স্টাফ রিপোর্টার : গাজীপুরে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আহসান উল্লাহ মাস্টার হত্যার ঘটনায় বিএনপি নেতা নুরুল ইসলাম সরকারসহ ছয়জনের মৃত্যুদ-ের রায় বহাল রেখেছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে এ মামলায় ২০০৫ সালে নিম্ন আদালতে সর্বোচ্চ সাজার আদেশ পাওয়া আসামিদের মধ্যে সাতজনের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদ- দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি নিম্ন আদালতে যাবজ্জীবন পাওয়া আসামিদের মধ্যে একজনের ক্ষেত্রে সেই দ-ই বহাল রেখেছেন হাইকোর্ট। দ্রুত বিচার আদালতে মৃত্যুদ- অথবা যাবজ্জীবন কারাদ- হয়েছিল এমন ১১ জন হাইকোর্টে আপিল করে খালাস পেয়েছেন। আসামিদের ডেথ রেফারেন্স, জেল আপিল ও আবেদনের ওপর শুনানি শেষে বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথের সমন্বয় গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ গতকাল বুধবার এই রায় দেন।
নি¤œ আদালতের দেয়া মৃত্যুদ- বহাল রয়েছে ৬ জন হলেনÑনুরুল ইসলাম সরকার, নুরুল ইসলাম দিপু (পলাতক), মাহবুবুর রহমান মাহবুব, শহীদুল ইসলাম শিপু (পলাতক), হাফিজ ওরফে কানা হাফিজ (পলাতক), সোহাগ ওরফে সরু।
নি¤œ আদালতের দেয়া রায়ে ৭ জনের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন দেয়া হয়েছে। তারা হলেনÑমোহাম্মদ আলী, সৈয়দ আহমেদ হোসেন মজনু (পলাতক), আনোয়ার হোসেন ওরফে আনু (পলাতক), রতন মিয়া ওরফে বড় মিয়া (পলাতক), জাহাঙ্গীর (পলাতক), মশিউর রহমান ওরফে মশু (পলাতক), আবু সালাম ওরফে সালাম (পলাতক)।
নুরুল আমিনের যাবজ্জীবন বহাল রয়েছে হাইকোর্টে। পলাতক আসামি অহিদুল ইসলাম টিপু আপিল করেননি। তার যাবজ্জীবন সাজাই বহাল। মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামি ছোট রতন ও আল আমিন মারা যাওয়ায় তাদের বিষয়টি নিষ্পত্তি করে দিয়েছেন হাইকোর্ট।
হাইকোর্টে খালাস পাওয়া আসামিরা হলেনÑআমির হোসেন, জাহাঙ্গীর ওরফে বড় জাহাঙ্গীর, ফয়সাল (পলাতক), লোকমান হোসেন ওরফে বুলু (পলাতক), রনি মিয়া ওরফে রনি ফকির(পলাতক), খোকন (পলাতক), দুলাল মিয়া (পলাতক), রাকিব উদ্দিন সরকার ওরফে পাপ্পু, আইয়ুব আলী, জাহাঙ্গীর, মনির।
অভিযোগপত্রে থাকা দুই আসামি কবির হোসেন ও আবু হায়দার ওরফে মিরপুরইয়া বাবু নিম্ন আদালত থেকেই খালাস পান।
বাবা আহসান উল্লাহ মাস্টার হত্যা মামলায় হাইকোর্টের রায়ে ‘পুরোপুরি সন্তুষ্ট’ হতে পারেননি ছেলে জাহিদ আহসান রাসেল। গতকাল বুধবার রায়ের পর আদালত প্রাঙ্গণে সংসদ সদস্য রাসেল হাই কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার কথা জানান সাংবাদিকদের। রাসেল বলেন, ‘হাইকোর্টের এ রায়ে আমরা আংশিক সন্তুষ্ট; পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারিনি। ছয়জনকে মৃত্যুদ- দেওয়া হয়েছে, অন্যদের সাজা কমানো হয়েছে এবং কয়েকজনকে খালাস দেওয়া হয়েছে। যাবজ্জীবন ও খালাসপ্রাপ্তরা এ হত্যায় সরাসরি জড়িত ছিল। ‘আইনের প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল। এ জন্য আমরা উচ্চ আদালতে আপিল করব। আশা করি আপিলে খালাসপ্রাপ্তদের যথাযথ শাস্তি দেওয়া যাবে।’
বাদীপক্ষের আইনজীবী সাজোয়ার হোসেন বলেন, ‘আপিল করার বিষয়ে বাদী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পরবর্তীতে উচ্চ আদালতে লড়ব আমরা।’
আর আসামি নুরুল ইসলাম সরকার ‘নির্দোষ’ দাবি করে তার ভাই বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য হাসান উদ্দিন সরকার বলেছেন, পরে সংবাদ সম্মেলন করে তিনি আপিলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাবেন।
২০০৪ সালের ৭ মে গাজীপুরের টঙ্গীর নোয়াগাঁও এম এ মজিদ মিয়া উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে এক জনসভায় আহসান উল্লাহ মাস্টারকে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়। তার সঙ্গে খুন হন ওমর ফারুক রতন নামে আরেকজন।
মুক্তিযোদ্ধা আহসান উল্লাহ মাস্টার ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে টঙ্গী থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এর আগে তিনি গাজীপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। আওয়ামী লীগের এই নেতা ছিলেন এলাকায় জনপ্রিয় নেতা। আহসান উল্লাহ মাস্টার যখন খুন হন, তখন তিনি জাতীয় শ্রমিক লীগের কার্যকরী সভাপতি। পরে তার আসনের সংসদ সদস্য হন তার ছেলে জাহিদ আহসান রাসেল।
ওই ঘটনার পরদিন নিহতের ভাই মতিউর রহমান টঙ্গী থানায় ১৭ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা আরও ১০/১২ জনকে আসামি করে মামলা করেন।
তদন্ত শেষে এই মামলায় ওই বছরের ১০ জুলাই ৩০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। একই বছরের ২৮ অক্টোবর ৩০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। রাষ্ট্রপক্ষে ৩৪ জন এবং আসামিপক্ষে দুজন সাক্ষ্য দেন। এ মামলায় ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন ২০০৫ সালের ১৬ এপ্রিল রায় ঘোষণা করেন।
ওই রায়ে বিএনপি নেতা নূরুল ইসলাম সরকারসহ ২২ আসামিকে মৃত্যুদ- এবং ছয় আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেওয়া হয়। খালাস পান দুজন।
নিম্ন আদালতের রায়ের পর ২২ আসামির ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদ- অনুমোদন) শুনানির জন্য ২০০৫ সালে হাইকোর্টে আসে। তাদের মধ্যে ১৪ জন দ-াদেশের বিরুদ্ধে আপিল করেন।
মৃত্যুদ-ের বিরুদ্ধে আসামি শহীদুল ইসলাম শিপু ও লোকমান হোসেন হাইকোর্টে পৃথক ফৌজদারি বিবিধ আবেদন করেন, শুধু জেল আপিল করেন মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামি কানা হাফিজ। যাবজ্জীবন কারাদ- পাওয়া পলাতক এক আসামি আত্মসমর্পণ না করায় আপিলের সুযোগ পাননি।
প্রধান বিচারপতি বিষয়গুলো শুনানির জন্য বিচারপতি ওবায়দুল হাসান নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে পাঠালে চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারি শুনানি শুরু হয়। ৩৪তম দিনে ৮ জুন শুনানি শেষে আদালত ১৫ জুন গতকাল রায় ঘোষণার জন্য দিন রাখে। গতকাল রায়ের মধ্য দিয়ে এক যুগ আগে ঘটে যাওয়া নৃশংস ওই হত্যাকা-ের বিচারের পরিসমাপ্তি হয় হাইকোর্টে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন