স্টাফ রিপোর্টার : সিভিল এভিয়েশনের কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন ওঠেছে। তাড়াহুড়া করে বিদেশী কোম্পানী রেড লাইনকে শাহজালাল বিমানবন্দরের দায়িত্ব দেয়া হলেও এর কোন সুফল পাচ্ছে না বাংলাদেশ। এখনও বৃটেন সরকার সরাসরি কার্গো পরিবহনের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেনি। বিমানবন্দরের নিরাপত্তা সংক্রান্ত দুর্বলতাও কাটিয়ে ওঠতে পারেনি সিভিল এভিয়েশন। শুধু বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী গঠন এবং বিনা টেন্ডারে রেড লাইনের হাতে নিরাপত্তা ছেড়ে দেয়া ছাড়া চোখে পড়ার মতো কোন কাজই করতে পারেনি সংস্থাটি। শুধু তাই নয়, প্রধানমন্ত্রীর ফ্লাইট আকাশে ৩১ মিনিট চক্কর দেয়া ও রানওয়েতে ঝুঁকিপূর্ণ ধাতববস্তু পড়ে থাকার ঘটনারও কোন কূল-কিনারা করতে পারেনি। এ ঘটনায় ঘটিত ৩টি কমিটি এখনো তাদের রিপোর্ট জমা দেয়নি। পরিচালক শাহজালালের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি আরো এক সপ্তাহ সময় চেয়েছে। বেবিচকের ফ্লাইট সেফটি বিভাগের কনসালটেন্ট ক্যাপ্টেন মোস্তাক আলীর নেতৃত্বে গঠিত কমিটি তাদের প্রাথমিক রিপোর্ট দিতে আরো কমপক্ষে ২০ দিন লাগবে বলে জানিয়েছেন কমিটির একজন সদস্য। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই কমিটির একজন সদস্য জানান, প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী বিশেষ ফ্লাইটটি অবতরণের প্রায় ৩ ঘণ্টা আগে বাংলাদেশ বিমানের একটি বোয়িং ৭৭৭ এয়ারক্রাফটের ইঞ্জিন থেকে ধাতববস্তুগুলো পড়েছিল রানওয়েতে। কন্ট্রোল টাওয়ারের তথ্য থেকে তারা জানতে পেরেছেন এরপর মোট ৯টি ফ্লাইট ওঠানামা করেছে রানওয়ে দিয়ে। কমিটির পক্ষ থেকে ওই ৭টি ফ্লাইটের পাইলট ও ফাস্ট অফিসারকে (কো-পাইলট) চিঠি দেয়া হয়েছে। কাল তাদের সঙ্গে বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে কমিটির।
এছাড়া সিভিল এভিয়েশন এখনো জানে না কবে সরাসরি কার্গো যাবে যুক্তরাজ্যে। এ সম্পর্কে বেবিচকের একজন কর্মকর্তা বলেন, বিমানের কার্গো ফ্লাইটের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের আশায় তাড়াহুড়ো করে বিনা টেন্ডারে ৭৪ কোটি টাকার নিরাপত্তার কাজ দেয়া হয় রেডলাইনকে। কিন্তু তিন মাস হয়ে গেল- এখনো কার্গোর ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের কোন লক্ষণ নেই।
এ সম্পর্কে জানতে চাইলে বিমান চেয়ারম্যান এয়ার মার্শাল ইনামুল বারী বলেন, কার্গোর ওপর নিষেধাজ্ঞা কবে নাগাদ প্রত্যাহার হবে সেটা বলা মুশকিল। এটা নির্ভর করছে যুক্তরাজ্যের দয়ার ওপর। আমরা গরীব দেশ। তাদের ইচ্ছা অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করছে কার্গোর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ইস্যু।
এদিকে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রে জানা গেছে, এতবড় বিপর্যয়ের পরও সিভিল এভিয়েশন ও বিমান মন্ত্রণালয়ের এনিয়ে তেমন তোড়জোড় নেই। উল্টো সিভিল এভিয়েশন ও শাহজালাল থেকে প্রমাণ করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে এটি নিছক ছোটখাটো বিচ্ছিন্ন ও তুচ্ছ ঘটনা। এ ঘটনায় তোলপাড় হলেও টনক নড়েনি সিভিল এভিয়েশন ও মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে এ ঘটনায় কি ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে জানতে চিঠি পাঠানো হলেও সে বিষয়েও গুরুত্ব দেয়নি সিভিল এভিয়েশন। উপরন্তু সিভিল এভিয়েশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ৭৪ কোটি টাকায় বিনা টেন্ডারে শাহজালালে নিয়োগকৃত বিতর্কিত রেডলাইনের আমন্ত্রণে লন্ডনে গেছেন প্লেজার ট্রিপে। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ একাধিক কর্তাব্যক্তি।
জানা যায়, গত রোববার সকালে বিমানের একটি ফ্লাইটে লন্ডনের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেছেন, সিভিল এভিয়েশনের মেম্বার (অপস) এয়ার কমোডর মোস্তাফিজুর রহমান, বিমান মন্ত্রণালয়ের সচিব এসএম গোলাম ফারুক ও বিমানমন্ত্রীর একান্ত সহকারী এটিএম নাসির মিয়া, এভসেক সেলের গ্রুপ ক্যাপ্টেন (অব.) আলমগীর, শাহজালালের উপ-পরিচালক অহিদুর রহমান ও নিরাপত্তা কর্মকর্তা আলমগীর।
সিভিল এভিয়েশন চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এহসানুল গনি চৌধুরি বলেন, তারা লন্ডন গেছেন যুক্তরাজ্য সরকারের ডিএফটি (ডিপার্টমেন্ট অব ট্রান্সপোর্টেশন) এর আমন্ত্রণে। কিন্তু সিভিল এভিয়েশনেরই এভসেক সেল থেকে বলা হয়েছে, তারা লন্ডন গেছেন রেড লাইনের আমন্ত্রণে। রেড লাইনের উদ্যোগে এ ট্যুরের সমস্ত ব্যয়ভার বহন করছে। রেড লাইন হিথরো বিমানবন্দর পরিদর্শন করানোর কথা বলেই তাদেরকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। জানা গেছে, প্রথমে বেবিচক থেকে এই ট্যুরে যাওয়ার কথা ছিল পরিচালক শাহজালাল উইং কামন্ডার জাকির হাসানের। মেম্বার অপস গ্রুপ ক্যাপ্টেন মোস্তাফিজুর রহমান তখন অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। খবর পেয়ে তিনি তাৎক্ষণিক মন্ত্রণালয়ে ছুটে যান এবং নিজের যাওয়া নিশ্চিত করেন। এনিয়ে সিভিল এভিয়েশন ও মন্ত্রণালয় জুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়।
এদিকে একটি গোয়েন্দা সংস্থার এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী ফ্লাইটটি ৩১ মিনিট আকাশে চক্কর দেয়া ও রানওয়েতে ধাতববস্তু পড়ে থাকার ঘটনাটি নিয়ে তারাও তদন্ত করছেন। শিগগিরই তারা এসংক্রান্ত একটি রিপোর্ট প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠাবেন। রিপোর্টের সঙ্গে তারা বিশ্বের একটি দেশের এধরনের দুর্ঘটনার দৃষ্টান্ত ও ভিডিও ফুটেজ তুলে ধরবেন। ওই কর্মকর্তা বলেন, ২০০০ সালে ২৫ জুলাই ১০০ জন জার্মানি পর্যটক নিয়ে নিউইয়র্কের উদ্দেশ্যে এয়ার ফ্রান্সের ফ্লাইট ৪৫৯০ কনকর্ড চার্জ দ্যা গ্যালে এয়ারপোর্টের রানওয়ে থেকে উড্ডয়ন করে। মুহূর্তে এয়ার ক্রাফটটির চাকা পাংচার হয়ে তেলের ট্যাংকে আঘাত হানে। তাতে আগুন ধরে যাওয়ায় ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায় বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুততম গতির কনকর্ড উড়োজাহাজটির। কিছুক্ষণ পর গনেসে অঞ্চলের একটি আবাসিক হোটেলের ওপর ওই ফ্লাইট বিধ্বস্ত হয়। এরপর তদন্তে ধরা পড়ে- ওই কনকর্ড উড্ডয়নের পাঁচ মিনিট আগে নিউইয়র্কের উদ্দেশ্যে ওই রানওয়ে থেকেই কন্টিনেন্টাল এয়ারলাইন্সের একটি ডিসি-১০ টেক অফ করার সময় ইঞ্জিনের কিছু ধাতব বস্তু ছিটকে পড়েছিল। তদন্তে জানা গেছে, ওই ধাতব বস্তুর আঘাতেই ভয়াবহ দুর্ঘটনার শিকার হয় কনকর্ড। জানা গেছে, ওই একটি দুর্ঘটনার বিপর্যয় মোকাবিলা করতে না পেরে চিরতরে বন্ধ হয়ে যায় কনকর্ড। এদিকে রেডলাইনের আমন্ত্রণে যুক্তরাজ্য সফর নিয়ে বিতর্ক তুলেছে খোদ সিভিল এভিয়েশনেরই একাধিক পরিচালক ও কর্মকর্তা। তারা বলছেন, হিথরো বিমানবন্দর পরিদর্শনের নামে যারা যুক্তরাজ্য গেছেন তাদের কারোরই এধরনের অভিজ্ঞতা প্রয়োজন নেই। তাদের বক্তব্য বিমানমন্ত্রীর পিএসসহ অন্যদের কি প্রয়োজন হিথরো পরিদর্শনের। তারা কেউই বিমানবন্দরের এসাইনমেন্ট সংশ্লিষ্ট নয়। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর ফ্লাইট বিলম্বের ঘটনায় যেখানে প্রকৃত কারণ উদঘাটনে গোয়েন্দারা গলদঘর্ম হচ্ছেন, সেখানে সিভিল এভিয়েশনের সবেচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ মেম্বার অপারেশনের প্রধান কি করে এই মুুহূর্তে কর্মস্থল ত্যাগ করেন? এ নিয়ে আরো বিতর্ক হলো- হাসপাতালের শয্যা থেকে ওঠে গিয়ে তিনি ফ্লাইটে ওঠার ঘটনাকে কেন্দ্র করে।
সোমবার সিভিল এভিয়েশনে গিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রীর ফ্লাইট আকাশে ৩১ মিনিট বিলম্ব হবার ঘটনাকে তুচছ তাচ্ছিল্য বলে উল্লেখ করে যুক্তি দেখানোর চেষ্টা চালানো হচ্ছে। দায়িত্বশীল কর্তারা এখন বলছেন- এখানে তো ফ্রান্সের মত তেমন দুর্ঘটনা ঘটেনি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন