নোয়াখালীর দক্ষিণাঞ্চলীয় মেঘনার বুকে স্বর্ণদ্বীপ, নিঝুমদ্বীপ ও ভাসানচরে প্রাকৃতিক অপরূপ সমাহার। নিঝুমদ্বীপে হরিণের পাল, কোম্পানীগঞ্জে মুছাপুর রেগুলেটর, ফেনীর সোনাগাজীতে মুহুরী প্রজেক্ট, দেশের প্রথম বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্র, আঞ্চলিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, হাঁস প্রজনন খামার, পরশুরামের রাবার বাগান, লক্ষীপুরের রায়পুর নারিকেল-সুপারির জন্য বিখ্যাত, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র, চরবংশী সুইসসহ নয়াভিরাম দৃশ্য, দই ও ইলিশের জন্য বিখ্যাত লক্ষীপুরের রামগতি পর্যটনে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
এক কথায় বৃহত্তর নোয়াখালীর সম্ভাবনাময় বিভিন্ন খাতকে সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে কাজে লাগাতে পারলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। নোয়াখালী, ফেনী ও লক্ষীপুর জেলার উপকূল ও দ্বীপাঞ্চলে শত শত হেক্টর নতুন চরে বনায়ন অব্যাহত রয়েছে। দেশের মহামূল্যবান সম্পদ ‘সুন্দরবন’ হুমকির সম্মুখীন। সেক্ষেত্রে বৃহত্তর নোয়াখালীর উপকূল ও দ্বীপাঞ্চলে সবুজ বেষ্টনীর মাধ্যমে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার প্রয়াস চলছে।
নোয়াখালীর উপকূলীয় ও দ্বীপাঞ্চল পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। প্রতি বছর দেশ-বিদেশের প্রায় ৪-৫ লাখ পর্যটক এখানে ভ্রমণ করেন। এর মধ্যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত ‘নিঝুমদ্বীপ’ দেশের সীমানা পেরিয়ে বিদেশি পর্যটকদের কাছেও অতি সুপরিচিত। এক সময় যোগাযোগ ব্যবস্থা অপ্রতুল থাকলেও এখন দৃশ্যপট পাল্টেছে। নোয়াখালী জেলা সদরের ৫৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে উত্তাল মেঘনা তীরে গড়ে উঠেছে সেনাবাহিনীর বৃহদাকারের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ‘স্বর্ণদ্বীপ’।
বনদস্যু বাহিনীর সদর দপ্তর হিসেবে পরিচিত ‘জাহাইজ্যার চর’ দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর হাতের ছোঁয়ায় এখন সবুজঘেরা নয়নাভিরাম স্বর্ণদ্বীপ। স্বর্ণদ্বীপকে ঘিরে এ অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটছে। স্বর্ণদ্বীপ থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার দক্ষিণে মেঘনার বুকে চোখে পড়বে প্রকৃতির আরেক বিস্ময় ভাসানচর। রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে ব্যাপকভাবে সজ্জিত করা হয়েছে ভাসানচরকে।
নোয়াখালীর উপকূলীয় ও দ্বীপাঞ্চলের অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন সম্ভব। ২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রী নোয়াখালী সফরকালে দক্ষিণাঞ্চলে একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার ঘোষণা সত্তে¡ও কতিপয় মামলাবাজের কারণে উদ্যোগটি স্থবির রয়েছে। নিঝুমদ্বীপ ছাড়াও জেলার দক্ষিণাঞ্চলে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার সুবাদে পর্যটন শিল্প বিকাশের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। নোয়াখালীর দক্ষিণাঞ্চলে একটি বিমানবন্দর স্থাপনের চিন্তাভাবনা চলছে। জেলা শহরের দক্ষিণে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় অবস্থিত। তেমনিভাবে মেঘনা উপকূলবর্তী সূবর্ণচরে একটি ‘কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়’ স্থাপন সময়ের দাবি।
উল্লেখ্য, ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ১২শ’ একর জমির ওপর স্থাপিত। এ ছাড়া সেখানে ৩শ’ একর ভূমিতে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট রয়েছে। অপরদিকে মেঘনা তীরবর্তী নোয়াখালীর দক্ষিণাঞ্চলে সরকারের হাজার হাজার একর খাস ভূমি রয়েছে। উপরন্তু কৃষি, মৎস্য ও পর্যটনের জন্য এতদঞ্চলের বিশেষ সুখ্যাতি রয়েছে। তাই নোয়াখালীর দক্ষিণাঞ্চলে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হলে কৃষি, মৎস্য, ফলদ, বনজ খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটবে।
নোয়াখালীর দক্ষিণাঞ্চলের বিশাল মেঘনাকে মৎস্যভান্ডার বলা হয়। ইলিশ মৌসুমে গভীর সাগরে প্রতিদিন কয়েক হাজার ট্রলার মৎস্য আহরণ করে। এছাড়া বছরের অন্যান্য মৌসুমে মেঘনা নদী ও সাগরে শত শত নৌকা-ট্রলার ছুটতে দেখা যায়। সাগরে একটানা ১০-১৫ দিন অবস্থান করে এসব ট্রলার। এ সময় পর্যাপ্ত বরফ না থাকায় বিপুল পরিমাণ মাছে পচন ধরে। তখন জেলেরা বাধ্য হয়ে লাখ লাখ টাকার মাছ সাগরে ফেলে দেয়। এছাড়া বরফ সঙ্কট, বৈরী আবহাওয়া, যোগাযোগ সমস্যা ও মাছ প্রক্রিয়াজাত কারখানার অভাবে প্রতি বছর শত শত কোটি টাকার মাছ নষ্ট হচ্ছে। তাই এখানে মাছ প্রক্রিয়াজাত কারখানার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এতে করে স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও কোটি কোটি টাকার মাছ রফতানি সম্ভব হবে।
নিঝুমদ্বীপে বর্তমানে ৩৫-৪০ হাজার হরিণ রয়েছে বলে জানালেন নোয়াখালীর ডিএফও। এর মধ্যে খাদ্য ও অপুষ্টিতে প্রতি বছর কয়েক হাজার হরিণ মারা যাচ্ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিশেষ করে ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের সময় অসংখ্য হরিণ জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে।
এছাড়া একশ্রেণির শিকারি ও চোরাচালানির কবলে পড়ে প্রতি বছর হাজার হাজার হরিণ সাবাড় হচ্ছে। নিঝুমদ্বীপ থেকে কিছু হরিণ দেশের বিভিন্ন বনাঞ্চলে স্থানান্তরের লক্ষ্যে কয়েক বছর পূর্বে নোয়াখালীর বিভাগীয় বন কর্মকর্তা প্রধান বন সংরক্ষক কার্যালয়ে একটি চিঠি প্রেরণ করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলেও সত্য যে, প্রধান বন সংরক্ষক কার্যালয় উক্ত চিঠির গুরুত্ব অনুধাবন করতে না পারায় কাজের কাজ কিছুই হয়নি। অথচ নিঝুমদ্বীপের হাজার হাজার হরিণকে বাণিজ্যিকভাবে বিবেচনা করলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতো।
ফেনীর সোনাগাজী মুহুরী প্রজেক্ট ও নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ মুছাপুর রেগুলেটর এলাকায় পর্যটকদের ভিড় লক্ষণীয়। তেমনিভাবে সোনাগাজীতে দেশের প্রথম বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে। ফেনীর সোনাগাজী এবং চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড ও মিরের সরাইয়ের তিনটি উপজেলার ত্রিশ হাজার একর ভ‚মিতে গড়ে উঠছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর। শতভাগ রফতানিমুখী এই বিশাল শিল্প নগরীতে লক্ষাধিক লোকের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি ভবিষ্যতে এর পরিধি বৃদ্ধি করা হবে। শিল্পনগরীটির প্রায় ৫৫ শতাংশ ভূমি সোনাগাজী অংশের বলে জানা গেছে।
আগামী পাঁচ বছরে এখানকার চিত্র পাল্টে যাবে- এমন আশা এলাকার মানুষের। ফেনীর পরশুরাম মুহুরীর চরে বর্তমানে চাষাবাদে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)-এর বাধার মুখে এখানে উন্নয়নমূলক কোনো কাজ হচ্ছে না।
লক্ষীপুরের রায়পুরকে বলা হয় দেশের নারিকেল সুপারির ভান্ডার। প্রতি মৌসুমে শত শত কোটি টাকার নারিকেল সুপারি বিক্রি হয়। এ দু’টি পণ্যকে কেন্দ্র করে রায়পুরে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ব্যবসা-বাণিজ্য কেন্দ্র ও কুটির শিল্প। রায়পুরে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃহৎ মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র রয়েছে। প্রতিদিন শত শত পর্যটক রায়পুর ভ্রমণ করেন। রায়পুরে শিল্পকারখানা স্থাপনের পরিবেশ রয়েছে।
এখানকার বেশ কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান দেশ-বিদেশে পরিচিত। সেই সুবাদে যোগাযোগ ক্ষেত্রে ভালো অবস্থানে রয়েছে রায়পুর উপজেলা। রায়পুরের রাখালিয়ায় শতভাগ রফতানিমুখী একটি জুতা কারখানা রয়েছে। লক্ষীপুরের রামগতি উপজেলা নদীভাঙনে হুমকির সম্মুখীন। আশার কথা, দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে রামগতির কয়েকটি স্থানে ভাঙন রোধে কাজ চলছে। এতে সুফল পেতে শুরু করেছে এলাকাবাসী। অপরদিকে ভাঙনরোধ এলাকায় পর্যটকদের ব্যস্ততা লক্ষণীয়। এখানকার দই ও ইলিশের খ্যাতি রয়েছে দেশে-বিদেশে।
বৃহত্তর নোয়াখালীতে জন্মগ্রহণকারী শত শত শিল্পপতি দেশ-বিদেশে প্রতিষ্ঠিত। সে তুলনায় অপার সম্ভাবনাময় নিজ জন্মস্থানে শিল্পায়নের লক্ষ্যে এসব শিল্পপতি তেমন কিছুই করছেন না। সাবেক পাকিস্তান আমলে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের চৌমুহনীতে বেসরকারি উদ্যোগে দেশের বৃহৎ পাটকল প্রতিষ্ঠা করেন আলহাজ আবদুর রব। এছাড়া রায়পুরে ব্যক্তিগত উদ্যোগে শতভাগ রফতানিমুখী জুতা কারখানা, নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে গ্লোব শিল্প গোষ্ঠীর বেশ কয়েকটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান, বেগমগঞ্জের বিসিক শিল্পনগরী ও চৌমুহনীতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বেশ কয়েকটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে।
এছাড়া ফেনীর দাগনভূঁইয়ায় একটি বৃহদাকারের কটন মিল এবং ফেনী জেলা সদরে হাতেগোনা দু-চারটি মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠান ব্যতীত বৃহত্তর নোয়াখালীতে তেমন শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। অথচ বৃহত্তর নোয়াখালীর শিল্পপতিরা নিজ নিজ এলাকায় মাঝারি আকারের একটি করে শিল্পকারখানা স্থাপন করলে বৃহত্তর নোয়াখালীতে রাতারাতি বেকারত্ব দূর হওয়ার পাশাপাশি অন্যান্য জেলার লোকজনের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। কিন্তু প্রদীপের নিচে অন্ধকারের মতো এখানকার অবস্থা।
সড়ক যোগাযোগে নোয়াখালীর সোনাপুর ফেনীর সোনাগাজী ও চট্টগ্রামের জোরালগঞ্জের মধ্যে সেতুবন্ধন হতে যাচ্ছে। সোনাপুর-জোরালগঞ্জ সড়কটি আগামী বছর চালু হলে মাত্র দেড় ঘণ্টায় বন্দরনগরীর সাথে সড়ক যোগাযোগ সম্ভব হবে। এতে করে এতদঞ্চলে উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী সহজে বন্দরনগরীতে পরিবহন ছাড়াও পর্যটন শিল্পে দারুণ প্রভাব ফেলবে।
অপরদিকে কুমিল্লার টমছম ব্রিজ থেকে নোয়াখালীর সোনাপুর জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে ফোরলেন সড়কের কাজ চলছে। ২০২১ সালের মধ্যে এটি সম্পন্ন হলে দেশের পশ্চিম ও উত্তরাঞ্চলের সাথে এ অঞ্চলের যোগাযোগ আরো নিরাপদ ও সহজতর হবে। নোয়াখালীর সোনাপুর থেকে সুবর্ণচর উপজেলার চরমজিদ স্টিমার ঘাট এবং হাতিয়ার চেয়ারম্যান ঘাট পর্যন্ত দুই পর্যায়ে সড়ক উন্নয়ন কাজ শুরু হবে। এক কথায় দেশের যে কোনো প্রান্ত থেকে বৃহত্তর নোয়াখালীর শেষপ্রান্ত পর্যন্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা আরো সহজতর হচ্ছে। এতে করে শিল্পায়ন ও পর্যটন শিল্পে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের অপার সম্ভাবনা রয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন