শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ইসলামী জীবন

মুসলিম উম্মাহর মুক্তি কোন পথে

মাওলানা আহমদ মুমশাদ আলী নদভী | প্রকাশের সময় : ৮ নভেম্বর, ২০১৯, ১২:০৩ এএম

॥ শেষ ॥

পৃথিবীতে সাধারণত উন্নত দেশ ও জাতিগুলোর মূল্যায়ন করা হয়। বিশেষ করে যারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈশ্বিক উন্নয়নে ইতিবাচক অবদান রাখে, অন্যরা তাদের মডেল হিসেবে গ্রহণ করে। জাপান, জার্মানি এবং ইসরাইল যুদ্ধবিগ্রহে পর্যদুস্ত হওয়ার পরও তারা পুনরায় ঘুরে দাঁড়িয়ে বিশ্বের সামনে নিজেদের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছে। শ্রদ্ধা ও সম্মানের জায়গায় তারা সবার কাছে নিজেদের গ্রহণীয় ও বরণীয় করে তুলেছে। অথচ এর বিপরীতে আমরা রাজনৈতিক ব্যর্থতার ওপর আফসোস করেই কয়েক শতাব্দি কাটিয়ে দিয়েছি। এখনও এখানে সেখানে এই মাতম চলে।
যে উম্মতকে তাদের নবী ‘ওপরের হাত উত্তম’ হওয়ার সবক শিখিয়েছেন তারা আজ রিক্তহস্ত হয়ে ভিক্ষার থলে নিয়ে ধারে ধারে ঘুরে বেড়ায়। আমরা সামনে অগ্রসর হওয়ার পরিবর্তে আত্মরক্ষায় ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছি। কারণ পরনির্ভরতা আত্মরক্ষার মানসিকতাই তৈরি করে। এর মাধ্যমে নিজ পায়ে ঘুরে দাঁড়ানোর সাহস ও আত্মবিশ্বাস তৈরি হয় না। অন্যদিকে দাওয়াত ইলাল্লাহ স্বনির্ভর ও অগ্রগামী হওয়ার শক্তি যোগায়। নিজ পায়ে ঘুরে দাঁড়ানো শেখায়। যে উম্মতকে পৃথিবীতে দাঈ হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে তারা আজ অন্যের দাওয়াতের পাত্র হতে লজ্জাবোধ করে না। যাদেরকে শিক্ষক হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে তারাই কিনা আজ ছাত্র সেজে বসে আছে! এরচেয়ে আত্মহননকারী নির্বোধ আর কে হতে পারে! যাদেরকে অন্যের পথপ্রদর্শক হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে তারা আজ পথিক হয়েও চলতে পারছে না।
আমাদের হাত থেকে এত বড় শাসন ব্যবস্থা ছুটে যাওয়ার এটাই কারণ যে, আমরা আমাদের কর্তব্য ভুলে গেছি। আমরা রাজপ্রাসাদ ও অট্টালিকা সাজাতে এত ব্যস্ত ছিলাম যে, মানুষকে সাজাতে আমরা সময় পাইনি। আমরা প্রাসাদের অন্দরমহল রাঙিয়েছি ঠিকই কিন্তু মানুষের ভেতরের মনুষ্যত্বকে রাঙাইনি। আমাদের প্রতি নির্দেশ ছিল মানুষের চিন্তা-চেতনা ও হৃদয়রাজ্য জয় করার, কিন্তু আমরা ব্যস্ত ছিলাম রাজ্যের সীমানা বি¯তৃতিতে। ফলফল এটাই দাঁড়িয়েছে, স্পেনের যে আলহামরার মিনারচূড়া থেকে আল্লাহু আকবারের সুমধুর ধ্বনি ভেসে আসত সেই আলহামরায় আমাদের শাসন ব্যবস্থার কবর রচিত হয়েছে।
জার্মানি, জাপান, চিন এবং ইসরাইলের ইতিহাস থেকে আমাদের কি কিছুই শেখার নেই, যারা একবার সর্বস্ব হারিয়ে পুনরায় ঘুরে দাঁড়িয়েছে? পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যান্য জাতির ভাগ্যেও কি উত্থান-পতন আসেনি? তারা কি এমন প্রতিকুল পরিবেশে লাঞ্ছনা, বঞ্ছনা ও পরাজয়ের ঘøানি নিয়ে বসে ছিল, না কি অতীত ব্যর্থতা ও পরাজয় পিছনে ফেলে স্বমহিমায় নিজেদের অস্তিত্বের কথা জানান দিয়েছে?
মহান আল্লাহ তাআলা পৃথিবীতে বিভিন্ন জাতির চেষ্টা, সাধনা, শ্রম-কুরবানী ও আগ্রহের ভিত্তিতেই তাদেরকে সফলতা ও ব্যর্থতা দান করেন। এ নিয়ম তিনি কখনও পরিবর্তন করেননি এবং এক্ষেত্রে কাউকে ছাড় দেননি। কথা হলো, অন্যান্য জাতি যদি চেষ্টা-সাধনা ও শ্রম দিয়ে সফলতার স্বর্ণ শিখরে আরোহন করতে পারে, তাহলে আমরা কুরআন-হাদীসের ধারক-বাহকরা কেন আমাদের সফলতার পথ ও পন্থা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি না? সৌভাগ্যক্রমে আমরা কখনও কোনো পথ খুঁজে পেলেও আমাদের গন্তব্যস্থল কোথায় তা বলতে পারি না।
আসল কথা হলো, মুসলমানদের সফলতা ও ব্যর্থতা আল্লাহ তাআলা পৃথিবীর বুকে তাঁর কালেমার আওয়াজ ছড়িয়ে দেয়ার সাথে সম্পৃক্ত করেছেন। ‘ইলায়ে কালিমাতুল্লাহ’র এই মহান জিম্মাদারি থেকে যখনই আমরা পিছনে সরে গিয়েছি তখনই আমাদের ক্ষমতা, কর্তৃত্ব, স্বকীয়তা, সফলথা ও মর্যাদা অন্যের হাতে কুক্ষিগত হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের হাতে যদি ইসলামি খেলাফত চলেও আসে তবুও আমরা দীনের প্রচার-প্রসার ও কালিমার দাওয়াত দেয়া ছাড়া সেটা বেশি দিন টিকিয়ে রাখতে পারব না। রাজনীতি ও ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে আমাদের শক্তিশালী অবস্থানই সব সমস্যা সমাধানের একমাত্র উপায় নয়। হ্যাঁ, এটা সহযোগী হিসেবে কাজ করতে পারে। হিন্দুস্তানের মুঘল সম্রাটগণ এবং অন্যান্য দেশের মুসলিম শাসকরা যদি নিজ নিজ খেলাফতকালে দাওয়াতের ফরয দায়িত্ব গ্রহণ করে মানুষকে সত্যের পথে ধরে রাখতে পারত, তাহলে হয়তো আজ আমাদেরকে এমন বৈরি পরিস্থিতির শিকার হতে হতো না।
এই মুহুর্তে মুসলমানদের জন্য খুবই জরুরী হলো, প্রত্যেক মুসলমান নিজেকে দীনের একজন সৈনিকরূপে সাজিয়ে যামানার কা-ারী হিসেবে আবির্ভূত হওয়া। ক্লান্তশ্রান্ত তৃষ্ণার্ত মানবতা অতীতে যেমন ইসলাম ও মুসলমানদের মাধ্যমে শান্ত ও সিক্ত হয়েছে, আজও ঠিক একইভাবে শান্ত ও সিক্ত হবে। এছাড়া ভিন্ন কোনো উপায় নেই। মারামারি ও হানাহানি শুধু ঘৃণার পথই প্রশস্ত করে। এর মাধ্যমে কাজের কাজ কিছুই হয় না, বরং দাওয়াতের পথ রুদ্ধ হয়। আমাদের উচিৎ, অন্যের কাছে হাত পাতার মানসিকতা ছেড়ে গঠনমূলক এবং ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে অন্যকে কিছু দেয়ার চেষ্টা করা। এই নিয়তেই একজন দাঈ ও শিক্ষক দাওয়াতের ময়দানে আসবে যে, আমাদের হাত ধরেই তৃষ্ণার্ত মানবতা আবার সিক্ত হবে। শিক্ষা, সংস্কৃতি, চরিত্র ও উন্নতির ক্ষেত্রে অতীতে অবদান রেখে আমরা যেভবে মানবতাকে সভ্যতা ও মনুষ্যত্বের পথ দেখিয়েছি, ঠিক একইভাবে সে কাজ আমরা এখনও করব। তৃষ্ণার্ত মানবতার জন্য আমাদের প্রয়োজনীয়তা এখনও ফুরিয়ে যায়নি, কিন্তু শর্ত হলো আমাদের নিজেদেরকে সেভাবে প্রস্তুত করতে হবে।
অনুবাদ: মুহাম্মাদুল্লাহ আরমান
উর্দু মাসিক আরমোগান থেকে অনূদিত

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন