মঙ্গলবার ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

কথিত বন্দুকযুদ্ধে তোলপাড়

প্রকাশের সময় : ২০ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১১:৪৬ পিএম, ১৯ জুন, ২০১৬

স্টালিন সরকার : কথিত বন্দুকযুদ্ধ ও ক্রসফায়ার শব্দ দুটি এখন টক অব দ্য কান্ট্রি। পুলিশ রিমান্ডে থাকা ফাইজুল্লাহ ফাহিম ‘কথিত বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হওয়ায় আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে গেছে এ দুটি শব্দ। সবখানে এ ঘটনা নিয়ে শুরু হয়েছে তীব্র বিতর্ক। এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক এবং সর্বত্রই চলছে তোলপাড়। পুলিশের প্রতি সবার সন্দেহের দৃষ্টি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, টুইটার, ব্লগ ও পাঠক মতামতে এ ঘটনায় প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা করেছে প্রশ্নবিদ্ধ। বেশিরভাগ মানুষই বিস্ময় ও উদ্বেগ প্রকাশ করে কথিত বন্দুকযুদ্ধকে ‘পুলিশের আষাঢ়ে কাহিনী’ হিসেবে অবিহিত করেছেন। সরকারের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, সাধারণ মানুষ, সুশীল সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞরা এ ঘটনাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ‘ক্রসফায়ারের কিচ্ছা’ হিসেবে অবিহিত করেছেন। কেউ কেউ এ ঘটনাকে অপরাধীদের আড়াল করার চেষ্টা বলে মত দিচ্ছেন। কেউ কেউ শর্ষের ভেতর ভূতের প্রতিচ্ছবি দেখছেন। টিভির টকশোগুলোতে এ নিয়ে পুলিশের তীব্র সমালোচনা করা হয়। এমনকি ক্ষমতাসীন দলের অনুগত বুদ্ধিজীবী, ১৪ দলীয় জোটের শরীক দলের নেতা এবং ক্ষমতার উচ্ছিষ্টভোগীদের অনেকেই ‘কথিত বন্দুকযুদ্ধ’ এবং ‘ক্রসফায়ার’ নিয়ে তির্যক মন্তব্য করেছেন। সরকারের বন্ধুস্থানীয় মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল স্পষ্টভাবেই বলেছেন, ‘রাষ্ট্র আইন নিজের হাতে তুলে নিয়েছে।’ গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকারের প্রশ্নÑপুলিশ কাকে আড়াল করতে এই কথিত বন্দুকযুদ্ধ করেছে? ১৪ দলের শরীক জাসদ নেতা মঈনুদ্দিনর খান বাদলও কথিত বন্দুকযুদ্ধের তীব্র প্রতিবাদ করে বিবৃতি দিয়েছেন। পরিস্থিতি যে খুবই খারাপ তা বুঝতে পেরে ১৪ দলীয় জোটও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে। সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রীরা আশ্বস্ত করেছেন, পরিস্থিতি শীঘ্রই স্বাভাবিক হবে। পুলিশ রিমান্ডে থাকা ফাইজুল্লাহ ফাহিম কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহতের ঘটনা মিডিয়ায় যখন তোলপাড়, তখনই বিজ্ঞানবিষয়ক লেখক ব্লগার অভিজিৎ হত্যা মামলার আসামী শরিফুল ঢাকার খিলগাঁও মেরাদিয়া বাঁশপট্টিতে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়। এর আগে পুলিশের পক্ষ থেকে আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের সদস্য চিহ্নিত জঙ্গি শরিফুল ওরফে সাকিব ওরফে শরিফ ওরফে সালেহ ওরফে আরিফ ওরফে হাদী-১ সম্পর্কে তথ্যদাতাকে ৫ লাখ টাকা পুরস্কারের ঘোষণা দেয়া হয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, দেশে গত সাড়ে তিন বছরে কথিত বন্দুকযুদ্ধ/ক্রসফায়ার এবং পুলিশের হেফাজতে ৪৫৬ জন ব্যক্তি নিহত হন। এর মধ্যে ২০১৩ সালে ৭২ জন, ২০১৪ সালে ১২৮ জন, ২০১৫ সালে ১৮৩ জন এবং চলতি বছরের এ পর্যন্ত ৭৩ জন কথিত বন্দুকযুদ্ধে বা পুলিশ হেফাজতে নিহত হয়। সব ‘কথিত বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ারের’ গল্প ছিল প্রায় অভিন্ন। পুলিশের রিমান্ডে থাকাবস্থায় মাদারীপুরে কথিত বন্দুকযুদ্ধে গোলাম ফাইজুল্লাহ ফাহিম নিহত হবার প্রতিক্রিয়ায় বিবিসি বাংলাকে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেছেন, বাংলাদেশে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী রিমান্ডের সময় আইনজীবী বা পরিচিত কারো উপস্থিতির বিধান থাকলেও সেটা মানা হচ্ছে না। দেশে কারো কোন সন্দেহ নেই যে পুলিশ তাদের ইচ্ছাকৃতভাবে কথিত বন্দুকযুদ্ধে মেরে ফেলছে। ২০০৪-০৫ সালে হয়তো কেউ কেউ পুলিশের ক্রসফায়ারের কিচ্ছা বিশ্বাস করতো, এখন কেউ বিশ্বাস করে না। তিনি উচ্চ আদালতের নির্দেশনা না মেনে নি¤œ আদালদের রিমান্ড মঞ্জুরের তীব্র সমালোচনা করেন। বাংলা ভিশনের টকশোকে ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা বলেন, ক্রসফায়ার গত ১৫ থেকে ২০ বছরের পুলিশের একটি ধারাবাহিক গল্প। যে গল্পের কাহিনী, দৃশ্য, চরিত্র, অংক কোনো কিছুরই পরিবর্তন হয়নি। ক্রসফায়ার বিষয়টা হচ্ছে একটি বিশেষ অভিযানে কখনো কখনো অপরাধীর সাথে পুলিশের কথিত বন্দুকযুদ্ধ হয়; যে যুদ্ধে পুলিশ নিজের প্রাণ বাঁচানোর জন্য গুলি করে। তখন ওই গুলিতে অপরাধীর কেউ মারা যায়। এমন একটি গল্প আমরা দীর্ঘদিন ধরে শুনে আসছি। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো তদন্তে পুলিশকে অপরাধী হিসেবে দেখানো হয়নি। এমনকি আজ পর্যন্ত কোনো পুলিশ ক্রসফায়ারে মারা গেছে এ রকম দেখিনি। এক অপরাধ বিশেষজ্ঞ এ প্রসঙ্গে বলেন, আমেরিকায় প্রতিবছর ক্রসফায়ারে অপরাধীরা মারা যায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যও মারা যায়। অথচ বাংলাদেশে শুধু একপক্ষ মারা যায়, অন্যপক্ষ্যের গায়ে আঁচর লাগে না। নিহত ব্লগার অভিজিৎ রায়ের বাবা অধ্যাপক অজয় রায় বলেছেন, আমি শেখ হাসিনা সরকারের কাছে আবেদন রাখব, দাবি রাখব, এই অন্যায় এবং হত্যার অপরাধীদের বিচারের কাঠগড়া দাঁড় করাতে হবে। তাদেরকে উপযুক্ত শান্তি প্রদান করতে হবে। আমরা যে বিচারহীনতার কৃষ্টি বা সংস্কৃতি গড়ে তুলছি, এ থেকে বাইরে বেরিয়ে আসতে হবে।
কথিত বন্দুকযুদ্ধ ও ক্রসফায়ারের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে গতকাল ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) যুগ্মকমিশনার আব্দুল বাতেন বলেন, ‘পুলিশ আত্মরক্ষার্থে গুলি চালায়। তখন এসব প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। এসব আসামি বেঁচে থাকলে তদন্তে সুবিধা হতো। তাদের দিয়ে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়ানো যেত। তবে আমার মনে হয় না, এতে মামলার তদন্তে বড় কোনও সমস্যা হবে। কারণ অন্যান্য আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ ও জবানবন্দির ভিত্তিতে মামলার তদন্ত এগিয়ে চলে।’
২০০৪-২০০৫ সালে কথিত বন্দুকযুদ্ধ ও ক্রসফায়ারের প্রচলন শুরু হলেও জনগণের চাপ ও প্রতিবাদে ক্রমান্বয়ে সেটা কমে আসছিল। তবে মিডিয়ার খবরে প্রকাশ রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং আইনশৃঙ্খলার অবনতির থেকে উত্তরণের জন্য গত সাড়ে তিন বছরে ৪৫৬ জন ক্রয়ফায়ার ও কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়। কথিত বন্দুকযুদ্ধ ও ক্রয়ফায়ার কিছুদিন বন্ধই ছিল। হঠাৎ করেই যেন বেড়ে গেছে ‘কথিত বন্দুকযুদ্ধ’। গত ১৩ দিনে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন ১৭ জন। এর মধ্যে ৭ জন জঙ্গি সদস্য বলে দাবি করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বাকিরা ডাকাত সদস্য ও বিভিন্ন হত্যা এবং অস্ত্র মামলার আসামি। চলতি মাসের ৭ তারিখে পৃথক ঘটনায় ৪ জন নিহত হয় কথিত বন্দুকযুদ্ধে। এদের মধ্যে ৩জন নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠনের সদস্য বলে দাবি করেছে পুলিশ। অপর একজন ডাকাত সদস্য। ৮ জুন বগুড়া ও যশোরে পৃথক দুই কথিত বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় দুজন নিহত হন। ৯ জুন রাজধানী ঢাকা ও গাইবান্ধায় পৃথক কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় তিনজন। এদিন রাজধানীর রামপুরায় এবং টঙ্গীতে র‌্যারেব সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে ২ জন নিহত হয়। ১১ জুন নড়াইলের লোহাগড়ায় পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে রাকিব নামে এক ডাকাত সর্দার নিহত হয়। ১৪ জুন জয়পুরহাটে পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় সোহেল ও মনিরুজ্জামান মনির নামে দুই যুবক। ১৫ জুন যশোর, পাবনা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পৃথক কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন তিনজন। ১৮ তারিখে মাদারীপুরে একজন এবং ১৯ তারিখে ঢাকায় একজন কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়।
কথিত বন্দুকযুদ্ধে ফাহিম নিহতের ঘটনাকে আষাঢ়ে গল্প হিসেবে অবিহিত করে ফেসবুকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনু মুহাম্মাদ লিখেছেন, বুলেপপ্রুফ জ্যাকেট, হেলমেট থাকার পরও ফাহিম কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে। পুলিশ বলছে, তার বুকের বাঁ পাশে দুটি গুলির চিহ্ন পাওয়া গেছে। এই আশঙ্কটাই করছিলাম। শিক্ষক রিপন চক্রবর্তীর ওপর হামলাকারী ফাহিমকে রিমান্ডে নিয়ে কথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে খুন করা হলো। এখন আর কোনো প্রমাণ নেই, সুতরাং নানা কাহিনী চালিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে। কেউ ধরা না পড়লে যথারীতি অনেক গল্প শুনতাম, কিন্তু গোল বাঁধিয়েছে এলাকার মানুষ ফাহিমকে হাতেনাতে ধরে। ফাহিম কিছুটা সূত্র দিতে পারতো নিশ্চয়ই। যারা ফাহিমের মতো কিশোর তরুণদের গুম করে এসব অপারেশনে যেতে বাধ্য করে, তাদের পক্ষে এ রকম অবস্থায় বসে থাকলে চলে না। গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার ফেসবুকে লেখেন, একদিকে সরকার নিজদলীয় সিরিয়াল খুনিদের ফাঁসিসহ সকল সাজা মওকুফ করে দিয়ে জেল থেকে মুক্ত করছে। অন্যদিকে জনতার হাতে ধরাপড়া টার্গেট কিলারদের খুন করে সব প্রমাণ আড়াল করছে! তাহলে সাধারণ মানুষ যাবে কোথায়? এর নাম কি ন্যায়বিচার? কথিত বন্দুকযুদ্ধের তীব্র সমালোচনা করে প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী ফেসবুকে লিখেছেন, ‘বন্দুক তুমি যুদ্ধ চেন, তদন্ত চেন না।’ সাংবাদিক গোলাম মোর্তোজা ফেসবুক লিখেছেন, ‘ফাহিম হত্যাকা-ই উত্তর, কারা দেশে জঙ্গি টিকিয়ে রেখে সুবিধা পেতে চায়।’ গত কয়েক মাস ধরে চালানো একের পর এক হত্যাকা-ের মতো একই কায়দায় মাদারীপুরের কলেজ শিক্ষক রিপন চক্রবর্তীকে হত্যা চেষ্টার সময় ফাহিমকে হাতেনাতে ধরে ফেলে প্রত্যক্ষদর্শীরা। অতপর তাকে পুলিশে দেয়া হয়। মানুষ মনে করছিল, তার কাছ থেকে ধারাবাহিক হত্যাকা- ও জঙ্গিবাদ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাবে। ১০ দিন রিমান্ড নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরুর ১৫ ঘণ্টার মধ্যেই সে ক্রসফায়ারে নিহত হবার পর এ নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, কথিত ‘কথিত বন্দুকযুদ্ধে’ এই হত্যা বড় কোনো কিছুকে আড়াল করার চেষ্টা নয়তো? অপরাধ বিশেষজ্ঞা বলছেন ফাহিমকে আটকের মাধ্যমে জঙ্গিদের কাজের ধরন, মনস্তত্ত্ব, উদ্দেশ্য, প্রণোদনা ইত্যাদি সম্পর্কে জানার একটি সুযোগ তৈরি হয়। কিন্তু কথিত বন্দুকযুদ্ধ সব সম্ভাবনা ধূলিস্বাত করে দিচ্ছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিচালক নূর খান লিটন বলেন, আটক ফাহিম ৫-৬ জন সহযোগীর নাম দেয় এবং তাকে অবজারভেশনে রাখতে পারলে হয়ত আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানতে পারতো। বিবিসি বাংলাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে নূর খান লিটন বলেন, পুলিশের সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া দরকার আটক ব্যক্তির নিরাপত্তা। সেটি তারা কতটুকু করেছেন সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। যেহেতু জঙ্গিদের ব্যাপারে বাংলাদেশের তথ্যভা-ারে খুব বেশি তথ্য নেই, তাই মনে করেছিলাম ঘটনা ঘটানোর সময়ই প্রায় বলতে গেলে সে ধরা পড়েছে, তার কাছ থেকে হয়ত অনেক তথ্য আগামী দশ দিনে আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পাবে। জনমনে সন্দেহ থেকে যাবে বড় কিছুকে আড়াল করার জন্য এই ঘটনা ঘটেছে কিনা। ফাহিমের পরিবারের সদস্যরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। ফাহিমের নিহত হওয়ার খবরে তার বাবা-মা আক্ষেপ করে বলেন, আমাদের সন্তান যদি জঙ্গি কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত থাকে, তার বিচার চাই। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, তাকে কথিত বন্দুকযুদ্ধের মতো নাটক সাজিয়ে হত্যা করতে হবে। এখন পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থা থেকে চাপ দেওয়া হচ্ছে যে, এ ব্যাপারে কেউ যেন গণমাধ্যমের কাছে কোনো মন্তব্য না করে। বর্তমান সরকারের একান্ত অনুগত প্রবাসী সাংবাদিক ফজলুল বারী ফেসবুকে লিখেছেন, আমাদের ভালো ইচ্ছেগুলোকে করে দেওয়া হচ্ছে প্রশ্নবিদ্ধ! ফাহিম ছেলেটির রিপোর্টে পড়ছিলাম আদালতে বিচারককে সে চিৎকার করে বলে এই ঘটনার সঙ্গে সে জড়িত না। স্থানীয় এক নেতা তাকে ফাঁসিয়ে দিয়েছেন। সাধারণত কোনও জঙ্গি এভাবে কোর্টে বলে না। কিন্তু পুলিশ তাকে মেরে ফেললো ক্রসফায়ারে? স্থানীয় যে নেতার কথা ফাহিম বলেছিল, সে কি পুলিশের জন্য বিব্রতকর ছিল? মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী লিখেছেন, একের পর এক হত্যাকা-ের যখন সুরাহা করা যাচ্ছিল না, তখন ফাহিম গ্রেফতার হওয়ায় বেশকিছু তথ্য পাওয়া যাবে এমন আশা ছিল দেশবাসীর। সেই স্থলে এই কথিত বন্দুকযুদ্ধের কী মানে? হাজার হাজার পাঠক বিভিন্ন অনলাইন মিডিয়া ও দৈনিকের অনলাইন সংস্করণের কথিত বন্দুকযুদ্ধে ফাহিমের নিহতের খবরে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তারা পুলিশের বক্তব্যকে অগ্রহণযোগ্য এবং পাতানো নাটক হিসেবে অবিহিত করেছেন। কেউ কেউ বলেছেন, প্রতিটি ক্রসফায়ার ও কথিত বন্দুকযুদ্ধের পর একই ভাবে বক্তব্য দেয় পুলিশ। অথচ সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে না কোথায় ক্রসফায়ারের গোলাগুলি হলো। আমজনতা আশ্বস্ত হতে পারছে না পুলিশের কথায়। শুধু সাধারণ মানুষ নয়, ক্ষমতাসীন দলের সুবিধাভোগী এবং তল্পিবাহক বুদ্ধিজীবী, সুশীল এবং ১৪ দলীয় জোটের নেতারাও কথিত বন্দুকযুদ্ধ সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করছেন। কেউ কেউ আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দক্ষতা যোগ্যতা এবং নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। মঈনুদ্দিন খান বাদলের দাবি, কথিত বন্দুকযুদ্ধের নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া উচিত। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান ক্রসফায়ার ও কথিত বন্দুকযুদ্ধকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- হিসেবে অবিহিত করেছেন। তিনি এ সব ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত চেয়েছেন। অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন বলেছেন, যারা অপরাধী তাদেরও বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে।
কথিত বন্দুকযুদ্ধ ও ক্রসফায়ার ইস্যুতে দেখা যাচ্ছে পুলিশ বাহিনীর প্রতি দেশের অধিকাংশ মানুষের আস্থা নেই। অথচ আমাদের এই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনেক সাফল্য রয়েছে। র‌্যাবের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে জঙ্গিনেতা বাংলাভাই ধরা পড়ে এবং তাকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়। শায়খ আবদুর রহমানকে গ্রেফতার করে বিচারের মাধ্যমে ফাঁসি দেয়া হয়। শুধু তাই নয়, র‌্যাব-পুলিশের সম্মুখযুদ্ধে জেমএবির অনেক রাঘব-বোয়াল গ্রেপ্তার হন তাদের কারো বিচার হয়েছে; কেউ এখনো বিচারের মুখোমুখি। গণতন্ত্র, ভোটের অধিকার না থাকায় দেশে আইন শৃঙ্খলাজনিত সংকট, জঙ্গীবাদী তা-ব এখন চরম পর্যায়ে। বিদেশীদের চক্রান্তে জঙ্গীবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে এবং একের পর এক গুপ্তহত্যা ঘটছে। অথচ দেশের শতকরা ৯৯ ভাগের বেশি মানুষ জঙ্গিবিরোধী এবং এ ধরনের হত্যা-গুপ্তহত্যাকে সমর্থন করে না। মূলত হত্যা কিংবা গুপ্তহত্যা ক্রসফায়ার কিংবা কথিত বন্দুকযুদ্ধ, কোনোভাবেই চলমান সমস্যার সমাধান দিতে পারবে না। বরং কেউ হত্যা-গুপ্তহত্যা অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের পথ বেছে নিলে তার ফল ভবিষ্যতের জন্য আরো কোনো গভীর সংকট ডেকে আনতে পারে। ভারতের নকশার নিধণের অভিজ্ঞতা আমরা দেখেছি। একটি গণতান্ত্রিক শাসন কাঠামোর প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, জনগণের ভোটের অধিকারের পাশাপাশি বিচার বিভাগকে শক্তিশালী করা এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। বাংলাদেশে যদি বিচার বিভাগ শক্তিশালী না হয়, ন্যায়বিচার নিশ্চিত না হয় তাহলে বাংলাদেশের গণতন্ত্র বিপন্ন হবে; জঙ্গিবাদের উলঙ্গ নৃত্য হবেই। অপরাধ বিশেষজ্ঞ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) সাখাওয়াত হোসেন লিখেছেন, জঙ্গীবাদ শুধু আইনশৃঙ্খলাজনিত সংকট নয়। এটা রাজনৈতিক সংকট। রাজনৈতিকভাবে এ সংকটের মোকাবিলা করতে হবে। আওয়ামী লীগ নেতা প্রখ্যাত পার্লামেন্টারিয়ান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সম্প্রতি ‘যমুনা’ নামের এক টিভি চ্যানেলে বলেছেন, বাংলাদেশের জঙ্গি সংকট শুধু প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে সুরাহার চেষ্টা হচ্ছে। এতে সংকটের সমাধান হবে না। এ জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক ও সামাজিক পদক্ষেপ। ২০১৫ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ভ্যাটের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারনা করে ছাত্র আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। ফেসবুক-ব্লগ-টুইটারের মাধ্যমে সংগঠিত আন্দোলন ও মতামতের ভিত্তিকে সরকার বাধ্য হয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের বেতনের শতকরা সুদে ৭ ভাগ ভ্যাট প্রত্যাহার করে নেয়। ক্রসফায়ার ও কথিত বন্দুকযুদ্ধের প্রতিবাদে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে বিতর্ক ও প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে তার সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের দৃষ্টিগোচর হবে এমন প্রত্যাশা সবার। ১৪ দলীয় জোটের মানববন্ধনে গতকাল বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমদ বলেছেন, পুলিশ দেশকে শীঘ্রই স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে আসবে। দেশের মানুষ তেমনটাই চায়।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
আজমল ২০ জুন, ২০১৬, ২:২৯ পিএম says : 0
সুলতানা কামাল ঠিকই বলেছেন, ‘রাষ্ট্র আইন নিজের হাতে তুলে নিয়েছে।’
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন