এক
১৪৪০ হিজরি সনের বিদায়ের সাথে সাথে বছর ঘুরে আবারো ফিরে এসেছে আরেকটি নতুন বছর। স্বাগত হিজরি নববর্ষ ১৪৪১। হিজরি সনের প্রথম মাস মহররম। ইসলামে হিজরি সন ও তারিখের গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ হিজরি সন এমন একটি সন, যার সঙ্গে মুসলিম উম্মাহর তাহজিব-তামাদ্দুন ও ঐতিহ্যের ভিত্তি সম্পৃক্ত। মুসলমানদের রোজা, হজ, ঈদ, শবেবরাত, শবেকদর, শবে মেরাজসহ ইসলামের বিভিন্ন বিধি-বিধান হিজরি সনের ওপর নির্ভরশীল। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও আনন্দ-উৎসবসহ সব ক্ষেত্রেই মুসলিম উম্মাহ হিজরি সনের অনুসারী। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, হিজরি সনের পহেলা মাস মহররম একের পর এক আমাদের দুয়ারে উপস্থিত হয় ঠিক, কিন্তু হিজরি সনের শুভআগমন উপলক্ষে হইচই নেই, নেই কোনো প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক এবং অনলাইন মিডিয়ার বিশেষ কোনো আয়োজন। যেমনভাবে বিশেষ আয়োজন পরিলক্ষিত হয় ঈসায়ি নববর্ষের আগমনে। বাংলা এবং ইংরেজি নববর্ষকে যেভাবে গুরুত্ব দিয়ে আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে উদযাপন করা হয়, তাতে মনে হয় হিজরি নববর্ষের যেন আমাদের কোনো প্রয়োজনই নেই! অথচ হিজরি নববর্ষকে গুরুত্বসহকারে পালন করাই ছিল আমাদের মুসলিম অধ্যুষিত দেশে কাম্য। হিজরি সন গণনার সূচনা হয়েছিল ঐতিহাসিক এক অবিস্ময়রণীয় ঘটনাকে উপলক্ষ করে। রাসূল (সা.) এবং তাঁর সঙ্গী-সাথীবর্গের মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের ঐতিহাসিক ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্যই আরবি মহররম মাসকে হিজরি সনের প্রথম মাস ধরে সাল গণনা শুরু হয়েছিল। আল্লাহর নির্দেশ পালনার্থে পবিত্র মক্কা থেকে মদিনায় রাসূল (সা.) এবং সাহাবায়ে কেরামগণের হিজরত থেকেই হিজরি সনের সূচনা।
হিজরি সনের সূচনা: খোলাফায়ে রাশেদার শাসনকালে মদিনাকেন্দ্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার গোড়াপত্তন হলে অফিসিয়াল তথ্যাদির নথি ও দিনক্ষণের হিসাব রাখতে গিয়ে বিভিন্ন প্রদেশের গভর্নররা বিপাকে ও অসুবিধায় পড়েন। যেহেতু তখন ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্য কোনো বর্ষপঞ্জি বা একক সন চালু ছিল না। রাষ্ট্রীয় অফিসিয়াল কার্যাদি নির্বিঘেœ ও যথানিয়মে সম্পন্ন করার প্রয়োজনে নতুন সন প্রবর্তন তখন অনিবার্য হয়ে ওঠে। খলিফাতুল মুসলিমিন হজরত উমর ফারুক (রা.) এর শাসনামলে ১৬ হিজরি সনে প্রখ্যাত সাহাবি হজরত আবু মূসা আশআরি (রা.) ইরাক এবং কুফার গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। একদা হজরত আবু মুসা আশআরি (রা.) খলিফা উমরের (রা.) খেদমতে এ মর্মে পত্র লিখেন যে, আপনার পক্ষ থেকে পরামর্শ কিংবা নির্দেশ সম্বলিত যেসব চিঠি আমাদের নিকট পৌঁছে তাতে দিন, মাস, কাল, তারিখ ইত্যাদি না থাকায় কোনো চিঠি কোন দিনের তা নিরুপণ করা আমাদের জন্য সম্ভব হয় না। এতে করে আমাদেরকে নির্দেশ কার্যকর করতে খুব কষ্ট করতে হয়। অনেক সময় আমরা বিব্রতবোধ করি চিঠির ধারাবাহিকতা না পেয়ে। হজরত আবু মুসা আশআরির চিঠি পেয়ে হজরত উমর (রা.) এ মর্মে পরামর্শ সভার আহবান করেন যে, এখন থেকে একটি ইসলামী তারিখ প্রবর্তন করতে হবে। উক্ত পরামর্শ সভায় হজরত উসমান (রা.), হজরত আলীসহ (রা.) শীর্ষস্থানীয় সাহাবায়ে কেরাম এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। সভায় উপস্থিত সকলের পরামর্শ ও মাতামতের ভিত্তিতে এ সভায় ওমর রা. সিদ্ধান্ত দেন ইসলামী সন প্রবর্তনের। তবে কোন মাস থেকে বর্ষের সূচনা করা হবে তা নিয়ে পরস্পরের মাঝে মতভেদ সৃষ্টি হয়। কেউ মত পোষণ করে রাসুল (সা.) এর জন্মের মাস রবিউল আউয়াল থেকে বর্ষ শুর। আবার কেউ কেউ মত পোষণ করেন রাসুলের (সা.) ইন্তেকালের মাস থেকে বর্ষ শুরু করা হোক। কারো কারো মতে হুজুর (সা.) এর হিজরতের মাস থেকে বর্ষ শুরু করা হোক। কেউ বললেন নবী (সা.)এর নবুয়ত প্রকাশের বছর থেকে বর্ষগণনা শুরু করা যায়। এভাবে বিভিন্ন মতামত আলোচিত হওয়ার পর হজরত উমর (রা.) বললেন নবী (সা.) এর জন্মের মাস থেকে হিজরি সনের গণনা শুরু করা যাবে না। কারণ খ্রিস্টান সম্প্রদায় হজরত ঈসা (আ.) এর জন্মের মাস থেকেই খিস্ট্রাব্দের গণনা শুরু করেছিল। তাই রাসুলের জন্মের মাস থেকে সূচনা করা হলে বাহ্যত খ্রিস্টানদের অনুসরণ ও সাদৃশ্যতা হয়ে যায়, যা মুসলমানদের জন্য পরিতাজ্য। আর অপরদিকে নবীজীর (সা.) ওফাত দিবসের মাস থেকেও গণনা শুরু করা যাবে না, কারণ এতে প্রিয় নবীজীর (সা.) এর মৃত্যুব্যথা আমাদের মাঝে বারবার উত্থিত হবে। পাশাপাশি অজ্ঞ যুগের মৃত্যুর শোক পালনের ইসলাম বিরোধী একটি কুপ্রথারই পুনরুজ্জীবন ঘটবে। হজরত উমর (রা.) এর দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্যকে হজরত উসমান (রা.), হজরত আলী (রা.) একবাক্যে সহমত পোষণ করেন। এরই প্রেক্ষিতে অবশেষে মহানবী (সা.) এর হিজরতের ঘটনাকে মহিমান্বিত করার জন্য মহররম মাস থেকে হিজরি নামে একটি স্বতন্ত্র সন চালু করার ঘোষণা দেন ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর ফারুক (রা.)। এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় হিজরতের ১৬ বছর পর ১০ জুমাদাল উলা ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন