স্থাপত্য শিল্পের অন্যতম প্রাচীন নিদর্শন শংকরপাশা শাহী মসজিদ। মসজিদটি সুলতানী আমলের স্থাপত্য নিদর্শনগুলোর মধ্যে অন্যতম। এটি হবিগঞ্জ জেলার সদর উপজেলার উচাইল ও রাজিউড়া গ্রামের মধ্যবর্তী শংকরপাশা গ্রামে অবস্থিত। হবিগঞ্জ জেলার রাজিউরা ইউনিয়নের উচাইল গ্রামে প্রায় ৬ একর জমি জুড়ে অবস্থিত কালের সাক্ষী এ মসজিদটি। এটি একটি টিলার ওপরে নির্মিত বলে অনেক দূর থেকে সহজেই দর্শনার্থীদের নজরে পড়ে। এটি সবার দৃষ্টি আকর্ষণের অন্যতম কারণ হলো এর চমৎকার নির্মাণশৈলী। উন্নতমানের পোড়া ইট কেটে সেঁটে দেওয়া হয়েছে ইমারতে। এর গায়ে কোনো প্রলেপ নেই। দেয়ালের বাইরের অংশে পোড়া ইটের ওপর বিভিন্ন নকশা এবং অলঙ্করণ সহজেই মুসল্লি ও দর্শনার্থীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মসজিদের সঙ্গে রয়েছে একটি শিলালিপি। যা প্রাচীনকালের সাক্ষী বহন করে চলছে। মসজিদটি লাল রঙের বলে অনেকে এটাকে ‘লাল মসজিদ’ও বলে থাকেন। আবার টিলার ওপরে বলে অনেকে ‘টিলা মসজিদ’ও বলেন। দুটোকে মিলিয়ে অনেকে ‘লাল টিলা মসজিদ’ও বলেন। তবে যে নামেই ডাকা হোক না কেন, সবাই সহজেই এ মসজিদটিকে চিনতে পারেন।
ইউকিপিডিয়ায় পাওয়া তথ্য মতে প্রায় সাড়ে পাঁচশো বছর আগে ১৪৯৩ সালে এ মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। তবে স্থানীয় বয়োজ্যেষ্ঠদের মতে এ মসজিদটি প্রায় সাতশো বছর আগে নির্মাণ করা হয়। সেই সময়কার স্থানীয় হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় প্রতিহিংসার শিকার হয়ে মসজিদটির ব্যাপকভাবে ক্ষয়ক্ষতি হলে বিভিন্ন সময়ে খুব সুন্দর করে এর পুনর্র্নিমাণ করা হয়। মসজিদের পুনর্র্নিমাণের কাজ সম্পন্ন হয় ১৯১৩ সালে। মসজিদটির বর্তমান রূপ হচ্ছে পুনর্র্নিমাণ করা পরের রূপ। ইউকিপিডিয়ার তথ্য মতে জানা যায়, মসজিদটি নির্মাণের শুরুতে হাত দেন বিখ্যাত সুফি দরবেশ শাহ মজলিশ আমিন (রা.)। এখানে তিনিই প্রথম মসজিদটি স্থাপন করেন। তবে মতান্তরে, তিনি এ মসজিদের পুনর্র্নিমাণে হাত দেন। পরবর্তীতে এই মসজিদের সুদৃশ্য ইমারত বা ভবন নির্মাণ করা হয় মুসলিম বাংলার স্বনামধন্য শাসনকর্তা সুলতান আলাউদ্দিন হোসাইন শাহের আমলে। ইমারতটির দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ একই মাপের, যা ২১ ফুট ৬ ইঞ্চি। বারান্দা তিন ফুটের সামান্য বেশি। এটিকে চার গম্বুজ মসজিদও বলা হয়ে থাকে। কেননা মূল ভবনের ওপর একটি বড় বা বিশাল গম্বুজ এবং বারান্দার ওপর দেখতে পাওয়া যায় তিনটি ছোট গম্বুজ। দরজা-জানালা আছে প্রায় ১৫টি। দরজা ও জানালা প্রায় একই আকৃতির। সব দিকের দেয়ালের পুরত্বই বেশি। খুব মজবুত করে মসজিদের নির্মাণ কাজ করা হয়ে ছিল। যেন কোন শত্রুর আক্রমণে মসজিদটি ধ্বংস না হয়। মসজিদের তিন দিকের দেয়ালের পুরুত্ব প্রায় পাঁচ ফুট, আর পশ্চিম দিকের দেয়ালের পুরুত্ব এর প্রায় দ্বিগুণ বা প্রায় ১০ ফুট। মোট ছয়টি কারুকার্য শোভিত স্তম্ভ আছে মসজিদটিতে। সেগুলো প্রধান কক্ষের চারকোণে ও বারান্দার দুই কোণে স্থাপিত। ওপরের ছাদ আর প্রধান প্রাচীরের কার্নিশ নির্মাণ করা হয়েছে বাঁকানোভাবে। মসজিদের দক্ষিণ পাশে রয়েছে বড় একটি দীঘি। এটি মসজিদটির সৌন্দর্য যেন আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
কালের বিবর্তনে এক সময় মসজিদ সংলগ্ন এলাকা বিরান ভূমিতে পরিণত হয়। তখন জঙ্গলবেষ্টিত হয়ে পড়লেও পরবর্তীকালে এই এলাকায় জনবসতি গড়ে উঠলে জঙ্গলে আবাদ করতে গিয়ে বের হয় আসে এই বিখ্যাত মসজিদটি। তারও বেশ কয়েক বছর পরে মসজিদের পাশেই এই মসজিদের স্থপতি সুফি দরবেশ শাহ মজলিশ আমিন (রা.) এর মাজার আবিষ্কৃত হয়। স্থানীয়দের তথ্য মতে, হিন্দু জমিদারদের অত্যাচারে এলাকার মুসলমানরা বিতাড়িত হয়। তখন গায়েবি ভাবেই মসজিদ ও মাজার জঙ্গলে বেষ্টিত হয়ে সুরক্ষিত থাকে। পরবর্তী কালে আবারও মুসলমানদের আগমনে মসজিদটি জঙ্গলের ভেতর আবিষ্কৃত হয়। তার কিছু বছর পর হঠাত্ একদিন এই মাজারটি বিকট শব্দে গায়েবি ভাবে মাটির নিচ থেকে উপরে উঠে আসে। তাই অনেকেই উনার মাজারকে গায়েবি মাজারও বলে থাকেন। ধর্মীয় বিশেষ দিনগুলোতে এখানে অনেক লোকসমাগম হয়। তবে প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে মসজিদটি ক্রমেই ধ্বংস হতে চলেছে। তবে স্থানীয় সরকার ও প্রশাসনের মারফত জানা যায়, মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছে সরকারের প্রতœতত্ত্ব বিভাগ। তবে সরকারি ভাবে এর রক্ষণাবেক্ষণের কোন নজির চোখে পড়েনি। সরকার কার্যকর পদক্ষেপ নিলে এখানে পর্যটন খাতে অপার সম্ভাবনা রয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন