মানুষের ব্যক্তিগত গোপন ক্ষুদ্র সঞ্চয়ও হাতিয়ে নিচ্ছে নিয়ন্ত্রণহীন সমবায় সমিতি, এমএলএম প্রতিষ্ঠান। আইনের চোখ ফাঁকি দিয়ে কথিত প্রতিষ্ঠানগুলো এক দশকে হাতিয়ে নিয়েছে অন্তত ২০ হাজার কোটি টাকা। ফলে পরিবার ও সমাজে চলছে টানাপড়েন। যার ঢেউ আছড়ে পড়েছে পারস্পরিক সম্পর্কের ওপর। দৃশ্যমান অবকাঠামোগত উৎকর্ষের চোরাবালিতে বিলীন হতে চলেছে ব্যক্তিগত পর্যায়ের সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি এবং শান্তিপূর্ণ সম্পর্কগুলো, যা বিশ্লেষকদের দৃষ্টিতে বড় এক চিন্তার খোড়াক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক সংস্থা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ব্যাংক, লিজিং কোম্পানিসহ প্রাতিষ্ঠানিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ, মাল্টি লেবেল মার্কেটিং (এমএলএম) এবং ব্যক্তি পর্যায়ে দাদন ও সুদের মতো অপ্রাতিষ্ঠানিক লেনদেন। আর অপ্রাতিষ্ঠানিক লেনদেনের ফাঁদে জড়িয়ে যাচ্ছেন গ্রামের নি¤œবিত্ত, মধ্যবিত্ত পরিবারের গৃহিণী, তরুণী, বেকার তরুণ এবং অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা। মনভোলানো কথায় মুগ্ধ হয়ে প্রবল আস্থা ও আত্মবিশ্বাস নিয়ে মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সমিতি, এমএলএম এবং সুদকারবারিদের হাতে তুলে দিচ্ছেন সঞ্চিত অর্থ। বিপরীতে তারা হচ্ছেন প্রতারিত। অর্থনৈতিকভাবে হচ্ছেন নিঃস্ব। সম্পর্কচ্ছেদ হচ্ছে ভাইয়ের সাথে ভাইয়ের। বোনের সঙ্গে ভাইয়ের। স্বামী-স্ত্রীর বিবাহ বিচ্ছেদ হচ্ছে। সুখী পরিবারে নেমে আসছে অশান্তির কালো মেঘ। অর্থনৈতিক টানাপড়েন আর মানসিক চাপ সইতে না পেরে আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটছে অনেক। চূড়ান্ত ধাক্কায় তছনছ হয়ে যাচ্ছে পারস্পরিক সম্পর্ক।
২৬৫ সমিতি হাতিয়ে নেয় ৪ হাজার কোটি টাকা
সমবায় অধিদফতরে নিবন্ধিত ২৬৫ সমিতির একটি আইডিয়াল কো-অপারেটিভ সোসাইটি (আইসিএল)। নিবন্ধন লাভ করে ২০০৭ সালে। এ সমিতি মানুষকে প্লট-ফ্ল্যাট দেয়ার নাম করে গ্রাহকের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে ৭৬৮ কোটি টাকা। ২০০৫ সালে নিবন্ধন নেয়া ‘ম্যাক্সিম ফাইন্যান্স অ্যান্ড কমার্স’ নামক সমিতি আত্মসাৎ করেছে ২৮৫ কোটি টাকা। ৮৮৮ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ডেসটিনি-২০০০। সমিতির তৎকালীন সভাপতি হাবিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হলেও জামিনে বেরিয়ে নাম পাল্টিয়ে অন্য নামে চালাচ্ছেন ‘সমিতি ব্যবসা’। ‘দি ঢাকা আরবান কো-অপারেটিভ ব্যাংক’ নামে সমিতির বিরুদ্ধে শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে ২৮ আগস্ট মামলা করে দুদক। সমবায় অধিদফতরের এক অডিট রিপোর্টে দেখা যায়, দেশে অন্তত ১ লাখ ৭৮ হাজার সমবায় সমিতি রয়েছে। এর মধ্যে মাল্টিপারপাস সমবায় সমিতি রয়েছে ২০-২৫ হাজার। এসবের মধ্য থেকে নিবন্ধিত ২৬৫টি মাল্টিপারপাস সমবায় সমিতি গত এক দশকে গ্রাহকের কাছ থেকে অন্তত ৪ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। উচ্চহারে মুনাফা দেয়ার প্রলোভনে সমিতিগুলো এ অর্থ হাতিয়ে নেয়। আত্মসাৎকৃত এসব অর্থ বিদেশে পাচার, ভূসম্পত্তি ক্রয় এবং সমিতি কর্মকর্তাদের নামে ব্যক্তি সম্পত্তি কেনায় ব্যয় হয়েছে। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির বৈঠকে উপস্থাপিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, নিবন্ধনের বাইরেও বহু সমবায় সমিতি রয়েছে। এসব সমিতি মিলিয়ে মোট হাতিয়ে নেয়ার অর্থের অংক ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি।
অডিট রিপোর্ট অনুযায়ী, ২৬৫টি সমিতির মধ্যে ৭৬টির অডিট রিপোর্টে সংগৃহীত আমানত দেখানো হয়েছে ৪১২ কোটি ৯ লাখ ৬২ হাজার ৭৮০ টাকা। বিভিন্ন খাতে এসব সমিতির বিনিয়োগ পাওয়া গেছে ৬৩১ কোটি ৪৪ লাখ ১১ হাজার ৩৭১ টাকা। বাড়তি ২১৯ কোটি ৩৫ লাখ টাকার উৎস নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। অডিটরদের মতে, এ অর্থও আমানতকারীদের কাছ থেকে সংগৃহীত। কিন্তু তা লেজার বইয়ে দেখানো হয়নি। ফলে অডিট রিপোর্টেও আসেনি। আর বাকি ১৮৯টি সমিতির আমানত বা মূলধন ৩ হাজার ৬৫৬ কোটি ৬৮ লাখ ৪৩ হাজার ৮৩৬ টাকা। কিন্তু এগুলোর বিনিয়োগ মাত্র ২ হাজার ৮ কোটি টাকা। বাকি ১ হাজার ৬৪৮ কোটি ৫১ লাখ টাকার কোনো হিসাব পাওয়া যায়নি। এ অর্থ সমিতিগুলোর ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে ধারণা করেন অডিটররা।
সূত্রমতে, সমবায় আইন অনুযায়ী, ‘ব্যাংক’, ‘কমার্স’, ‘ক্রেডিট’, ‘ইনভেস্টমেন্ট’ ইত্যাদি নাম যুক্ত করে সমিতি করা যাবে না। তা সত্তে¡ও কেউ কেউ সমিতির সঙ্গে এসব শব্দ যুক্ত করে গ্রাহকের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। ‘আজিজ কো-অপারেটিভ কমার্স অ্যান্ড ফাইন্যান্স ক্রেডিট সোসাইটি লিমিটেড’ নামক প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের ৩শ’ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে সম্প্রতি। হাতিয়ে নেয়ার অর্থের অন্তত ১শ’ কোটি টাকা প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান তাজুল ইসলাম কানাডায় পাচার করেছেন মর্মে অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)’র এক তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। প্রতিবেদনের তথ্যমতে, সমবায় সমিতির লাইসেন্স নিয়ে পরে ‘ব্যাংক’ হিসেবে কার্যক্রম চালায়। সারাদেশে কথিত এ ব্যাংকের ১৬০টি অবৈধ শাখা খোলেন। এসব শাখার মাধ্যমে ১১ হাজার ৪২৫ জন গ্রাহকের কাছ থেকে উপরোক্ত অংকের অর্থ হাতিয়ে নেয়া হয়। এ ঘটনায় মামলা হওয়ার পর মূল হোতা তাজুল ইসলামকে গ্রেফতার করা হলেও পরে তিনি নিঃশব্দে জামিনে বেরিয়ে আসেন। এখনো একই কায়দায় কার্যক্রম চালাচ্ছেন বলে জানা গেছে।
সমবায় অধিদফতরের রেজিস্ট্রার মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, যেসব প্রতিষ্ঠান সমিতির নামে লাইসেন্স নিয়ে মাইক্রোক্রেডিট কার্যক্রম পরিচালনা করছে ইতোমধ্যেই তাদের একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে। অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত সমিতিগুলোর বিরুদ্ধে তালিকা ধরে যাচাই-বাছাই সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, সমবায় বিভাগে লুটপাট অনেকটাই কমে এসেছে। বিশেষ করে ২০১৩ সালে সমবায় আইন সংশোধনের ফলে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার ঘটনা তেমন ঘটছে না।
পারিবারিক অশান্তির সমাপ্তি আত্মহত্যায়
সাভারের আঙ্গিনা এলাকার আমেনা বেগম (৩৬)। একটি সমবায় সমিতির সদস্য হয়েই একটি খালি স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর করে ঋণ নেন। ৬ মাসে তার কাছ থেকে সুদ ধার্য করা হয় ৫০ হাজার টাকা। ১ লাখ ২০ হাজার টাকা পরিশোধ করার পর নির্ধারিত সময় অতিক্রান্ত হয়ে যায়। পরে কথিত সমিতির লোকজন সাদা স্ট্যাম্পে ৩ লাখ টাকা পাওনা রয়েছেÑ মর্মে লিখিয়ে নেয়। স্থানীয় সন্ত্রাসী দিয়ে তাকে হুমকি দেয়া হয়। একপর্যাযে তিনি ১ লাখ ২০ হাজার টাকার বিপরীতে সমিতিকে ২ লাখ টাকা দিতে বাধ্য হন। কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলায় সমিতির ঋণের কিস্তির টাকা জোগাড় করতে না পেরে সম্প্রতি গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেন গৃহবধূ শিলা (৪০)। জগন্নাথপুর ইউনিয়নের ইদ্রাকপুর গ্রামে ফকিরতলা সংলগ্ন নিজ বাড়িতে এই আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। নিহত শিলা গ্রামের ভ্যানচালক হেলালের স্ত্রী ও চার সন্তানের জননী। তবে পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, পেটের ব্যথা এবং সংসারের অভাব অনুযোগের কারণে শিলা আত্মহত্যা করেছেন। গত ২৭ আগস্ট কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে না পেরে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেন ফরিদপুর বোয়ালমারী পশ্চিম কামার গ্রামের রবিউল মোল্যা। ঋণের কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে না পারায় গত ২৩ আগস্ট আত্মহত্যা করেন নারায়ণগঞ্জ রূপগঞ্জের গোলাকান্দাইলের গাজী মোল্লা। তিনি একজন অটোচালক। পরিবারে তিন সন্তান ও স্ত্রী রয়েছে।
একটি বেসরকারি সংস্থার জরিপ অনুযায়ী রাজধানীর আশপাশের এলাকা যেমনÑ গাজীপুর, সাভার, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, টাঙ্গাইল জেলায় চলছে চড়া সুদ ও দাদন ব্যবসা। সংঘবদ্ধচক্র আইন ও বিধি-বিধানের তোয়াক্কা না করে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে তুলেছে ঋণ ও সুদ ব্যবসা। তারা একদিকে অধিক মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে আমানত নিচ্ছে। অন্যদিকে গ্রাহকদের ঋণ দিয়ে উচ্চ হারে সুদ আদায় করছে। সমবায় সমিতি, মাল্টিপারপাস কোম্পানী এমনকি এনজিওর ঋণের জালে সর্বসান্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ।
বিনষ্ট হচ্ছে সামাজিক স্থিতিশীলতা
ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্স (এনবিইআর) চেয়ারম্যান প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ বলেন, এটিকে বলে ‘ইনফর্মাল ফিন্যান্সিং’। ব্যাংক, লিজিং, বীমা, শেয়ারবাজারÑ এগুলো হচ্ছে ফর্মাল ফিন্যান্সিং। যেখানে ফর্মাল ফিন্যান্সিংয়ে হরিলুট চলছে সেখানে ইনফর্মাল ফিন্যান্সিংয়ে গাইডলাইন থাকারও তো প্রশ্নই ওঠে না। এখনো ৪ কোটি মানুষ ব্যাংকিং সিস্টেমের বাইরে। গরিব মানুষের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয়গুলোকে ফর্মাল ফিন্যান্সিংয়ের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। সে ক্ষেত্রে সঞ্চয়পত্রের ইন্টারেস্টের মিনিমাম হার ১২-১৩ পার্সেন্টের মধ্যে রাখতে হবে। না হলে বেকার, গৃহবধূ, রিটায়ার্ড পার্সনদের ছোট ছোট সঞ্চয়গুলো বড় ঝুঁকি নিয়ে ইনফর্র্মাল বিনিয়োগে চলে যাবে। এমএমএল, মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভের মতো ঠকবাজ হায়হুতাশ কোম্পানি দ্বারা মানুষ নিঃস্ব হতে থাকবে। এটি কিন্তু নিছক অর্থনৈতিক সমস্যা নয়। এটির কারণে সমাজের স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হচ্ছে। স্ত্রী স্বামীর পিটুনি খাচ্ছে। স্বামী-স্ত্রীর ডিভোর্স হচ্ছে। দু’লাখ-এক লাখ টাকার জন্য খুনোখুনি হচ্ছে। আত্মহত্যা করতে হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উঠে আসা কঠিন। তবে রুরাল ইনফর্মাল অর্থায়নের জন্য একটি কাঠামো হতে পারে। গরিব মানুষের টাকা ফর্মাল বিনিয়োগে আনার প্রকল্প নেয়া যেতে পারে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন