রাজধানীসহ সারাদেশে অস্বাভাবিকহারে বেড়ে চলেছে দুই চাকার বাহন ‘মোটরসাইকেল’। ঢাকার রাস্তায় কয়েকবছর আগেও মোটরসাইকেল অনেক কম দেখা গেলেও এখন এই বাহনটির একচোটিয়া রাজত্ব চলছে। অদক্ষ ও মাদকাসক্তরা কোন রকমে কাগজপত্র নিয়ে নেমে পড়ছে রাস্তায়। এতে সড়কের ঝুঁকি ও বিপদ বেড়েছে বহুগুণ। এছাড়া একদিকে গণপরিবহেন নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা, অন্যদিকে রাইড শেয়ারিং সেবার কারণে রাস্তায় মোটরসাইকেলের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। এর বাইরে অনেকে ঝামেলা এড়াতে মোটরসাইকেল বেছে নিলেও বাস্তবে এ বাহনটির কারণে ঢাকার রাস্তায় যানজট আর নাগরিক যন্ত্রণা কয়েকগুণ বেড়ে গেছে।
এদিকে, ঢাকার রাস্তায় মোটরসাইকেলের অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কারণে চালকদের মনোভাবও বেপরোয়া আকার ধারণ করেছে। তারা অন্যান্য যানবাহনকে পরোয়া না করে বেপরোয়া গতিতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ঢাকার রাজপথ। যার কারণে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটেই চলেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, রাইড শেয়ারিং কোম্পানিগুলোকে নিয়ন্ত্রণের জন্য যথাযথ নীতিমালা কার্যকর না হওয়ায় এবং বিআরটিএ’র এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় অদক্ষ লোকেরাও মোটরসাইকেল নিয়ে নেমে পড়েছে রাস্তায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এভাবে অস্বাভাবিকহারে মোটরসাইকেল বেড়ে গেলে কয়েক বছরের মধ্যে ঢাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থবির হয়ে যন্ত্রণার নগরীতে পরিণহত হবে ঢাকা। তারা গণপরিবহনের নৈরাজ্য দূর করে শৃঙ্খলা ফেরানোর ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
বিআরটিএ সূত্র জানায়, ঢাকাসহ সারাদেশে বর্তমানে ২৭ লাখ মোটরসাইকেল চলছে। এর মধ্যে খোদ রাজধানীতেই এ সংখ্যা ৭ লাখ। এসব মোটরসাইকেলের সবই বিআরটিএ থেকে রেজিস্ট্রেশন নিয়ে রাস্তায় চলছে। এর বাইরে রেজিস্ট্রেশন ছাড়া ঢাকার বাইরে আরো লক্ষাধিক মোটরসাইকেল চলাচল করছে। গত ৫ সেপ্টেম্বর জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের সভায় বিআরটিএ অস্বাভাবিকহারে মোটরসাইকেল বাড়ার এ তথ্য প্রকাশ করে।
বিআরটিএ সূত্র জানায়, চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত বিআরটিএ থেকে মোটরসাইকেল নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে ৬২ হাজার। আর সারা দেশে এ পর্যন্ত নিবন্ধন নেওয়া হয়েছে ২ লাখ ৪৯ হাজার ৯৫০টি মোটরসাইকেল।
মোটরসাইকেল এভাবে বাড়ার বিষয়ে বিআরটিএ জানায়, ঢাকায় ২০১৫ সাল থেকে বিআরটিএ-তে মোটরসাইকেল নিবন্ধন নেওয়ার সংখ্যা বেড়ে যায়। যেখানে আগে সারা বছরে মোটরসাইকেল নিবন্ধন নেওয়ার সংখ্যা ছিল ৩০ হাজারের মতো সেখানে ২০১৬ সালে নিবন্ধন নেয় অর্ধলক্ষাধিক মোটরসাইকেল। এ সংখ্যা ২০১৭ সালে হয় ৭৫ হাজার। ২০১৮ সালে তা ১ লাখ ছাড়িয়ে যায়।
বিআরটিএ’র হিসেবে জানা যায়, এখন রাজধানীতে বৈধ মোটরসাইকেলের সংখ্যা ৭ লাখ। রাইড শেয়ারিং সেবা চালুর পর নতুন করে তিন লাখ মোটরসাইকেল বেড়েছে। বাড়তে থাকা এ সংখ্যা এখনও অব্যাহত রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একদিকে অচেনা, অদক্ষ ও মাদকাসক্ত চালক, অন্যদিকে বেশি ইনকামের লোভে অনেকে রাইড শেয়ারিংয়ে যোগ দেওয়ায় রাজধানীতে অস্বাভাবিকহারে বেড়ে গেছে মোটরসাইকেল। কোন রকম নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করেই নগরীর রাস্তা দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে এসব বাইন। প্রধান সড়ক ও অলিগলির মতো ফ্লাইওভার ও ফুটপাথ দখল করেও চলে তাদের বেপরোয়া আধিপত্য। এতে জনভোগান্তি ছাড়াও নিয়মিতভাবে মারাত্মক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটে চলছে। এর বাইরে এত বিপুল পরিমাণ বাইকের ভারে ঢাকার স্বাভাবিক গতি বাধাগ্রস্ত হয়ে তীব্র জানজটের নগরীতে পরিণত হয়েছে রাজধানী।
এ বিষয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, মোটরসাইকেল এখন মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে কোনো কিছুই ধ্বংস না করে তাকে একটি নীতিমালার মধ্যে আনতে হবে।
বিআরটিএ’র তথ্যেমতে, ২০১১ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) নিবন্ধন নিয়ে ঢাকায় মোটরবাইক নেমেছে প্রায় দুই লাখ ২৭ হাজার। অর্থাৎ গড়ে প্রতিদিন বাইক নামে ১০৩টি করে। অথচ ২০১৭ সাল থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত আড়াই বছরে ঢাকায় বাইক নেমেছে প্রায় দুই লাখ ৩০ হাজার। এতে গত আড়াই বছরে গড়ে প্রতিদিন বাইক নেমেছে ২৫২টি করে। যার কারণে ঢাকা জানজট আর বেপরোয়া মোটরসাইকেলের নগরীতে পরিণত হয়েছে। বিআরটিএ’র নতুন নিয়মে ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া মোটরসাইকেল কিনতে না পারার নিয়ম থাকলেও একশ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী ও দালালদের যোগসাজসের কারণে অনেকে কিনতে সক্ষম হচ্ছে।
বর্তমানে ঢাকায় উবার, পাঠাও, ওভাই, স্যাম, চলো, ইজিয়ার, আমার বাইক, সহজ রাইডার্স, বাহন, আমার রাইড, ঢাকা রাইডার্স, ঢাকা মটোসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান মোটরসাইকেলে রাইড শেয়ারের সুবিধা দিচ্ছে। এসব কোম্পানির বেশ কয়েকটি বিআরটিএ থেকে রাইড শেয়ারিং নীতিমালার আলোকে নিবন্ধন দেওয়া হলেও তারা তাদের মোটরসাইকেল সংখ্যার তথ্য জমা দেয়নি বিআরটিএ’তে। এমনকি বিআরটিএর নীতিমালা অনুযায়ী মোটরসাইকেল কোম্পানিগুলোর প্রযুক্তিগত তথ্য বিআরটিএ-তে জমা দেওয়ার কথা থাকলেও সেগুলো দেয়নি কোম্পানিগুলো। যার কারণে অ্যাপসভিত্তিক রাইড শেয়ারিং কোম্পানিগুলোর অধীন কি পরিমাণ মোটরসাইকেল চলছে তার সঠিক তথ্য অজানা থেকে যাচ্ছে।
এদিকে, ঢাকায় বাইকের সংখ্যা বাড়ার পাশাপাশি মোটরসাইকেলে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি বেড়ে গেছে অনেক। বাংলাদেশ অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, ২০১৭ সালে ঢাকায় বাইক দুর্ঘটনা ঘটে ৪৮টি। এতে ৫৩ জন নিহত ও ১৯ জন আহত হন। আর ২০১৮ সালে ঢাকায় বাইক দুর্ঘটনা ঘটে ৬৯টি। এতে আগের হতাহত ৩০ শতাংশ বেড়ে যায়। ঢাকায় বাইকের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার জন্য রাইড শেয়ারিং সার্ভিসের নীতিমালার দুর্বলতার পাশপাশি কর্মস্থানের সঙ্কটকে দায়ী করেছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর পরিকল্পনা বিভাগের (বুয়েট) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোসলেহ উদ্দিন বলেন, ২০১৭ সালে রিভাইস স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যান (আরএসটিপি) অনুযায়ি মোটরসাইকেল ঢাকার জন্য সমাধান নয়, এটা সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াবে বলা হয়েছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, অন্যকোন উপায় না পেয়েই হয়তো অনেকে মোটরসাইকেলের দিকে ঝুঁকছে। তবে এটা কোনো সমাধান নয়। একটি শহরে কতগুলো মোটরসাইকেল চলার অনুমতি দেওয়া উচিত- কর্তৃপক্ষের সেটি ভাবার সময় হয়েছে।
এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার মফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, রাজধানীর সড়কগুলোতে মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণে ঢাকার বাইরে থেকে আসা সব বাইক ঢাকায় নিষিদ্ধ করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে বিআরটিএর সঙ্গে আলোচনা ও পরামর্শ করা সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এছাড়া রাইড শেয়ারিং কোম্পানিগুলো যথাযথ নীতিমালার আওতায় থেকে সেবা দিলে মোটরসাইকেলের সঠিক সংখ্যার হিসাব থাকবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন