নীতিমালা অমান্য করে ইন্টারনেট সেবা প্রদান করায় শোকজ
ফারুক হোসাইন : নীতিমালা অমান্য করে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ অবৈধ টেলিকম নেটওয়ার্ক সংযোগ স্থাপন করার অভিযোগ উঠেছে গ্রামীণফোনের বিরুদ্ধে। খোদ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বিটিআরসিই গ্রামীণফোনে পাঁচ লাখ কিলোমিটার অপটিক্যাল ফাইবার সংযোগকে এই আখ্যা দিয়েছে। ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার (আইএসপি) এবং নেশনওয়াইড টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক (এনটিটিএন) লাইসেন্স না থাকার পরও সোনালী ব্যাংকের ৫৫১টি শাখায় ইন্টারনেট সেবা প্রদান করছে অপারেটরটি। আর এজন্য প্রতিষ্ঠানটি পাঁচ লাখ কিলোমিটার অপটিক্যাল ফাইবার সংযোগ স্থাপন করেছে। অনুমোদন ছাড়া স্থাপিত এই অপটিক্যাল ফাইবার ক্যাবলকে ‘দেশের সবচেয়ে দীর্ঘ অবৈধ টেলিকম নেটওয়ার্ক’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে কমিশন। এর মাধ্যমে প্রতি মাসে সোনালী ব্যাংকের ৫৫১টি শাখা থেকে ২৭ লাখ ৫৫ হাজার টাকা আয় করছে গ্রামীণফোন। মোবাইল অপারেটর গ্রামীণফোন লাইসেন্স নীতিমালা অমান্য করে সোনালী ব্যাংককে অপটিক্যাল ফাইবার ও ইন্টারনেট সংযোগ প্রদান করায় অপারেটরটিকে শোকজ (কারণ দর্শাতে বলেছে) করেছে এবং এর কারণ ব্যাখ্যা করতে বলেছে বিটিআরসি। একই সাথে সোনালী ব্যাংকের সাথে যে সংযোগের মাধ্যমে সেবা প্রদান করছে তা বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছে এবং কেন অপারেটরটিকে আর্থিক জরিমানা করা হবে না তা জানতে চাওয়া হয়েছে। সম্প্রতি বিটিআরসিতে অনুষ্ঠিত কমিশন সভায় এ বিষয়ে আলোচনা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়, গ্রামীণফোন সোনালী ব্যাংকে অনলাইন ট্রানজেকশনের সুবিধা দেয়ার জন্য ফাইবার অপটিক্যাল সংযোগ স্থাপন করেছে, যা মোবাইল ফোন লাইসেন্সের বিপক্ষে। গাইডলাইন অনুযায়ী মোবাইল ফোন অপারেটররা শুধুমাত্র মোবাইল এবং মোডেমে ইন্টারনেট সেবা প্রদান করতে পারে। নীতিমালা অমান্য করে সোনালী ব্যাংকে ফাইবার অপটিক্যাল সংযোগ প্রদান করায় বিটিআরসি গ্রামীণফোনকে শোকজ (কারণ দর্শাতে বলেছে) করেছে এবং এর কারণ ব্যাখ্যা করতে বলেছে। বিটিআরসির পক্ষ থেকে আরো জানানো হয়, গ্রামীণফোন দুই আইএসপি লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান অগ্নি সিস্টেমস এবং এডিএন টেলিকমের সাথে যৌথভাবে গো ব্রডব্যান্ড নামে হাইস্পিড ইন্টারনেট সেবা চালু করে। আর এই গো ব্রডব্যান্ডের নামেই রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান সোনালী ব্যাংককে তাদের নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠার জন্য ইন্টারনেট সংযোগ প্রদান করা হয়।
বিটিআরসি নীতিমালা অমান্য করে ইন্টারনেট সেবা প্রদান করায় গ্রামীণফোনকে শোকজ এবং আর্থিক জরিমানা করার কথা বললেও অগ্নি সিস্টেমস এবং এডিএন টেলিকমের বিষয়ে কোনো কথা বলা হয়নি। এমনকি ওই দুই প্রতিষ্ঠানকে এর জন্য অভিযুক্তও করা হয়নি। বিটিআরসির চেয়ারম্যান শাহজাহান মাহমুদ বলেছেন, এ ধরনের কাজের জন্য অগ্নি সিস্টেমস এবং এডিএন টেলিকমকে লিখিতভাবে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে।
বিটিআরসির সূত্রে জানা যায়, ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে গ্রামীণফোন সোনালী ব্যাংককে ফাইবার অপটিক্যাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে লাস্ট মাইল (শেষ সীমা পর্যন্ত অর্থাৎ কম্পিউটার বা যে ডিভাইসে সংযোগ ব্যবহার করা হবে সেই ডিভাইস পর্যন্ত) সংযোগ প্রদানের জন্য চুক্তি করে। কিন্তু মোবাইল ফোন গাইডলাইন এবং এনটিটিএন গাইডলাইন অনুযায়ী, এনটিটিএন লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান ফাইবার অপটিক্যাল ক্যাবল স্থাপন করতে পারে না। দেশে বর্তমানে এনটিটিএন (নেশনওয়াইড টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক) লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান রয়েছে পাঁচটি। এর মধ্যে বেসরকারি দুই প্রতিষ্ঠান ফাইবার এট হোম ও সামিট কমিউনিকেশন লিমিটেড। অপর তিন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হলো বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল), পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) ও বাংলাদেশ রেলওয়ে।
বিটিআরসি বলছে, গ্রামীণফোন গো ব্রডব্যান্ডের মাধ্যমে সোনালী ব্যাংকের ৫৫১টি শাখায় ইন্টারনেট সংযোগ প্রদান করেছে। নীতিমালা অনুযায়ী গ্রামীণফোন মোবাইল ইন্টারনেট ও মোডেম ইন্টারনেট সেবা ভিন্ন অন্য কোনো ইন্টারনেট সংযোগ ও সেবা প্রদান করতে পারে না। কিন্তু এখানে নীতিমালা অমান্য করে গ্রামীণফোন সোনালী ব্যাংককে ইন্টারনেট সংযোগ প্রদান করেছে এবং নিজেদেরকে আড়াল করতে অগ্নি সিস্টেমস এবং এডিএন টেলিকমকে সমানে রাখা হয়েছে।
এ বিষয়ে গ্রামীণফোনের পক্ষ থেকে বলা হয়, বিটিআরসির কাছ থেকে আমরা এখন পর্যন্ত কোনো তথ্য পাইনি। তাই কোনো মন্তব্য করা সমীচীন হবে বলে মনে করছি না। বিটিআরসির কাছ থেকে যথোপযুক্ত ব্যাখ্যা পেলে পরবর্তীতে জানাতে পারব কেন বিটিআরসির পূর্বেকার অনুমোদন প্রত্যাহার করা হবে।
বিটিআরসি বলছে, ২০১৩ সালে যখন গো ব্রডব্যান্ডকে অনুমোদন দেয়া হয় তখন বলা হয়েছিল শুধুমাত্র অগ্নি সিস্টেমস এবং এডিএন টেলিকম ওয়াইম্যাক্স সেবা প্রদান করবে। আর এই ওয়াইম্যাক্স সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে এই দুই প্রতিষ্ঠান কেবল গ্রামীণফোনের অবকাঠামো যেমন অফিস, মার্কেটিং চ্যানেল ইত্যাদি শেয়ার করতে পারবে। কিন্তু সম্প্রতি ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার অ্যাসোসিয়েশন (আইএসপিএবি) গো ব্রডব্যান্ডের বিরুদ্ধে কয়েকটি ব্যাংককে অবৈধভাবে ফাইবার অপটিক্যাল ক্যাবল সংযোগ প্রদানের বিষয়টি লিখিতভাবে অভিযোগ করে। ওই চিঠিতে আইএসপিএবির সভাপতি আব্দুল হাকিম উল্লেখ করে বলেন, আমরা জানতে পেরেছি গো ব্রডব্যান্ড সোনালী ব্যাংককে অপটিক্যাল ফাইবার সংযোগ প্রদান করার জন্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এই চুক্তি এবং সংযোগ প্রদান নীতিমালা লঙ্ঘন করে করা হয়েছে। চিঠিতে আব্দুল হাকিম এ বিষয়ে কমিশনকে তথ্য সংগ্রহ এবং ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানান। আর এর পরপরই বিষয়টি আলোচনায় আসে। কমিশন গ্রামীণফোনের কাছে এই বিষয়ে জানতে চায় কিন্তু অপারেটরটির পক্ষ থেকে আশানুরূপ কোনো জবাব দেয়া হয়নি। পরবর্তীতে কমিশনের পক্ষ থেকে কমিশন সভায় সিদ্ধান্ত নিয়ে গ্রামীণফোনকে শোকজ এবং ব্যাখ্যা চাওয়া হয়। ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার (আইএসপি) গাইডলাইন অনুযায়ী, যে কোনো আইএসপি লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান যে কোনো ব্যাংক অথবা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানকে ইন্টারনেট সংযোগ প্রদান করতে পারে। তবে তাদের এই সংযোগ হতে হবে এনটিটিএন লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানের অপটিক্যাল ক্যাবল ব্যবহার করে। কিন্তু গ্রামীণফোন ও সোনালী ব্যাংকের ক্ষেত্রে কোনো আইএসপি বা এনটিটিএন অপারেটর অন্তর্ভুক্ত নয়। আর গ্রামীণফোন মোবাইল অপারেটর হওয়ার কারণে এ ধরনের সেবা প্রদান করতে পারে না।
গ্রামীণফোনের পক্ষ থেকে বলা হয়, তারা সোনালী ব্যাংকের ৫৫১টি শাখায় ইন্টারনেট সংযোগ প্রদানের জন্য পাঁচ লাখ কিলোমিটার অপটিক্যাল ফাইবার সংযোগ স্থাপন করেছে। আর বিটিআরসি এই অপটিক্যাল ফাইবার সংযোগকে দেশের সবচেয়ে দীর্ঘ অবৈধ টেলিকম নেটওয়ার্ক হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী গ্রামীণফোন তাদের এই সংযোগের মাধ্যমে সোনালী ব্যাংকের প্রতিটি শাখা থেকে প্রতি মাসে পাঁচ হাজার টাকা করে পেয়ে থাকে। প্রাথমিকভাবে তিন বছরের করা এই চুক্তি পরবর্তীতে বর্ধিত করার সুযোগ রয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন