ঢাকার সাভারে বিভিন্ন অপরাধম‚লক কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে উঠতি বয়সের কিশোররা। ইভটিজিং থেকে শুরু করে চুরি, ছিনতাই, মাদক বিক্রি, মাদক সেবন, অপহরণ, এমনকি হত্যাকান্ডের সাথেও রয়েছে তাদের সম্পৃক্ততা। এলাকাভিত্তিক ছোট-বড় গ্যাং তৈরি করে এসব অপরাধমূলক কর্মকান্ড করে বেড়াচ্ছে কিশোর সন্ত্রাসীরা। এদের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে বাসিন্দারা। উঠতি বয়সি এ ‘মাস্তানদের’ পাশাপাশি সাভারে সন্ত্রাসী ও টপটেররদের দৌরাত্ম্যও বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব সন্ত্রাসীর হাতে রয়েছে বিভিন্ন দেশি-বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র।
উপজেলায় বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ড বৃদ্ধি পাওয়ায় এসব কিশোর গ্যাং সদস্যদের তথ্য সংগ্রহ করছেন মাঠপর্যায়ের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রায়ই কিশোর গ্যাং-এর কবলে পড়ে নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে অনেককেই। অনেকেই তাদের ভয়ে প্রশাসনের কাছে অভিযোগ কিংবা কথা বলতেও সাহস পান না। রোববার রাতে সাভার পৌর এলাকার কাতলাপুর মহল্লায় কিশোর গ্যাং এর হামলার শিকার হন ওই এলাকার বাসিন্দা কামরুল ইসলাম। পরে পুলিশ ও স্থানীয়দের সহায়তায় তিনি রক্ষা পান। কামরুল ইসলাম জানায়, কিশোর গ্রুপটি বেশ কিছুদিন ধরে তার কাছে চাঁদা দাবি করছিল। চাঁদা না দেয়ায় রোববার রাত আনুমানিক ৯টার দিকে বাড়ির সামনে একা পেয়ে তার ওপর হামলা করে। হামলা ও মারধরে আহত হয়ে তিনি সাভার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রাথমিক চিকিৎসাও নিয়েছেন। এ ঘটনার পরদিন সোমবার বিকালে কামরুল ইসলাম বাদি হয়ে কিশোর গ্যাং এর সদস্য শুভ, মনির, সুজন, সাকিব, বুলেট ওরফে আনান, সাগর, ফারুক, মাহাবুব, জামিল, রেজাউলসহ অজ্ঞাতনামা আরও কয়েক জনের বিরুদ্ধে সাভার মডেল থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দেন।
অভিযোগের তদন্ত কর্মকর্তা সাভার মডেল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) নুরুল ইসলাম বলেন, কিশোর গ্যাং এর এ গ্রুপটির প্রধান হচ্ছে কাতলাপুরের শুভ। শুভ’র এ গ্রুপের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নিলে তারা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবে এবং যে কোন অঘটন ঘটাতে পারে বলেও তিনি ধারণা করছেন। এর আগে গত ১০ সেপ্টেম্বর দুপুরে সাভারের কাউন্দিয়ার নদী পারাপারের নৌ-ঘাটে বেসরকারি প্রাইম ইউনিভার্সিটির এক ছাত্র নাহিদ হাসান মিলুকে ছুরিকাঘাতে হত্যার চেষ্টা করে কিশোর গ্যাং সদস্যরা। আহত নাহিদ কাউন্দিয়ার মো. মিজান হোসেনের ছেলে। পরে রক্তাক্ত জখম অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে ঢাকা সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে স্বজনরা।
নাহিদের চাচা শফিক হোসেন জানান, ঘটনার দিন দুপুর আনুমানিক ১২টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মিরপুর এক নম্বর হয়ে নৌকায় করে সাভারের কাউন্দিয়া আসে নাহিদ। নৌকা থেকে নামার মুহূর্তেই তার ওপর ঝাঁপিয়ে পরে ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায় কয়েক কিশোর। ওই ঘটনায় নাহিদ হাসান মিলুর মা নার্গিস আক্তার বাদি হয়ে সাভার মডেল থানায় একটি মামলা করেন। ঘটনার এক সপ্তাহ পর ১৮ সেপ্টেম্বর পুলিশ হামলার ঘটনায় জড়িত কিশোর গ্যাং এর চার সদস্য কাওছার, নিবির, ইমরান ও শফিউলকে গ্রেফতার করে। তাদের সকলের বয়স ১৫ হতে ১৮।
তদন্ত কর্মকর্তা সাভার মডেল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) প্রাণকৃষ্ণ অধিকারী বলেন, কিশোর গ্যাং-এর চার সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ঘটনায় জড়িত অন্যদেরও গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। কাউন্দিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আতিকুর রহমান খান শান্ত জানান, কিশোর গ্যাং সদস্যরা ফেইসবুকে একাধিক গ্রæপের সদস্য এবং মাদকসহ নানা অপরাধ কর্মে জড়িত। ব্যবস্থা না নিলে এরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারে।
কিশোর গ্যাংয়ের আরেক দলনেতা পৌর এলাকার কাতলাপুরের ওমর আলীর ছেলে তপু। তার নিরাপদ আস্তানা হচ্ছে ভাগলপুর কোল্ড স্টোরেজের ভিতরে। তার দলের অন্য সদস্যরা হচ্ছে নাহিদ, আকাশ, রুদ্র, রবিন, মতিউরসহ আরও কয়েকজন। এ গ্যাংটি কোল্ড স্টোরেজের ভিতরে মাদক ব্যবসাসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ড করে বেড়াচ্ছে। তাদের দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ ভাগলপুরের বাসিন্দারাও। সম্প্রতি এই গ্যাং এর বিরুদ্ধে সাভার মডেল থানায় একটি সাধারণ ডাইরিও করা হয়। এ গ্যাংটিকে ধরতে সাভার মডেল থানা পুলিশ ও ডিবি পুলিশ একাধিকবার অভিযান চালানোর পর তারা কয়েকদিন আত্মগোপনে ছিল। সম্প্রতি আবারও তাদের দেখা যাচ্ছে।
সাভার মডেল থানার পরিদর্শক (অপারেশন) মো. জাকারিয়া হোসেন বলেন, মাদক সন্ত্রাসী তপুসহ তার সহযোগীদের গ্রেফতার করে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এদিকে গত ১ মার্চ সন্ধ্যায় সাভার সিআরপির ভিতরে কিশোর গ্যাংয়ের ছুরিকাঘাতে মো. সোহাগ (১৬) নামে এক কিশোর নিহত হয়। সে চাপাইন স্টুডেন্ট স্কুল অব বাংলাদেশের ৮ম শ্রেণির ছাত্র। হামলাকারি কিশোর গ্যাং এর সদস্য মিঠুও একই স্কুলের ৯ম শ্রেণির ছাত্র। পরে পুলিশ তাকে আটক করে নিয়ে যায়।
এলাকাবাসির অভিযোগ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নাকের ডগায় এসব অপর্কম হলেও অনেকসময় ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছে এসব সন্ত্রাসীরা। রাজনৈতিক ছত্রছায়া, এলাকার কথিত বড় ভাইদের অনুচর হিসেবে সক্রিয় থাকছে এসব উঠতি বয়সি মাস্তান। এলাকাভিত্তিক গড়ে তোলা হচ্ছে ছোট-বড় অপরাধী গ্যাং। তাদের কাছে রয়েছে ধারালো অস্ত্র ও আগ্নেয়াস্ত্র।
অনেকেই নিজেদের স্বার্থের জন্য অপরাধ কর্মকান্ডে কিশোরদের ব্যবহার করেন। ফলে এক সময় কিশোররা পরিবারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। তখন শুধু পাড়া-পড়শিরাই নয়, নিজের পরিবারের জন্যও তারা বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। তাই অল্পতেই তাদের নিয়ন্ত্রণ না করলে অচিরেই একেক এলাকার জন্য কিশোর গ্যাং আতঙ্ক হয়ে উঠবে বলে মনে করেন সচেতন মহল।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন