শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

পর্যটক আকর্ষণে নেই বিপনন ব্যবস্থা

হ যুব সম্প্রদায় বাংলাদেশে আসছে না হ সঠিক পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনাকে দায়ী করলেন বিশেষজ্ঞরা

হাসান সোহেল | প্রকাশের সময় : ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ১২:০১ এএম

নানা প্রতিকূলতা সামনে ঠেলে এগিয়ে যাচ্ছে দেশের পর্যটন খাত। মানুষের আর্থিক সামর্থ্য বাড়ায় গত কয়েক বছরে দেশের অভ্যন্তরীণ পর্যটন খাত অনেকটাই স¤প্রসারিত হয়েছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ থেকে বিদেশে ঘুরতে যাওয়ার প্রবণতাও বেড়েছে। তবে একই সময়ে নানা প্রতিকূলতায় বিদেশ থেকে দেশে আসা পর্যটকের সংখ্যা সে হারে বাড়নি। যদিও পর্যটনকে শিল্প হিসেবে ঘোষণার দুই যুগ পেরিয়েছে অনেক আগেই। অথচ দেশে প্রতিবছর কতজন বিদেশি পর্যটক আসছে, সে পরিসংখ্যানও নেই। ইমিগ্রেশন বিভাগসহ পর্যটন সংশ্লিষ্ট কেউই এ তথ্য দিতে পারেনি।

বাংলাদেশকে পর্যটন শিল্পের অন্যতম সম্ভাবনাময় হিসেবে দেখলেও নানা প্রতিবন্ধকতায় এই শিল্প আটকে পড়েছে। সূত্র মতে, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতা রয়েছে। পাশাপাশি সরকারিভাবে বিদ্যমান সমস্যাগুলো কাটাতে জোড়ালো কোনো উদ্যোগ নেই। আর তাই পর্যটকদের কাছে গুরুত্ব হারাচ্ছে দেশের পর্যটন স্পটগুলো। পর্যটন খাতে আইন কাঠামো, অনুন্নত অবকাঠামো, যোগাযোগ ব্যবস্থা, সমন্বিত পরিকল্পনা, পর্যটন বিষয়ক গবেষণা, প্রশিক্ষণ, নিরাপত্তা, ভিসা জটিলতা, আকর্ষণীয় পর্যটন স্থান উন্নয়নে ব্যবস্থাপনা ও মনিটরিংয়ের অভাব, পর্যটনপণ্য বিপণনে পেশাদারিত্বের অভাব, পর্যটন এলাকা শনাক্তকরণ, বিদেশী মিশনগুলোতে প্রচারের অভাব ও সৃজনশীলতা প্রয়োগের অভাব রয়েছে। আর এসব কারনে বিদেশী পর্যটকদের কাছে বাংলাদেশের অপরুপ সৌন্দর্য্য সঠিকভাবে তুলে ধরা সম্ভব হচ্ছে না।

বিদেশী পর্যটক বৃদ্ধি না পাওয়ার কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা দায়ী করছেন সঠিক পরিকল্পনা ও মার্কেটিং ব্যবস্থাপনাকে। তাদের মতে, বর্তমান বিশ্বে মার্কেটিং একটি নতুন ধারণা। পরিকল্পিত মার্কেটিং করে পার্শ্ববর্তী নেপাল, ভারত, শ্রীলংকা, ভুটান, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশ পর্যটনে ব্যাপক উন্নতি করলেও বাংলাদেশ তাদের তুলনায় অনেকটাই পিছিয়ে। তাই বাংলাদেশি পণ্যসমূহ মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বিপণন করা গেলে পর্যটনে চলমান দুরাবস্থা থাকবে না। বাংলাদেশি পর্যটন পণ্যগুলোর অধিকতর প্রচার করতে পারলে দেশে বিদেশী পর্যটকের সংখ্যাও বাড়বে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ, যারা ট্রাভেল এ্যাডভাইসরি বা ট্যুরিজম সোর্স মাকেটিং করে ওই সব দেশগুলো বাংলাদেশকে ভালো অবস্থানে রাখছে না। তাই ওই সব দেশের ঢাকায় অবস্থানরত এ্যাম্বাসি ও হাইকমিশনকে এ বিষয়ে বোঝানো। ট্যুরিজমে বাংলাদেশের অর্জন এবং বর্তমানে বাংলাদেশের অবস্থান আগের অবস্থায় যে নেই তা তুলে ধরা। পাশাপাশি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে থাকা বাংলাদেশের এ্যাম্বাসিগুলোকেও ওই দেশের ট্যুর অপারেটর বা পর্যটন সংশ্লিষ্টদেরকে এ দেশ সম্পর্কে সচেতনতা, সর্বশেষ অবস্থান এবং বিদেশী পর্যটকরা বাংলাদেশে এসে স্বাভাবিক পরিবেশ পাচ্ছেন তা তুলে ধরার কথা বলেছেন।

বেসরকারি বিমান, পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, মালয়েশিয়া পর্যটন দিক থেকে অনেক এগিয়ে গেছে। সিঙ্গাপুর একইভাবে এগিয়েছে। পর্যটন শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করতে বিশ্বের প্রায় অর্ধশত দেশের ভ্রমণপ্রেমীদের এক মাসের ফ্রি ভিসা অন অ্যারাইভাল সুবিধাও দেয় শ্রীলঙ্কা। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বক্তব্যের বেশির ভাগই পর্যটন শিল্পের কথা। ভারতও এক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে গেছে। এখন বাংলাদেশের সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে এ বিষয়ে জোর দিলে বিদ্যমান সমস্যা কাটবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

পর্যটনের ব্রান্ডিং বিষয়ে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন দেশে বছরব্যাপি পর্যটন মেলায় অংশগ্রহণ করছে বাংলাদেশ। পাশাপাশি ওই দেশের ট্যুর অপারেটরদের সাথে সম্পর্ক বাড়াচ্ছে। এছাড়া ফেসবুক, টুইটার, ইনস্ট্রগ্রামসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের পর্যটনকে মার্কেটিং করা হচ্ছে। এছাড়া বাংলাদেশে বেশি পর্যটক আসার সুযোগ রয়েছে ভারত এবং চীনের। তাই প্যাসিফিক এশিয়া ট্রাভেল এসোসিয়েশন (পাটা) বাংলাদেশ চ্যাপ্টার এবং ট্যুরিজম বোর্ড আগামী অক্টোবরের ১৬ থেকে ১৭ তারিখ রোড শো’ আয়োজন করছে। এছাড়া চীনের পর্যটকদের উদ্বুদ্ধ করেত উই চ্যাটের মাধ্যমে বাংলাদেশের দর্শনীয় স্থানের প্রচারণার পরিকল্পনা আছে।

সূত্র মতে, পর্যটনের দুটি দিক। একটি অভ্যন্তরীণ পর্যটন, অন্যটি বিদেশ থেকে যারা এ দেশে ঘুরতে আসেন। সব দেশেই অভ্যন্তরীণ পর্যটন আগে গড়ে ওঠে, বাংলাদেশেও তাই হয়েছে। দেশের ভেতরে বিভিন্ন জায়গায় লোক গেলে সেগুলো পরিচিত হয়ে উঠবে, দেশের বাইরে থেকে মানুষ সেখানে আসবে। অভ্যন্তরীণ পর্যটনে বাংলাদেশ ভালো উন্নতি করেছে। বছরে অন্ততপক্ষে এখন ৬০ থেকে ৭০ লাখ মানুষ দেশের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে ঘুরে বেড়ায়। শুধু কক্সবাজারেই যায় প্রায় ২০ লাখ লোক। অপরদিকে বিদেশী পর্যটক আকর্ষণে বাংলাদেশের নেই কোন প্রচারণা। দেশের দর্শনীয় স্থানগুলোকে সঠিকভাবে তুলে ধরা হচ্ছে না বিদেশীদের কাছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশে আসা বিদেশী পর্যটকদের দিক নির্দেশনা দেওয়ার মত দক্ষ জনবলেরও অভাব রয়েছে। এদিকে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করলেও পর্যটনে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে। তারপরও বাংলাদেশে পর্যটনে যা অর্জন তা মূলত বেসরকারি উদ্যোগেই হয়েছে।

ট্যুরিজম ও হসপিটালিটি কনসালট্যান্স হাবিব সুমন বলেন, ট্যুরিজম আমাদের জন্য অপার সম্ভাবনার খাত। অভ্যন্তরীণ পর্যটনে বাংলাদেশ ভালো উন্নতি করেছে। বাংলাদেশের ব্যর্থতার জায়গাটা হচ্ছে বিদেশি পর্যটক সে হারে বাড়ছে না। আমরা আন্তর্জাতিকভাবে ট্যুরিজম সেক্টরে বিভিন্নভাবে পিছিয়ে আছি। এক্ষেত্রে তিনি ট্যুরিজমের যে সব অবকাঠামো রয়েছে সেটাকে সঠিক ব্যবহার করার কথা বলেন। আর এটা করতে পারলে ২০২৫ সালের মধ্য বাংলাদেশ আরো এক ধাপ এগিয়ে যেতে সক্ষম হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি। একই সঙ্গে পর্যটনের এলাকা গুলোকে ট্যুরিস্ট প্রোডাক্ট হিসেবে তুলে ধরার কথা বলেন হাবিব সুমন। দেশের পর্যটন উন্নয়নে গণমাধ্যমকে আরও ভূমিকা রাখার আহবান জানিয়ে পর্যটক গবেষক হাবিব সুমন বলেন, পর্যটন নিয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। এটা সম্ভব হলে অর্থনৈতিক ভাবেও সমৃদ্ধি অর্জন হবে বাংলাদেশ। একই সঙ্গে ট্যুরিজম সেক্টর নিয়ে যথাযথ পরিকল্পনা করে সামনে এগোতে হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

জার্নি প্লাস’র চিফ এক্সিকিউটিভ তৌফিক রহমান ইনকিলাবকে বলেন, বিদেশী পর্যটক আকর্ষণে বাংলাদেশের সঠিক পরিকল্পনার অভাব রয়েছে। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক প্রচারণা নেই বললেই চলে। পাশাপাশি ২০১৬ সালে হলি আর্টিজানে হামলার ঘটনার পর থেকে বিদেশী পর্যটকের সংখ্যা কমছে। হামলার আগে বাংলাদেশে বিদেশী পর্যটকের সংখ্যা ভালোই ছিল। যদিও ওই ঘটনার পর থেকে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং দেশে স্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজ করায় ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বিদেশী পর্যটক বেড়েছে। তবে আগের অবস্থানে এখনো পৌছানো সম্ভব হয়নি।
তৌফিক রহমান বলেন, বাংলাদেশে আসা বিদেশী পর্যটকদের মধ্যে অধিকাংশই বয়স্ক। যুব সম্প্রদায় বাংলাদেশে আসছে না। তাই যুব সম্প্রদায়সহ পর্যটক আকর্ষনে বিদেশে বাংলাদেশের পর্যটন কেন্দ্রগুলোর প্রচারণা বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে তৌফিক রহমান বেসামরিক বিমান, পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় এবং ট্যুরিজম বোর্ডকে অগ্রণী ভূমিকা রাখার কথা বলেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের দূতাবাস রয়েছে। এদের মধ্যে যে সব দেশ ভ্রমন পিপাসু, বিশেষ করে ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডসহ ভ্রমনপ্রিয় দেশের দূতাবাসকে ডেকে বাংলাদেশের অর্জন, পর্যটনে নিরাপত্তাসহ পর্যটনের স্থানগুলোকে পরিচিত করা। আবার বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোকে ওইসব দেশের পর্যটন সংশ্লিষ্টদের ডেকে পর্যটনে বাংলাদেশের সম্ভাবনা, অর্জন এবং দর্শনীয় স্থানগুলোকে তুলে ধরা। এছাড়া পর্যটনে বাংলাদেশ যে নিরপাদ সে সম্পর্কে বিদেশীদের সাক্ষাৎকার ও বাংলাদেশের পর্যটনে সর্বশেষ তথ্য তুলে ধরা।

ট্রেড এ্যান্ড ফেয়ার টোয়াবের পরিচালক মো. তাসলিম আমিন বলেন, পর্যটক আকর্ষনে বিদেশীদের কাছে বাংলাদেশ ট্যুরিজমে যে ভালো করছে তা তুলে ধরতে হবে। পর্যটন স্থানগুলোতে বিদেশীদের জন্য পৃথক নিরাপত্তা বলয় এবং ট্যুরিস্ট পুলিশ থাকছে এসব তুলে ধরতে হবে। পর্যটনকে আরও বেশি প্রসারিত করার তাগিদ দিয়ে মো. তাসলিম আমিন বলেন, পর্যটনকে প্রসারিত করতে সরকারের পাশাপাশি প্রাইভেট সেক্টরকে এগিয়ে আসতে হবে। তবে এক্ষেত্রে সরকারের প্রাইভেট সেক্টরকে সর্বোচ্চ সহযোগীতা ও উৎসাহ প্রদানের কথা বলেন তিনি।

বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের প্রধান নির্বাহী ড. ভুবন চন্দ্র বিশ্বাস ইনকিলাবকে বলেন, দেশের পর্যটনকে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে ৩ বছর মেয়াদী পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। গত মে মাস থেকে কার্যক্রম শুরু হয়েছে। পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশকে ব্রান্ডিং করা হবে। বিদেশী পর্যটক আকর্ষনে মার্কেটিংকে গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, আমাদেরকে সচেতনতার পাশাপাশি ভালো ব্যবহার, ভালো পরিবেশ, বিনোদনের সু-ব্যবস্থা, যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ, যানযট দূর করা, হোটেল-মোটেলের সঠিক ভাড়া নির্ধারণ, খাদ্যে ভেজাল দূর করা এবং সেবার জন্য দক্ষ জনবল তৈরি করতে হবে।

ড. ভুবন চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, সম্ভাবনাময় পর্যটন স্পটগুলোকে পরিকল্পিতভাবে উন্নত করতে পর্যটন মহাপরিকল্পনার মূল্যায়ণ শেষ পর্যায়ে। স্বল্প, মধ্যে এবং দীর্ঘ মেয়াদে এই মহাপরিকল্পনার ফান্ডও চূড়ান্ত। যা দেশের পর্যটন শিল্পকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন