রাজধানীর রূপনগরে গ্যাস বেলুন বিস্ফোরণের ঘটনায় ১০ দিন অতিক্রান্ত হলেও এখনো কান্না থামেনি হতাহতদের স্বজনদের। ওই ঘটনায় শিশুসহ অন্তত ৬ জন এখনো গুরুতর অবস্থায় হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছেন। বিস্ফোরণে কারো হাত উড়ে গেছে। আবার কারো এক চোখ কারো বা দুই চোখই পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। অধিকাংশ রোগীর চিকিৎসা সরকারি হাসপাতালে চললেও দামি ওষুধের সবই বাইরে থেকে কিনতে হচ্ছে। এর বাইরে হাসপাতালের ভেতরে সামান্য ব্যান্ডিজ করাতে গেলেও ঘুষ দিতে হয় ৫০০ টাকা। ঘুষ না দিলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সিরিয়ালে অপেক্ষা করলেও মেলে না চিকিৎসা। হতাহতদের বেশিরভাগই নি¤œ আয়ের পরিবারভুক্ত হওয়ায় বর্তমানে চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া তাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়েছে। আদরের সন্তান ও স্বজনদের চিকিৎসা করাতে গিয়ে নিঃস হয়ে গেছে অসহায় এসব পরিবার। এ অবস্থায় নিজেদের চোখের সামনে পরিবারের সদস্যদের এমন করুণ অবস্থা দেখে ভেঙে পড়েছেন তারা নিজেরাও। গত বৃহস্পতিবার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহত ও তাদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে এসব বিষয় জানা গেছে।
এর আগে গত ৩০ অক্টোবর বিকেলে মনিপুর স্কুলের রূপনগর শাখার বিপরীত দিকে ১১ নম্বর সড়কে (শিয়ালবাড়ি বস্তির পাশে) এক ভায়বহ গ্যাস বেলুন বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে শিশুসহ ৭ জন নিহত ও প্রায় ২০ জন আহত হয়।
গত বৃহস্পতিবার ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ইমার্জেন্সি ও ক্যাজুয়ালটি বিভাগে গিয়ে দেখা মেলে কয়েকজনের সঙ্গে। ওই বিভাগের ১০১ নম্বর ওয়ার্ডের ২৩ নম্বর বেডে পুলিশি প্রহরায় চিকিৎসাধীন রয়েছেন বেলুন বিক্রেতা আবু সাঈদ। দুর্ঘটনার পরপরই পুলিশ পাহারায় তার চিকিৎসা চলছে। বিস্ফোরণের ঘটনায় রূপনগর থানায় হওয়া মামলার একমাত্র আসামি এই বেলুন বিক্রেতা। কাছে গিয়ে দেখা গেল, একটু পর পর ব্যাথায় চিৎকার করে উঠছেন তিনি। ব্যাথা কমাতে ব্যথানাশক ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে। তার পাশেই স্বামীর এমন কষ্ট দেখে কিছুক্ষণ পর পর কেঁদে উঠছিলেন সাঈদের স্ত্রী।
ওই ওয়ার্ডে দায়িত্বরত পুলিশ কনস্টেবল মনোয়ার হোসেন বলেন, সাঈদের শারীরিক অবস্থা আগের চেয়ে ভালো। তবে এক হাতে এখনো কিছুটা সমস্যা আছে। আপাতত তাকে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। সাঈদের এক প্রতিবেশী বলেন, শুক্রবার অপারেশন হওয়ার কথা। বাঁ হাতের আঙুল কেটে ফেলে দিতে হবে বলে চিকিৎসকরা তাদেরকে জানিয়েছেন। এই প্রতিবেশী বলেন, সাঈদ নিজেই গরীব মানুষ। বেলুন বিক্রি করে কোন রকমে সংসার চলতো। হাসপাতাল থেকে কিছু কিছু ওষুধ দিলেও অনেক ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে হয়। তিনি অভিযোগ করে আরও বলেন, এখানে টাকা ছাড়া কোনো চিকিৎসা পাওয়া যায় না। সামান্য ব্যান্ডেজ করাতেও গেলেও পাঁচশ’ টাকা দিতে হয়। টাকা না দিলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সিরিয়ালে অপেক্ষা করলেও ডাক পড়ে না।
বেলুন বিক্রেতা সাঈদের মতো একই ওয়ার্ডের ১২ নম্বর বেডে চিকিৎসাধীন রিকশাচালক জুয়েল সরদার। ব্যাথার যন্ত্রণায় কিছুক্ষণ পর পর কাঁদছিলেন তিনি। সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে জুয়েল সরদার বলেন, বেলুন বিক্রেতাকে দেখে বাচ্চারা খুব আবদার করলে তিনি নিজেই বেলুন কিনতে যান। কিন্তু বেলুনওয়ালা তার কাছে গ্যাস নেই বলে সিলিন্ডারের ভেতরে ছাইয়ের মত কিছু একটা ঢুকায়। তিনিও বিষয়টি দাঁড়িয়ে দেখতে থাকেন। এর মধ্যে কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হল। কিছুক্ষণ পর দেখেন তিনি রাস্তায় পড়ে আছেন। তার বাঁ হাত ভেঙে গেছে। তিনি আরও বলেন, গত মঙ্গলবার তার ভাঙা হাতে অস্ত্রোপচার করেছেন চিকিৎসকরা। এই কষ্টের মধ্যেও সান্ত¡না খুঁজে তিনি বলেন, ভাগ্যিস আমার বাচ্চাগুলা আমার সাথে ছিল না। নিজের কষ্ট সহ্য করতে পারতেছি, কিন্তু ওদের কিছু হইলে বাঁচতাম না।
ঢাকা মেডিক্যালের জরুরী ভবনের পাশেই বার্ন ইউনিটে গিয়ে দেখা মেলে গৃহকর্মী জান্নাত বেগমের সঙ্গে। বিস্ফোরণে তার ডান হাত উড়ে গেছে। স্ত্রীর পাশে থাকা জান্নাতের স্বামী রিকশাচালক নজরুল ইসলাম বলেন, সেদিন বিকালে জান্নাত বাজার করতে যাচ্ছিলেন। পাশেই ঘটনাটি ঘটে। বিস্ফোরণে ওই জায়গাতেই তার ডান হাত শরীর থেকে আলাদা হয়ে যায়। এখান বার্ন ইউনিটে চিকিৎসা চলছে। গত মঙ্গলবার বিকালে জরুরী বিভাগ থেকে তাদেরকে বার্ন ইউনিটে ট্রান্সফার করা হয়েছে। অপারেশন লাগবে কিনা চিকিৎসকরা কিছুই জানায়নি। তিনি বলেন, হাসপাতাল থেকে প্রতিদিন কিছু ওষুধ আর ইনজেকশন দিচ্ছে। তবে বাইরে থেকেও কিনতে হয়। তাদের পাঁচ বছর বয়েসি একটি মেয়ে রয়েছে। রূপনগর বস্তির এক প্রতিবেশীর বাসায় মেয়েটিকে রেখেছেন বলে তিনি জানান।
বিস্ফোরণের শিকার মিজান নামের ৬ বছরের আরেক শিশু চিকিৎসাধীন রয়েছে ঢাকা মেডিক্যালের জরুরী বিভাগের নিবির পর্যাবেক্ষণ কেন্দ্রে (আইসিউতে)। বিস্ফোরণে শিশুটির নাড়িভুড়ি বের হয়ে গেছে। তার অবস্থা খুবই আশঙ্কাজনক। সন্তানের চিন্তায় দিশেহারা বাবা রোকন মিয়া। ছেলের চিকিৎসায় নিজের সম্ভল যেটুকু ছিল তা অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। শিশুটির খালা আনোয়ারা বেগম বলেন, আমরা গরীব মানুষ। ওষুধ কিনতে কিনতে আমাদের জান শেষ হওয়ার অবস্থা। কারো পক্ষ থেকে কোন ধরণের সহযোগিতাও করা হচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, হায়াত-মৃত্যু আল্লাহর হাতে। কিন্তু চিকিৎসাটুকু শেষ পর্যন্ত চালাতে পারলে নিজেদের মনকে বুঝ দেওয়া যেত।
এদেিক, বিস্ফোরণের ঘটনায় এক চোখ হারানো ৬ বছরেরর শিশু মোস্তাকিনের চিকিৎসা চলছে আগারগাঁওয়ের শেরেবাংলা নগরের জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে। শিশুটি রূপনগরের ৯ নম্বর রোড এলাকার একটি স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে পড়ত। তার বাবা স্থানীয় একটি প্লাস্টিক কারখানায় কাজ করেন।
সন্তানের পাশে থাকা মোস্তাকিনের বাবা মফিজুর রহমান বলেন, তার ছেলের ডান চোখ পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। ডান পাও ভেঙে গেছে। এছাড়া শরীরের অনেকটা অংশ পুড়ে গেছে । আজ শনিবার শিশুটির অস্ত্রোপচার হওয়ার কথা রয়েছে।
বিস্ফোরণের ঘটনায় দুই চোখ হারানো আরেক শিশু জনির চিকিৎসা চলছে শ্যামলীর একটি চক্ষু হাসপাতালে। রূপনগরের স্থানীয় মাদরাসায় পড়–য়া ৮ বছরের জনির বাবা সুলতান মিয়া একটি রিকশার গ্যারেজে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। নিজের সন্তানের করুণ অবস্থা নিয়ে এই বাবা বলেন, বিস্ফোরণের ঘটনায় জনির দুটি চোখ পুরোপুরি নষ্ট হওয়া ছাড়াও মুখের অনেকটা অংশ পুড়ে গেছে। ঘটনার পর তিনদিন ছেলেটি অচেতন অবস্থায় ছিল। এখন হুশ ফিরলেও সব সময় কান্নাকাটি করে।
মন্ত্রণালয়ের চার সুপারিশ
রূপনগর বিস্ফোরণের পর এ ধরনের দুর্ঘটনারোধে সরকারের কাছে চার দফা সুপারিশ করেছে বিস্ফোরক পরিদর। বিস্ফোরক পরিদফতরর প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক মো. সামসুল আলম বলেন, ওই ঘটনা তদন্ত করে গত বুধবার বিদুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে । হাইড্রোজেন ভর্তি বেলুন নিষিদ্ধ করণেও সুপারিশ করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, বেলুনের জন্য কস্টিক সোডা ও এলুমিনিয়াম পাউডার নিয়ে হাইড্রোজন গ্যাসের রিঅ্যাক্টর বানায় এক শ্রেণির হকার। সেরকম একটি সিলিন্ডারই রূপনগরে বিস্ফোরিত হয়েছে।
পরিদপ্তরের পক্ষ থেকে সুপারিশের মধ্যে রয়েছে- শিশু কিশোরদের জন্য হাইড্রোজেন বেলুন ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। অভিভাবকদের সতর্ক করতে হবে। হাইড্রোজেন বেলুন বিক্রেতাদের পেলেই থানায় সোপর্দ করতে হবে। হাইড্রোজেন বেলুন নিষিদ্ধ করা যায় কিনা-সেটাও ভেবে দেখার সুপারিশ করেছে পরিদপ্তর।
প্রসঙ্গত, গত ৩০ অক্টোবর বিকেলে মনিপুর স্কুলের রূপনগর শাখার বিপরীত দিকে ১১ নম্বর সড়কে শিয়ালবাড়ি বস্তির পাশে একটি রিকশা ভ্যানে গ্যাস বেলুনের সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়। এতে সাত শিশুর মর্মান্তিক মৃত্যু হয় এবং অন্তত ২০ জন আহত হয়। ঘটনার পর রূপনগর বেলুন বিক্রেতাকে একমাত্র আসামি করে রূপনগর থানায় একটি মামলা করা হয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন