মাহবুুবুর রহমান নোমানি
পবিত্র রমজানের বিশেষ একটি ইবাদত তারাবির নামাজ। বিভিন্ন হেকমতের কারণে তারাবিকে রোজার মতো ফরজ করা হয়নি। এ ব্যাপারে হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, এক রাতে রাসূলুল্লাহ (সা.) মসজিদে গিয়ে সাহাবাগণকে নিয়ে নামাজ আদায় করেন। পরদিন সাহাবায়ে কেরাম পরস্পর তা নিয়ে বলাবলি করলে দ্বিতীয় রাতে মুসল্লিদের সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পেল। নবীজী (সা.) সবাইকে নিয়ে নামাজ আদায় করেন। সকালে সাহাবাগণ বিষয়টি নিয়ে পরস্পর আলোচনা করলে ওই রাতে মুসল্লির সংখ্যা প্রচুর বেড়ে যায়। এভাবে তৃতীয় বা চতুর্থ রাতে এতো অধিক মুসল্লির সমাগম হলো যে, মসজিদের ভেতর-বাহির লোকে লোকারণ্য হয়ে গেল। তখন রাসূল (সা.) আর মসজিদে আসেননি। সকালে ফজরের নামাজ আদায় শেষে বললেন, তোমাদের আগমন সম্পর্কে আমি অবগত ছিলাম; কিন্তু আমি আশংকা করছি, এ নামাজ তোমাদের ওপর ফরজ করে দেয়া হবে, যা আদায়ে তোমরা অক্ষম হয়ে পড়বে। (সহিহ বোখারি : ২০১২)
রাসূলূল্লাহ (সা.) তারাবির নামাজ উম্মতের ওপর ফরজ হওয়ার আশংকায় নিয়মিত জামাত কায়েম করেননি। বরং অধিকাংশ সময় একাকী পড়েছেন। সাহাবাগণ মসজিদের বিভিন্ন স্থানে ছোট ছোট জামাতে তারাবি পড়তেন। কেউ কেউ একাকীও পড়তেন। এ ব্যাপারে হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, ‘রমজানের এক রাতে রাসূলুল্লাহ (সা.) ঘর থেকে বের হলেন। তিনি কয়েকজন সাহাবাকে মসজিদের এক পার্শ্বে নামাজ আদায় করতে দেখে বললেন, এরা কারা? বলা হলো, এরা কোরআন পড়তে জানে না। তাই উবাই ইবনে কাব এদেরকে নিয়ে নামাজ আদায় করছেন। তখন তিনি বললেন, ওরা সঠিক কাজ করছে। (সহিহ ইবনে হিব্বান:২৮২)
নবীজী (সা.)-এর যুগে, তাঁর খলিফা আবুবকর (রা.)-এর খেলাফতকালে এবং হজরত উমর (রা.)-এর খেলাফতের শুরুতে তারাবির অবস্থা এই রকমই ছিল। অর্থাৎ এক ইমামের পেছনে জামাতবদ্ধ করার প্রয়োজন মনে করা হয়নি। অতঃপর রমজানের কোনো এক রাতে খলিফা উমর (রা.) মসজিদে গমন করে দেখলেন, মসজিদের বিভিন্ন স্থানে ছোট ছোট জামাত হচ্ছে। তিনি চিন্তা করলেন, সকলকে এক ইমামের পেছনে একত্র করে দিলে ভাল হয়। তখন তিনি এই আদেশ জারি করেন এবং উবাই ইবনে কাবকে ইমাম বানিয়ে দেন। (বোখারি:২০১০) এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট হাদিস ব্যাখ্যাতা ইবনে আব্দুল বার বলেন, খলিফা উমর (রা.) এখানে নতুন কিছু উদ্ভাবন করেননি। তিনি তা-ই করেছেন যা রাসূল (সা.) পছন্দ করতেন। রাসূল তো ফরজ হওয়ার আশংকায় জামাতের ব্যাপারে জোর দেননি। হজরত উমর (রা.) দেখলেন, রাসূলের ইন্তেকালের পর সেই আশংকা আর নেই। (যেহেতু ওহির দরজা বন্ধ হয়ে গেছে) বস্তুত আল্লাহ এই মর্যাদা তাঁর জন্যেই নির্ধারিত করে রেখেছিলেন। কোনো সাহাবি উমরের এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা বা অপছন্দ করেননি। সায়েব ইবন ইয়াজিদ (রা.) বলেন, ‘সাহাবা ও তাবেয়ীগণ উমর (রা.)-এর যুগে ২০ রাকাত তারাবি পড়তেন। (সুনানে বায়হাকি:২/৪৯৬) বিখ্যাত তাবেয়ী ইমাম আতা ইবনে আবি রাবাহ (রহ.) বলেন, ‘আমি লোকদেরকে দেখেছি, তাঁরা বিতরসহ ২৩ রাকাত পড়তেন। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা:২/২৮৫) উল্লেখ্য, ২০ রাকাত তারাবি হজরত উমর (রা.) চালু করেননি। তিনি কেবল জামাতে তারাবি পড়ার ব্যবস্থা করেছেন। বিশ রাকাত তারাবি রাসূলুল্লাহ (সা.) থেকেই প্রমাণিত। এ ব্যাপারে হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সা.) রমজান মাসে ২০ রাকাত তারাবি ও বিতর পড়তেন। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা:২/২৮৮, সুনানে বায়হাকি:২/৪৯৬, তাবারানি:১১/৩১১)
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর যুগে যেহেতু তারাবির নামাজ জামাতের পড়ার বাধ্যবাধকতা ছিল না বিধায় এর রাকাত সংখ্যা নিয়ে আলোচনায় আসেনি। কিন্তু যখন মসজিদে নববীতে গুরুত্বের সাথে একই ইমামের পেছনে তারাবির নামাজ আরম্ভ হয় এবং শত শত মানুষ উপস্থিত হতে থাকেন তখন আর এর রাকাত-সংখ্যা অস্পষ্ট থাকেনি। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, নামাজের রাকাত সংখ্যা কিয়াস বা যুক্তি দ্বারা নির্ধারণ করা যায় না। এজন্য শরিয়ত প্রতি নামাজের রাকাত কত হবে তা নির্ধারণ করে দিয়েছে। হ্যাঁ, নফল নামাজের রাকাত শরিয়ত নির্ধারিত করে দেয়নি। যার যত ইচ্ছা পড়তে পারবে। কিন্তু তারাবির নামাজ তো নিছক নফল নয়, বরং সুন্নাতে মুয়াক্কাদা। যার ব্যাপারে রাসূল (সা.) অত্যাধিক গুরুত্বারোপ করেছেন এবং অসংখ্য ফজিলত ঘোষণা করেছেন। তাই নফল নামাজের নিয়ম এখানে প্রয়োগ সম্ভব নয়। সুতরাং বলতেই বলে সাহাবাগণ তারাবির নামাজের রাকাত সংখ্যা নবীজী থেকেই গ্রহণ করেছেন। তাছাড়া হাদিস ও ফিকহের মূলনীতি হলো- কোনো সাহাবির নির্দেশনা যা কিয়াস বা ইজতেহাদের ভিত্তিতে হতে পারে না তা রাসূলুল্লাহ (সা.) থেকেই গ্রহণকৃত ধরা হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন