রাজধানীসহ সারাদেশে নকশা বহির্ভূত বেসরকারি-সরকারি লাখ লাখ ভবন নির্মিত হচ্ছে। রাজধানীর বড় বড় স্থাপনাসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ভবনই নকশা অনুযায়ী নির্মিথ হয়নি। এমনকি সরকারি ভবন নির্মাণের কোনো পরিসংখ্যা রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) কাছে নেই। তারপরও রাজধানীতে গড়ে উঠছে নকশা বহির্ভূত সুপার মার্কেট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ডেইরি ফার্ম, গোডাউন, বাসা-বাড়ী- আবাসন প্রকল্প এবং রেস্তোরাঁসহ বিভিন্ন অনুমোদনহীন ভবন। আইন বিধিমালা সবই আছে তবে মানছে না। সরকারি, আধা সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাা তাদের নিজস্ব ভবন নির্মাণে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) অনুমোদন নেয় না। আবার রাজউকও এসব সংস্থার ওপর আইনি ক্ষমতা প্রয়োগ না করে দায়িত্ব এড়িয়ে যায়। পূর্বাচল উপশহর প্রকল্প নকশা ছাড়াই ভবন,সুন্দরবন স্কয়ার মার্কেট, ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেট-২, বঙ্গবন্ধু পাতাল সড়ক সুপার মার্কেট, নবাববাড়ি সুপার মার্কেটসহ অনেক স্থাাপনার অনুমোদন নেওয়া হয়নি, উত্তরা ৬ নম্বর সেক্টরে সিটি করপোরেশনের বহুতল কাঁচাবাজার তৈরি হয়েছে নকশা বহির্ভূত রাজউকের অনুমোদন ছাড়া। এছাড়া ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ডেইরি ফার্ম, গোডাউন, আবাসন, রেস্তোরাঁসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে অনুমোদনহীন ভবনগুলো। এসব স্থাপনা উচ্ছেদ করতে রাজউক কয়েকবার অভিযান চালালেও তা কোনো কাজে আসেনি। অনেকে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, যেহেতু রাজউকের অনুমোদন নেওয়া হয়নি, তাই ভবন গুলো অবৈধ। এটা অবশ্যই ক্ষতিয়ে দেখা দরকার। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ড. সুলতান আহমেদ ইনকিলাবকে বলেন, রাজধানীর চারপাশের ৫৯০ বর্গমাইল এলাকা রাজউকের নিয়ন্ত্রণে। কোনো সরকারি সংস্থা, এমনকি সিটি করপোরেশনও রাজউকের অনুমোদন নিয়ে ভবন নির্মাণ করে না। রাজউক ব্যবস্থা নেয় না কেন, জানতে চাইলে চেয়ারম্যান বলেন, এ বিষয়ে সিটি করপোরেশনসহ অন্য সংস্থাগুলোকে সরাসরি নোটিশ দেওয়া না হলেও মন্ত্রণালয়কে বিভিন্ন সময়ে অবহিত করা হয়েছে এবং আন্তমন্ত্রণালয়ের সভায় বিষয়টি উত্থাপনের কথা বলা হয়েছে।
শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তর, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর, পানি উন্নয়ন বোর্ড, গণপূর্ত অধিদপ্তরও নিজস্ব ভবন তৈরিতে নিয়ম অনুযায়ী অতীতে কখনো নকশায় রাজউকের অনুমোদন নেয়নি। ২০০৭ সালে বিজয় সরণি-তেজগাঁও সংযোগ সড়ক তৈরির কাজ শুরুর পর গণপূর্ত অধিদপ্তরের নির্মাণাধীন সাতটি বহুতল ভবনের জন্য রাস্তাটি আরও চওড়া করা যায়নি। এখানে ১০০ ফুট রাস্তা করতে হয় বিভাজন লাইন, ফুটপাতসহ ৬০ ফুট। ওই সময়ে গণপূর্ত অধিদপ্তর রাজউকের কোনো অনুমোদন ছাড়াই ভবনগুলো তৈরি হয়। এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। ড্যাপের আওতাধীন এলাকায় ২২ লাখ স্থাপনা রয়েছে। এক তলা থেকে ছয় তলার স্থাপনা ২১ লাখ ১২ হাজার আর সাত তলা থেকে ২৪-২৫ তলা ভবন ৮৮ হাজার রয়েছে।
নগরীর বহুতল ভবনের ফায়ার ফাইটিং সিস্টেমের সক্ষমতার ওপর বুয়েট ও ফায়ার সার্ভিস যৌথভাবে ২০১১ সালে একটি সার্ভে করা হয়। নগরীর বহুতল ভবনের ৯০ শতাংশেরই অর্থাৎ প্রায় ২ হাজার ৭শ ভবনে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা সঠিক পাওয়া যায়নি। আমরা ভেবে বিস্মিত হই যে, রাজউকের অনুমোদন ছাড়া রাজধানীতে বহুতল ভবন তৈরি হতে পারে কীভাবে! অগ্নিকা-, ভবনধসের মতো দুর্ঘটনা ঘটে।
বাংলাদেশ রেলওয়ে কমলাপুর ও আবদুল গনি রোডে নতুন যে ভবনগুলো তৈরি করেছে, সেগুলোর জন্য রাজউকের অনুমোদন নেওয়া হয়নি। নিকেতনে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের নির্মাণাধীন পুলিশ কমপ্লেক্সও হচ্ছে নিজস্ব অনুমোদনে। ঢাকা ওয়াসা সায়েদাবাদ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট ও সেখানকার অন্য স্থাাপনাগুলোর অনুমোদনের জন্য রাজউকের শরণাপন্ন হয়নি। ঢাকা বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানির (ডিপিডিসি) বিদ্যুৎ ভবনও অনুমোদনহীন। ইমারত নির্মাণ আইন, ১৯৫২ এবং ইমারত নির্মাণ বিধিমালা, ২০০৮ অনুসারে দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া রাজধানীর যেকোনো ভবনের নকশা অনুমোদন করার একমাত্র কর্তৃপক্ষ রাজউক। অনুমোদন ছাড়া ভবন নির্মাণ করা হলেও আজ পর্যন্ত কোনো সরকারি সংস্থাার কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে এর ব্যাখ্যা চায়নি রাজউক।
আইনে যা আছে: ইমারত নির্মাণ আইনের ৩.(১) ধারায় বলা আছে, অন্য আইনে যা-ই থাকুক না কেন, রাজউকের অথরাইজড কর্মকর্তার পূর্বানুমোদন ছাড়া কোনো ভবন নির্মাণ, পুননির্ধমাণ, সংযোজন বা পরিবর্তন করা যাবে না। সে অনুসারে রাজউক এলাকায় যেকোনো স্থাাপনার কাঠামোগত ভালো-মন্দ দেখার কর্তৃপক্ষ হচ্ছেন রাজউকের চেয়ারম্যান। তার পক্ষে রাজউকের অথরাইজড কর্মকর্তারা এই দায়িত্ব পালন করতে পারেন। ১৯৮৭ সালের আগ পর্যন্ত সরকারি সংস্থাাগুলো নিজ উদ্যোগে ভবন নির্মাণ করতে পারত। ওই সময় সাবেক ডিআইটি এসব ভবন পরীক্ষা করতে পারত। তবে নিরাপত্তা ও গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা রক্ষার জন্য সেনানিবাস এলাকায় এসব স্থাাপনার অনুমোদন দিতে পারে ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড। ইমারত আইনের এই ধারার বাইরে আরেকটি বিধান রয়েছে। তা হচ্ছে, গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের কাছে আবেদন করে নিজ উদ্যোগে স্থাাপনা তৈরির অধিকার অর্জন। পূর্ত মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে অনুমোদন নিয়ে ভবন তৈরির ‘অথরাইজড’ সংস্থাা হওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে স্থাাপনার নকশা তৈরির আবেদন করলে মন্ত্রণালয় যদি যথাযথ মনে করে, তাহলে ইমারত নির্মাণ আইনের আওতায় গেজেট তৈরি করে আবেদনকারী সংস্থাাকে ‘অথরাইজড সংস্থাা’র মর্যাদা দিতে পারে। ২০০৮ সালে এই স্থাাপত্য অধিদপ্তরের প্রধান স্থাপতিকে সেই ক্ষমতা দেওয়া হয়।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী বলেন, ২০০৯ সালে স্থাানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের এক আদেশে সিটি করপোরেশনের নিজস্ব ইমারত নির্মাণের অনুমোদনের ক্ষমতা প্রধান প্রকৌশলীকে দেওয়া হয়। কিন্তু নগর ভবনসহ ডিসিসির অনেক ভবনই এই ক্ষমতা পাওয়ার আগে তৈরি হয়েছে। রাজউকের বাধ্যবাধকতাগুলো ডিসিসি সব সময়ই পালন করে।
জানা যায়, ১৯৯২ সালে নির্মিত নগর ভবন শুধু নয়, ঢাকা সিটি করপোরেশনের কোনো ভবনেরই নকশা রাজউক অনুমোদিত নয়। নিজস্ব প্রকৌশলীদের সহায়তায় বেসরকারি স্থাপতিদের মাধ্যমে নকশা তৈরি করে করপোরেশন এসব ভবন নির্মাণ করে। প্রতি ওয়ার্ডে একটি করে ‘কমিউনিটি সেন্টার’ তৈরির পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে গিয়ে গত ২৫ বছরে ৩৯টির মতো ভবন তৈরি হয়। এগুলো ছাড়াও সুন্দরবন স্কয়ার মার্কেট, ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেট-২, বঙ্গবন্ধু পাতাল সড়ক সুপার মার্কেট, নবাববাড়ি সুপার মার্কেট, আদর্শ মার্কেটসহ আরও অনেক স্থাপনার অনুমোদন নেওয়া হয়নি। উত্তরা ৬ নম্বর সেক্টরে সিটি করপোরেশনের বহুতল কাঁচাবাজার তৈরি হয়েছে রাজউকের অনুমোদন ছাড়া। শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তর, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর, পানি উন্নয়ন বোর্ড, গণপূর্ত অধিদপ্তরও নিজস্ব ভবন তৈরিতে নিয়ম অনুযায়ী অতীতে কখনো রাজউকের অনুমোদন নেয়নি। ২০০৭ সালে বিজয় সরণি- তেজগাঁও সংযোগ সড়ক তৈরির কাজ শুরুর পর গণপূর্ত অধিদপ্তরের নির্মাণাধীন সাতটি বহুতল ভবনের জন্য রাস্তাটি আরও চওড়া করা যায়নি। এখানে ১০০ ফুট রাস্তা করতে হয় বিভাজন লাইন, ফুটপাতসহ ৬০ ফুট। ওই সময়ে গণপূর্ত অধিদপ্তর রাজউকের কোনো অনুমোদন ছাড়াই ভবনগুলো তৈরি হয়।
বাংলাদেশ রেলওয়ে কমলাপুর ও আবদুল গনি রোডে নতুন যে ভবনগুলো তৈরি করেছে, সেগুলোর জন্য রাজউকের অনুমোদন নেওয়া হয়নি। নিকেতনে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের নির্মাণাধীন পুলিশ কমপ্লেক্সও হচ্ছে নিজস্ব অনুমোদনে। ঢাকা ওয়াসা সায়েদাবাদ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট ও সেখানকার অন্য স্থাাপনাগুলোর অনুমোদনের জন্য রাজউকের শরণাপন্ন হয়নি। ঢাকা বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানির (ডিপিডিসি) বিদ্যুৎ ভবনও অনুমোদনহীন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু হল, জিয়া হল, একুশে হল, বেগম সুফিয়া কামাল হল, ফজিলাতুন্নেসা মুজিব হল, নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবন ইত্যাদি নির্মিত হয় ১৯৮৭ সালের পর। এগুলো রাজউক অনুমোদিত নয়।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলী মফিজুল ইসলাম বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ভবন নির্মাণে অতীতে কখনো রাজউকের অনুমোদন নেওয়া হয়নি। রাজউকও কখনো আপত্তি জানায়নি। ক্ষেত্রে যুক্তি হচ্ছে, বুয়েটের প্রকৌশলী ও স্থাপতিরা রাজউকের অথরাইজড কর্মকর্তাদের তুলনায় অনেক বেশি অভিজ্ঞ। এমনকি রাজউকের অধীন এলাকায় কোনো ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হলে তা পরীক্ষা করার জন্য বুয়েটের বিশেষজ্ঞদেরই সহায়তা নিতে হয়। তবে বুয়েটের উপাচার্য বলেন, এখন বুয়েটের ভবন নির্মাণে রাজউকের অনুমোদন নেওয়া হয়।
মন্ত্রণালয়ের সচিব রাজউকের অনুমোদন নেওয়া প্রসঙ্গে ইনকিলাককে বলেন, বিভিন্ন সময়ে ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়ররা মনে করেছেন, ভবন নির্মাণের বিষয়ে তাঁদের প্রধান প্রকৌশলীই দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি। সেদিক থেকে করপোরেশন নিজস্ব নকশায় ভবন নির্মাণ করতে গিয়ে অন্য সংস্থাার অনুমোদনের প্রয়োজন বোধ করে না। পৃথিবীর সব দেশেই পৌর করপোরেশন ভবন নির্মাণের দায়িত্ব পালন করে।
গৃহায়ণ ও গণপূর্তসচিব বলেন, শুধু রাজউক নয়, চট্টগ্রাম, খুলনাসহ পূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীন বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের এলাকায় অন্য কোনো সংস্থাা যাতে নিজ উদ্যোগে ভবন বা স্থাাপনা তৈরি করতে না পারে, সে জন্য মন্ত্রিসভায় নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাব ভবিষ্যতে মন্ত্রিসভায় পেশ করে অনুমোদন নেওয়া হবে। তাহলে ইমারত নির্মাণ আইনের এই বিষয়টিও রক্ষা পেতে পারে। রাজউক সূত্রে জানা যায়, যে তিনটি প্লটে বৈধ নকশায় বাড়ি তৈরি হচ্ছে, তার মধ্যে রয়েছে ১ নম্বর সেক্টরের ৩০১ নম্বর রোডের ১৪ নম্বর প্লট। নকশা অনুমোদনের আগেই তিনতলা বাড়ির কাজ করা হয়।
রাজধানীর মোহাম্মদপুরে নকশা বহির্ভূত ৬টি ভবনে রাজউকের ভ্রাম্যমান আদালত ৫ লাখ টাকা জরিমানা এবং ভবনের অতিরিক্ত অংশ অপসারণ করা হয়েছে। নকশা বহির্ভূত স্থাপনা হওয়ায় চিত্রনায়ক শাকিব খানের বাড়িসহ ৩টি বাড়িকে জরিমানা করেছেন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) ভ্রাম্যমাণ আদালত। শাকিব খানকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করেছে রাজউকের ভ্রাম্যমাণ আদালত।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন