স্টালিন সরকার : ঋণের সুদের বোঝা টানতেই যেন দেশের ১৬ কোটি মানুষের রক্ত পানি হওয়ার উপক্রম। বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক ঋণের ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের শতকরা প্রায় ১২ টাকা (১১ টাকা ৭০ পয়সা) সুদ দিতে হবে। আর ’৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে ভারত সহায়তার মাধ্যমে বাংলাদেশকে যে ঋণি করেছে; সে ঋণ এখনো শোধ করতে হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের পর ভারতের লুটেরারা বাংলাদেশের বিপুল পরিমাণ সম্পদ লুটে নিয়ে গেছে। শত শত ট্রাক, বিশাল বিশাল জাহাজে করে আমাদের সম্পদ নিয়ে গেছে ভারতের লুটেরারা। বিদেশী সহায়তার অর্থও তুলে নিয়ে গেছে। দেশের মানুষ মনে করে ওই সব সম্পদ নিয়ে যাওয়ায় ’৭১-এর সহায়তা সংক্রান্ত ভারতীয় ঋণ পরিশোধ হয়ে গেছে। অথচ এখনো দিল্লীর রাজনৈতিক অনুকম্পা পেতে আমাদের নেতারা কারণে অকারণে ‘মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ঋণ’ ১৯৭১-এ ভারতের অবদান’ ইত্যাদি স্মরণ করে নতজানু মানসিকতা প্রকাশ করছে। বেরুবাড়ি দেয়া হয়েছে সেই ’৭৪ সালে। অতঃপর পানি চুক্তির নামে দাসখত দেয়া হয়। ভারতকে ট্রানজিট, বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বিদ্যুতের সংযোগ লাইন, সমুদ্র বন্দর ও নৌবন্দর ব্যবহারের সুযোগসহ অসংখ্য সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়েছে। কিন্তু এখনো তিস্তা চুক্তি সম্ভব হয়নি। অভিন্ন ৫৪ নদীর পানি সমস্যার সমাধান হয়নি। টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণ বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। ভারত নিজ দেশে পরিবেশের কথা বিবেচনা করে যে কয়লা বিদ্যুৎ নির্মাণ পরিত্যক্ত ঘোষণা করেছে; সেই কয়লা বিদ্যুৎ সুন্দরবনের রামপালে করা হচ্ছে দুই দেশের যৌথ উদ্যোগে। পরিবেশ মন্ত্রণালয় এখনো ছারপত্র দেয়নি; অথচ প্রকল্পের উদ্বোধন করা হয়েছে। এগুলো কি শুধু মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সহাযতার প্রতিদান? ভারত গরু দিচ্ছে না; আমরা ইলিশ দিচ্ছি কেন? ভারত থেকে কিছুই পাচ্ছি না; অথচ ভারতকে সবকিছুই দিয়ে দিচ্ছি? ক্ষমতাসীন সরকার নিজেদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে না হয় এসব করছে; কিন্তু অন্যান্য রাজনৈতিক দল? যারা ক্ষমতায় নেই তারা এসবের প্রতিবাদ করছেন না কেন? মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী এটাকেই মনে করেছেন মুক্তিযুদ্ধের ঋণের সুদের ঘানি টাকা। জাফরুল্লাহ চৌধুরীর এই হাটেহাড়ি ভাঙ্গার পরও কি আমাদের নেতানেত্রীদের বোধদয় হবে? সুশীলরা কি দিল্লীর লাড্ডু মুখে পুরে ‘বুঁদ’ হয়েই থাকবেন?
মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেছেন, স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের কাছে আমাদের যে ঋণ ছিল তা আমরা আগেই শোধ করেছি; এখন যেটা টানছি সেটা সুদ। ভারত সমৃদ্ধশালী দেশ হওয়ার পরও আমাদের ওপর থেকে সুদ আদায় করে নিচ্ছে; যেমনিভাবে পূর্ব পাকিস্তানের ওপর থেকে পশ্চিম পাকিস্তান জোড়জুলুম করে ২৩ বছর আদায় করেছিল। গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে ‘বাংলাদেশকে মরুভূমি বানানোর ভারতীয় পানি আগ্রাসী নীতি রুখে দাঁড়ান’ শীর্ষক এক প্রতিবাদ সমাবেশে তিনি এসব কথা বলেন। সমাবেশের আয়োজন করে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)। বাসদের সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামানের সভাপতিত্বে আরো বক্তব্য রাখেন সিপিবির সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবু জাফর, বাসদের কেন্দ্রীয় নেতা বজলুল রশিদ ও জাহিদুল হক মিলু প্রমুখ।
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, একটি দেশের সঙ্গে ট্রানজিট হতে পারে। কিন্তু সেটার জন্য দেশের রাস্তাঘাটের যে ক্ষতি হবে সে ক্ষতি পূরণের বিনিময়ে। কিন্তু বর্তমান সরকার ভারতকে যে ট্রানজিট দিয়েছে তা নামমাত্র মাসুলে। তিনি দেশের সুশীল সমাজের সমালোচনা করে বলেন, আগে দেখতাম সরকার দেশবিরোধী কোনো চুক্তি করলে রেহমান সোবহানের মত সুশীল সমাজের লোকেরা সরকারের সমালোচনা করতেন। এখন দেখছি তাদের মুখ বন্ধ। তাহলে কি বুঝবো, ভারতের মুদ্রা দিয়ে তাদের মুখ বন্ধ রাখা হয়েছে? বর্তমান সরকার অগণতান্ত্রিক ও অনির্বাচিত সরকার। এই অনির্বাচিত সরকারকে ভারতই টিকায়ে রেখেছে তাদের নিজেদের স্বার্থে। তিনি ফারাক্কা চুক্তিসহ অন্যান্য চুক্তি বাস্তবায়নের সময় জনগণের স্বার্থের কথা বিবেচনায় নেয়ার জন্য সরকার প্রতি আহ্বান জানান।
দেশে যখন জাতীয় স্বার্থ নিয়ে কথা বলার রাজনৈতিক দল ও মানুষের আকাল; তখন এমন একটি প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তারও চেয়ে অধিক তাৎপর্যপূর্ণ জাফরুল্লাহ চৌধুরীর চে্যঁচাছোলা বক্তব্য। দেশের বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলো যখন ব্যক্তিস্বার্থ ও দলীয় স্বার্থ রক্ষায় ব্যস্ত; ক্ষমতায় থাকা ও ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য দেশী-বিদেশী মুরুব্বীর তোষামোদীর প্রতিযোগিতায় রত; তখন বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ভারতের নৌ ট্রানজিটে মালামাল পরিবহন শুরু হয়েছে। নৌ ট্রানজিট শুরু হয়েছে অথচ কেউ এ নিয়ে উচ্চবাচ্য করছেন না। আশার কথা হলো বাসদসহ বামপন্থী দলগুলো ক্ষীণ কণ্ঠে হলেও প্রতিবাদ করছেন। যদিও কর্পোরেট হাউজ পরিচালিত মিডিয়াগুলো বামপন্থীদের খবর প্রচারে উৎসাহী নন। আর ভারতবিরোধী কর্মসূচি হলে সেটা ব্লাকআউট করার চেষ্টা হয়। এই বাসদ তিস্তার পানি চুক্তির দাবি, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের বিরুদ্ধে, টিপাইমুখে বাঁধের বিরুদ্ধে রোডমার্চ করেছে। কৃষকের উৎপাদিত ধানের ন্যার্য মূল্যের দাবিতে নানান কর্মসূচি পালন করেছে। এ জন্য দলটি দেশবাসীর সাধুবাদ পাবে।
গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী যে বক্তব্য দিয়েছেন তা পর্যালোচনার দাবি রাখে। তিনি বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে সহায়তার ভারতীয় ঋণ শোধ করেছি; এখন সুদ টানছি। বাস্তবতাও তাই। জাফরুল্লাহ চৌধুরী ’৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রেখেছেন। ১৯৭১ সালে তিনি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে ব্রিটেনে বসবাসরত এক হাজারেরও বেশি বাংলাদেশি চিকিৎসক ডা. এএইচ সায়েদুর রহমানকে সভাপতি এবং ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে সাধারণ সম্পাদক করে বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন গঠন করে। ১৯৭১ সালের মে মাসের প্রথম দিকে বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন এবং যুক্তরাজ্য যৌথভাবে ডা. এমএ মোবিন ও ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তার জন্য ভারতে পাঠায়। তারা অস্থায়ী (মুজিবনগর) বাংলাদেশ সরকারের হয়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের মেলাঘরে ৪৮০ শয্যাবিশিষ্ট বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপন করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের ওই হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হতো। হাজার হাজার আহত মুক্তিযোদ্ধার চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন জাফরুল্লাহ চৌধুরীরা। এর আগে লন্ডনে যে কয়দিন ছিলেন সেখানেও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ্যে আন্তর্জাতিক জনমত গঠন করেন। সেই জাফরুল্লাহ চৌধুরী যখন অভিযোগ তোলেন তখন সেটা হেলাফেলার পর্যায়ে থাকে না। বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকীকে যেমন বর্তমান ক্ষমতাসীনরা ‘নব্য রাজাকার’ খেতাব দিয়েছে; রাজনৈতিক কারণে জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে সেই ‘তকমা’ দেয়া যেতে পারে। কিন্তু মানুষ তা বিশ্বাস করবে না। জাফরুল্লাহ চৌধুরী যা বলেছেন তা প্রণিধানযোগ্য। ’৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানীদের আত্মসমর্পণ সভায় কৌশলে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কর্নেল আতাউল গণি ওসমানীকে আসতে দেয়া হয়নি। ভারতীয় বাহিনীর কর্তারা সুক্সক্ষ এক চালে তাকে কুমিল্লা থেকে সিলেটের দিকে পাঠিয়ে দেয়। আর ঢাকার নিয়ন্ত্রণ চলে যায় ভারতীয় বাহিনীর হাতে। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশজুড়ে নজীরবিহীন লুটপাট চালিয়েছে। পরাজিত পাকিস্তানী বাহিনীর ফেলে যাওয়া বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে গেছে ভারতীয়রা। ওই সময় যার মূল্য ছিল ২৭শ’ কোটি টাকা। ভারত ১৫টি বিশাল জাহাজে করে বাংলাদেশ থেকে সে অস্ত্রশস্ত্র কার্যত লুট করে নিয়ে যাওয়া হয়। অথচ সেগুলোর মালিকানা ছিল বাংলাদেশ। বাংলাদেশের শত শত মিল কারখানার যন্ত্রপাতি, ব্যাংক, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের, পাকিস্তানীদের ফেলে যাওয়ার বাসাবাড়ির গৃহস্থলী জিনিসপত্র, স্বর্ণ সবকিছুই নিয়ে যায় ভারতীয় লুটেরারা। এসব সম্পদ ও দ্রব্যাদির ওই সময়ে মূল্য ছিল আনুমানিক ৫ হাজার কোটি টাকা। এমনও শোনা যায় ঢাকার চৌশাগারের বদনাগুলোও ভারতীয় লুটেরাদের হাত থেকে বাদ যায়নি। যুদ্ধকালীন ও যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশের জনগণের জীবনমান উন্নযনে প্রদত্ত বিপুল পরিমাণ অর্থ ও অন্যান্য সাহায্য লুট করে নিয়ে যায় বন্ধুরাষ্ট্র ভারত। মুক্তিযুদ্ধে অন্যতম সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিলের লুটের ভারতীয় ট্রাক থামানোর কাহিনী সবাই জানেন। জলিলের প্রতিবাদ এবং কি কারণে সেনাবাহিনীর চাকরি ছাড়লেন তা এখন ইতিহাস। অতএব, ভারত মু্্্ক্তিযুদ্ধে যে সহায়তা করেছে তার কয়েকগুণ বেশি আসল (সম্পদ) লুট করে নিয়ে গেছে। এখন যা দিতে হচ্ছে তা সুদই বৈকি।
জাফরুল্লাহ চৌধুরী সুশীলদের ভূমিকা প্রসঙ্গে প্রশ্ন রেখে বলেছেন, ‘ভারতের মুদ্রা দিয়ে সুশীলদের মুখ বন্ধ রাখা হয়েছে?’ এ প্রশ্ন দেশের ১৬ কোটি মানুষের। আমাদের দেশের সুশীলদের দেশপ্রেম দেখেছি ’৮০ দশকের মাঝামাঝি সময় এরশাদবিরোধী আন্দোলনে। দেশপ্রেমে বিগলিত সুশীলরা ঢাকার গুলশান-বারীধারাস্থ বিদেশী দূতাবাসগুলোতে দেশের গণতন্ত্র রক্ষার জন্য ধর্ণা দিতেন। জনগণের ভোটের অধিকারের জন্য মায়াকান্না করতেন। গলায় হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে কখনো বিরহের কখনো বিপ্লবের গান গেয়ে গণতন্ত্র রক্ষার কেরাস গাইতেন। অথচ বর্তমানে দেশের গণতন্ত্রের ‘হালচাল’ তাদের চোখে পড়ে না। জনগণের ভোটের অধিকার তাদের আহত করে না। কারণ আর কিছু নয় দিল্লী যাদের ক্ষমতায় রাখতে চেয়েছে তারাই এখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়। স্বাধীনতার পর ৪৪ বছরে ভারত আর বাংলাদেশের বন্ধুত্বের সম্পর্ক শুধুই কাগজে-কলমে। বাস্তবে ভারতের আগ্রাসী নীতি এবং আমাদের নেতানেত্রীদের তাঁবেদারী মানসিকতার কারণে বাংলাদেশ ৪৪ বছরে শুধু ভারতকে দিয়েই গেছে; কিছুই পায়নি। কিন্তু রেহমান সোহবানের মতো বরেণ্য ব্যাক্তিত্ব ও তাঁবেদারী বুদ্ধিজীবীরা খামোশ। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল ও ক্ষমতালিপ্সু নেতানেত্রীরা কার্যত দিল্লীর তাঁবেদারীর প্রতিযোগিতায় নামায় দুই দেশের বন্ধুত্বের সম্পর্ক কার্যত সাহেব-গোলামের সম্পর্কে রূপ লাভ করেছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারীর নির্বাচনের আগে ওই সময়ের ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং-এর বক্তব্যে তার প্রতিফলন ঘটেছে। শুধু তাই নয়, বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর বড় দুই দলের দৌড়ঝাঁপ, বিজেপি নেতা অমিত শাহকে ফোন করা নিয়ে বড় দুই দলের কা--কারখানায় তার প্রমাণ মেলে। ভারতের বিএসএফ সীমান্তে বাংলাদেশীদের হত্যা করলে সরকারি দলের মন্ত্রীরা প্রচার করেন ওরা গরু চোরাচালানিকে মেরেছে। যারা মাঠের বিরোধীদল হিসেবে পরিচিত তারা মুখে কুলুপ এঁটে থাকেন। দিল্লী গোসসা করেন সেই ভয়ে টঠস্থ থাকেন। আর যারা বর্তমান সংসদে বিরোধীদল হিসেবে রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছেন তারা লেন্দুপ দর্জিকেও হার মানিয়ে হয়েছেন রাজনৈতিক ভাঁড়। তিস্তা চুক্তি নিয়ে যুগের পর যুগ ধরে কথাবার্তা হচ্ছে। তিস্তা চুক্তি হচ্ছে না। উত্তরাঞ্চলের নদীগুলো পানির অভাবে মরুভূমিতে পরিণত হওয়ার উপকৃম হয়েছে। পানির অভাবে অসংখ্য নদী হারিয়ে গেছে। অভিন্ন ৫৪ নদীর পানির কোনো সুরাহা হচ্ছে না। টিপাইমুখে বাঁধ দিয়ে উজান থেকে পানি সরিয়ে নিয়ে বৃহত্তর সিলেট জেলাকে পরিত্যক্ত ভূমিতে পরিণত করার অপচেষ্টা চলছে। বাংলাদেশের নিজস্ব সম্পদ ফেনি নদী থেকে অবৈধভাবে মেশিন বসিয়ে পানি উঠিয়ে নিচ্ছে ভারত। এ সব নিয়ে কোনো কথা বলছে না রাজনৈতিক দলগুলো। তাদের আশঙ্কা দিল্লী অখুশি হলে কারো বর্তমানে ক্ষমতায় থাকা কঠিন হবে; আবার কারো আগামীতে ক্ষমতায় যাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।
ভৌগলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ভারতকে ট্রানজিট বা করিডোর দেয়া বিপজ্জনক। কারণ বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ভারতের ৭ রাজ্যের বিভিন্ন জাতি-উপজাতি ও গোষ্ঠী স্বাধীনতার দাবিতে আন্দোলন করছে। তাদের আন্দোলন দমাতে ভারত যদি বাংলাদেশের ওপর দিয়ে অস্ত্র-গোলাবারুদ নিয়ে যায়; আর সেটা যদি ওই স্বাধীনতাকামীরা বুঝতে পারেন তাহলে বাংলাদেশের জনগণ তাদের টার্গেটে পরিণত হবে। তারপরও দেশের মানুষের নিরাপত্তার কোনো তোয়াক্কা না করেই ভারতকে ট্রানজিট দেয়া হলো। কিন্তু বাংলাদেশ ট্রানজিটের যথাযথ মাসুল নেয়া হচ্ছে না। অথচ ভারতীয় ট্রাকের বাংলাদেশের রাস্তাঘাট যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে তা মেরামতে বিপুল পরিমাণ অর্থ প্রয়োজন।
জনগণের চাপে পড়ে ভারতকে ট্রানজিট দেয়ার আগে সার্বিক বিবেচনা করে মাসুল নির্ধারণের জন্য বাংলাদেশ সরকার একটি কমিটি গঠন করে। কিন্তু ওই কমিটির মাশুলের সুপারিশ মানা হয়নি। ভারত, নেপাল ও ভুটানকে সড়ক, রেল ও নৌপথে ট্রানজিট দিতে ২০১১ সালে ট্যারিফ কমিশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান মজিবুর রহমানের নেতৃত্বে কোর কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটির নৌপথে টনপ্রতি ১০৫৮ টাকা ফি নির্ধারণ করে প্রতিবেদন দেয়। ওই প্রতিবেদনে ট্রানজিটের সম্ভাব্যতা, পণ্য পরিবহনের প্রবাহ, বিনিয়োগসহ সব বিষয়ে হিসাব-নিকাশের ভিত্তিতে মাশুল নির্ধারণ করা হয়। তারা সরকারকে জানান, এই মাসুল গ্রহণ বাস্তবসম্মত। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর দু’জন উপদেষ্টা সে সময় বলেন, ভারতের কাছে ট্রানজিটের মাসুল নেয়া উচিত নয়। ভারত নাকি আমাদের মেহমান। গোলাম আর কাকে বলে! অতপর ওই হিসেবের পাঁচ গুণের কম ট্রানজিট মাসুল নির্ধারণ করা হয়। প্রতি মেট্রিক টন পণ্যের জন্য শুল্ক ফি ১৩০ টাকা, রোড চার্জ প্রতি কিলোমিটারে ৫২ টাকা ২২ পয়সা, বন্দর ব্যবহারের জন্য ১০ টাকা বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। অর্থাৎ প্রতি মেট্রিক টন পণ্যে ১৯২ টাকা মাসুল নির্ধারণ করা হয়। প্রশ্ন হলোÑ বাংলাদেশের যে সব সরকারি কর্মকর্তা ১০৫৮ টাকা থেকে মাসুল কমিয়ে ১৯২ টাকা নির্ধারণ করলেন তারা বাংলাদেশের স্বার্থ দেখেছেন না ভারতের? তারা কি গণপ্রজাতন্ত্র বাংলাদেশের কর্মচারী না ভারতের কর্মচারী? মাসুল নির্ধারণে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীই কি জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে দেশের স্বার্থ বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন না দিল্লীকে খুশি করতে বেশি তৎপর?
নৌ ট্রানজিট চালু হওয়ায় গতকাল ভারতীয় জাহাজ বাংলাদেশের নৌ সীমানায় প্রবেশ করে এবং আশুগঞ্জে পৌঁছায়। অতপর জাহাজটি থেকে পণ্য খালাসের মাধ্যমে নৌ ট্রানজিটের উদ্বোধন করেন বাংলাদেশের নৌ পরিবহন মন্ত্রী। আশুগঞ্জ বন্দরে ভারত থেকে আসা ওই পণ্য খালাস করার পর বাসযোগে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে আগরতলায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। নৌ সচিব অশোক মাধব রায় জানান, ভারতের সাতটি বন্দর থেকে পণ্য আসবে বাংলাদেশের আশুগঞ্জ বন্দরে। বাংলাদেশ থেকে সড়ক পথে পণ্য ভারতে যাবে। যেহেতু ভারত একটি বন্দর থেকে অন্য বন্দরে পণ্য পাঠাবে, তাই ভারতই ঠিক করবে কোন পণ্য ট্রানজিট হবে। হায়রে বাংলাদেশের সরকারী কর্মকর্তা! গোলামী আর কাকে বলে? বাংলাদেশের বুকের ওপর দিয়ে পণ্য যাবে অথচ ভারতই ঠিক করবে কোন পণ্যের মাসুল দেয়া হবে? তাহলে কি বাংলাদেশের ওই বন্দরে ভারতের নিরাপত্তা রক্ষীরা দায়িত্ব পালন করবেন? উল্লেখ্য, ১৯৭২ সালে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তিতে ট্রানজিটের বিষয়টি উল্লেখ ছিল। ওই চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ ’৭৪ সালে বেরুবাড়ি ভারতের হাতে তুলে দিলেও দীর্ঘ ৪০ বছর পর ভারত সীটমহল চুক্তির বাস্তবায়ন করে। এখনো চুক্তি অনুযায়ী তিনবিঘা করিডোর বাংলাদেশকে দেয়নি। ভারতের সঙ্গে ’৯৮ সালে যে ৩০ বছরের পানি চুক্তি হয়েছে তার কার্যকারিতা কার্যত নেই। পানি দেয়া হচ্ছে সর্বনিম্ন পর্যায়ে। এমনকি সব আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করে ভারত তিস্তার উজানে বাঁধ দিয়ে পানি সরিয়ে নিচ্ছে। ভারতের নিজের স্বার্থে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ট্রানজিট প্রয়োজন। এই ট্রানজিটসহ নানা সুবিধার জন্যই কার্যত ভারত ’৭১ এ বাংলাদেশকে সহায়তা করেছে। ২০১০ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে গেলে ট্রানজিটের বিষয়টি আবার আলোচনায় আসে। তবে ফি নির্ধারণ, অবকাঠামো দুর্বলতাসহ নানা সমালোচনার কারণে ট্রানজিট নিয়ে কেউ আর এগোয়নি। ২০১৫ সালের জুনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরে এলে এই চুক্তি সংশোধন করা হয়। এরপর গত বছর দিল্লিতে মাসুল নির্ধারণের বিষয়টি চূড়ান্ত হয়। জানা যায়, ভারতের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে দুই দেশের আলোচনার মাধ্যমে ট্রানজিটের রুট নির্ধারণ করা হয়। ভারতের চেন্নাই, কৃষ্ণপত্তম, বিশাখাপত্তম, কাশিনাদা, প্যারা দ্বীপ, হলদিয়া ও কলকাতা নৌবন্দর থেকে পণ্যবাহী জাহাজ ভিড়বে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, মংলা, খুলনা, পায়রা, নারায়ণগঞ্জ, পানগাঁও ও আশুগঞ্জ বন্দরে। বন্দর থেকে পণ্য খালাস হলে বাংলাদেশি ট্রাক সেই পণ্য নিয়ে যাবে ভারতে। পণ্যের শুল্ক, সড়ক ও বন্দর ব্যবহারের জন্য তিনটি পর্যায়ে ফি বা মাসুল নির্ধারণ করা হয়েছে। জাফরুল্লাহ চৌধুরীর কথাই ফিরে আসতে হয়। মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে সেই ৩৫ বছর আগে। সেই যুদ্ধে সহায়তার ঋণ শোধের পর আর কতদিন সুদের ঘানি টানতে হবে এদেশের ১৬ কোটি মানুষকে? বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে কি শুধু ভারতের স্বার্থ দেখার জন্য?
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন