলেন। মসজিদ থেকে বের হতে দেখলেন একজন বিদেশী ক্রেতা দুটি চাদর কিনে নিয়ে যাচ্ছে। (এ ধরণের চাদর সে এলাকায় উৎপাদিত হত) তিনি বুঝলেন এটি তার দোকানের মাল। তিনি ক্রেতাকে বললেন এ দুটি কত দিয়ে কিনেছেন? ক্রেতা যে মূল্য বলল তা প্রকৃত মূল্য থেকে অনেক বেশী। তিনি ক্রেতাকে বললেন আপনার নিকট এগুলোর মূল্য বেশী রাখা হয়েছে তা মনে হয়নি? ক্রেতা বলল- না, কারণ আমাদের দেশে এর মূল্য আরো বেশী। তখন তিনি ক্রেতাকে সাথে নিয়ে দোকানে গেলেন এবং বেশী মুনাফা করায় কর্মচারীকে ধমক দিলেন এবং অতিরিক্ত টাকা ফেরৎ দিলেন। হযরত ইমাম আবু হানিফা (র.) কাপড়ের ব্যবসা করতেন। একবার তিনি চাকরকে বললেন এখানে কাপড়ের যে বান্ডিল গুলো আছে তার একটি বাল্ডিলের একটি কাপড়ে একটু ত্রæটি আছে, ক্রেতাদের তা দেখিয়ে সে অনুপাতে মূল্য কম রেখে বিক্রি করবে। পাইকাররা এলে চাকর বিষয়টি ভুলে গিয়ে সকল বান্ডিল বিক্রি করে দিল। ইমাম আবু হানিফা (রা.) জানতে পেরে ঐ দিনের বিক্রিত সকল টাকা দরিদ্রদের মাঝে দান করে দিলেন। ওসমান (রা.) ব্যবসায়িক পণ্য নিয়ে সিরিয়া থেকে এলেন, মদিনায় তখন পণ্যের অভাব, তাই মূল্য বৃদ্ধি ছিল। পাইকাররা দ্বিগুণ দামে তা কিনতে চাইল, ওসমান (রা.) বললেন- আমি ১০ গুণ দামে হলে বিক্রি করব, ব্যবসায়ীরা বলল এত দামে কে কিনবে? ওসমান (রা.) বললেন- আল্লাহপাক বলেছেন- একের পরিবর্তে দশ গুণ। সুতরাং অভাবের সময় আমি সে সুযোগ নিব এ বলে তিনি সকল পণ্য গরীবদের মাঝে দান করে দিলেন। এভাবে অতীতের উদাহরণ দিলে অসংখ্য উদাহরণ দেয়া যাবে। বর্তমান সময়ে ও আল্লাহর অনেক নেক বান্দা দুনিয়ার লাভের সাথে পরকালের লাভকে প্রাধান্য দেন। আমার ছোট ভাই দীর্ঘ মেয়াদী কমিশন র্যাংক এর সামরিক কর্মকতা। চীন সরকারের বৃত্তি নিয়ে পিএইচডি করার জন্য বেইজিং ইউনিভার্সিটিতে গমনের সুযোগ পায়। সেখানে অবস্থান কালে সে একটি হোটেলের কথা বলল, রমজান মাস এলে ইফতার ও সেহরীতে যে যা খাবে হোটেল মালিক ফ্রি খাওয়ায়। মালিক বলে ১২ মাসের মধ্যে ১১ মাস দুনিয়ার লাভ করলাম ১ মাস পরকালের লাভ করব। আমার জানা মতে, কুমিল্লা শহরে দুটি হোটেল রয়েছে যার মালিক পুরো রমজান মাস হোটেল বন্ধ রাখেন, তবে কর্মচারীদের অগ্রিম বেতন বোনাস দিয়ে দেন। এর মধ্যে একজন এমন আছেন তিনি কর্মচারীদের বলেন- আমার কাজ করার বিনিময়ে আমি বেতন দেই, কিন্তু রমজানে আমি আমার কাজ না করিয়ে বেতন বোনাস দিচ্ছি, আমার কাজের পরিবর্তে এ মাসে প্রভুর কাজের (ইবাদতের) প্রতি বেশী গুরুত্ব দিবে। আমার জানামতে, এ হোটেলের মালিক ব্যবসায়িক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন না আল্লাহ উনাকে তৃপ্ত ও সচ্ছল অবস্থায় রেখেছেন, ব্যবসায়ে বরকত দিয়েছেন। মুসলিম দেশ সমুহের মধ্যে সৌদী আরব, ইরান, ইন্দোনেশিয়া, মালেয়শিয়া, সহ বেশ কিছু মুসলিম দেশে রমজানে ব্যবসায়ীরা লাভের পরিমাণ কমিয়ে দেয়, ফলে রমজানে দ্রব্যমূল্য কম থাকে। যে পরিবারের স্বচ্ছলতার জন্য আমরা অসৎ ভাবে ব্যবসা পরিচালনা করছি। পরিবারের কোন সদস্য কি আমার পাপের দায়ভার নিবে? অসৎ ব্যবসায়ের মাধ্যমে সম্পদের যে পাহাড় গড়ছি সে সম্পদ মৃত্যুর সময় আমার সংগী হবে বা আমার আদৌ কোন উপকারে আসবে? ফরমালিন বা কেমিক্যাল ব্যবহারে মানুষ মারাত্মক অসুস্থ হয়ে কষ্ট পেলে বা মৃত্যুবরণ করলে ফরমালিন, কেমিক্যাল মিশ্রণ কারী হত্যাকারী হিসেবে অপরাধী হবে। আল্লাহ পাক আমাদেরকে ইসলামী নির্দেশনা মেনে সততার সাথে ব্যবসা করার তৌফিক দিন। অসৎ ব্যবসায়ের মহাপাপে পাপী হওয়া থেকে রক্ষা করুন- আমিন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন