আজ রোববার পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির ২২তম বার্ষিকী। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (পিসিজেএসএস) মধ্যে এই চুক্তি স্বাক্ষর হয়। এর মাধ্যমে তিন পার্বত্য জেলায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের অবসান ঘটে।
শান্তি চুক্তির ২২ বছরেও পাহাড়ে কি শান্তি ফিরেছে? সন্তু লারমার পক্ষ থেকে যেমনি রয়েছে বিস্তর অভিযোগ তেমনি আছে বাঙ্গালীদের পক্ষ থেকেও। বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী শান্তি চুক্তির পর এ পর্যন্ত তিন পার্বত্য জেলায় খুন হয়েছে ২ হাজার ২৭৫ জন মানুষ। অপহৃত হয়েছে আরো ২ হাজার ৪৫০ জন। নিহতদের পাহাড়ি-বাঙালি উভয় সম্প্রদায়ে থাকলেও বাঙালিদের সংখ্যা বেশি।
বাঙালিরা অধিকাংশই পাহাড়িদের হাতে সা¤প্রদায়িক বিদ্বেষ ও চাঁদাবাজির জের ধরে খুন হয়েছেন। অন্যদিকে পাহাড়িরা মারা গেছেন সশস্ত্র তৎপরতা, আধিপত্যের লড়াই এবং অন্তঃকোন্দলের কারণে। চুক্তি মোতাবেক ১০ ফেব্রæয়ারি ১৯৯৮ থেকে ৫ মার্চ ১৯৯৮ পর্যন্ত ৪ দফায় ১৯৪৭ জন সশস্ত্র শান্তি বাহিনীর সদস্য সরকারের নিকট আত্মসমর্পণ করেন। ৮৭৫টি অস্ত্রসহ ২ লাখের অধিক গোলা-বারুদ জমা দিয়েছিল। ফলে জনসংহতি সমিতির সামরিক শাখা পুরোপুরি বিলুপ্তি ঘটেছে এমনটাই কাগজে-কলমে উল্লেখ থাকলেও পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বিপরীত বলে মন্তব্য স্থানীয়দের।
তিন পার্বত্য জেলায় প্রায় ১৫ লাখ মানুষের মধ্যে ৪৮ শতাংশ বাঙালি। বাকি ৫২ শতাংশ বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী উপজাতি। পাহাড়ি বাঙালি স¤প্রীতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে শান্তি চুক্তি করা সত্তে¡ও এখনো জনসংহতির নেতারা বাঙালিদের অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার দাবি জানিয়েছে বিভিন্ন সময়। খোদ সন্তু লারমাও এমন দাবি জানান সময়ে সময়ে।
পার্বত্য গোষ্ঠীগুলোর বাধার মুখে কাজ করতে পারছে না সরকারের ভ‚মি জরিপ কমিশন। উপজাতীয় নেতাদের আপত্তিতে সরকার গত বছর আইন সংশোধন করেও এর কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে পারছে না। পার্বত্যাঞ্চলের বাঙালি সংগঠনগুলো মনে করছে পার্বত্য চুক্তির এতো বছরেও এই অঞ্চলে বসবাসরত বাঙালিদের কোনো প্রকার উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন ঘটেনি। সম-অধিকার আন্দোলনের নেতা জাহাঙ্গীর কামাল ও বাঙালি ছাত্র পরিষদের সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম বলেছেন, বর্তমানে পাহাড়ে অসহ্য যন্ত্রণময় পরিস্থিতিতে বাস করছি। পাহাড়ে ৪টি সশস্ত্র সংগঠন সৃষ্টি হয়ে ব্যাপকহারে বেড়েছে সশস্ত্র তৎরপরতা ও সংঘাত।
তিনি বলেন, দুর্গম অঞ্চল থেকে সেনা ক্যাম্পগুলো প্রত্যাহার করার পর থেকে পাহাড়িদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা আরো বেড়ে গেছে। অপরদিকে, রাঙামাটির সাবেক স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য উষাতন তালুকদার বলেছেন, চুক্তি করার পর থেকে কিছুই যে বাস্তবায়ন হয়নি তা নয়। আওয়ামী লীগের সংরক্ষিত আসনের সাবেক নারী সংসদ সদস্য ফিরোজা বেগম চিনু বলেছেন, পার্বত্য শান্তি চুক্তির সিংহভাগ আওয়ামী লীগ সরকার বাস্তবায়ন করেছে। জননেত্রী শেখ হাসিনার একান্ত আগ্রহেই পার্বত্য শান্তি চুক্তি করা হয়েছিল। পাহাড়ের মানুষের জন্য তার চেয়ে দরদী আর কেউ নাই।
এদিকে চাকমা রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় বলেছেন, সংঘাতের অবসান আর জেএসএস এর সদস্যরা সাধারণ জীবনে ফিরে আসা এবং কিছু প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি হওয়া ছাড়া আর তেমন কিছুই দৃশ্যমান নেই বলে এখানকার জনগণের ধারণা।
পাহাড়ের সাধারণ জনগণের অভিমত, পাহাড়ে সেনাবাহিনী না থাকলে সন্ত্রাসীরা বাঙালিদের কচুকাটা করে তাড়িয়ে দেবে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, পার্বত্য জেলাগুলো থেকে সেনা প্রত্যাহার করা হলে নিরাপত্তা শূন্যতা তৈরি হবে। তাদের মতে এমনিতেই পাহাড়ে বর্তমানে সুষ্ঠু পরিস্থিতি নেই। এখনো চাষাবাদ, পণ্য পরিবহনসহ প্রতিটি ক্ষেত্রেই সশস্ত্র গ্রুপগুলোকে চাঁদা দিতে হয়। কাঙ্খিত চাঁদা না পেলে তারা খুন, অপহরণসহ নানা অপকর্মে লিপ্ত হয়। স্থানীয় জনগণের স্বার্থেই সব ক্যাম্প প্রত্যাহার করা মোটেও উচিত হবে না।
সরকারি বিভিন্ন মহলের মতে, শান্তি চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি বাস্তবায়ন করেছে বাকিগুলোও প্রক্রিয়াধীন। অপরদিকে সরকারের পক্ষে থেকে মাত্র একটিই শর্ত ছিল সশস্ত্র পাহাড়ি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো সব অস্ত্র সমর্পণ করবে। কিন্তু পাহাড়ি নেতাদের রাজনৈতিক ছত্রছায়ার কারণে শান্তি চুক্তির ২২ বছরেও সেটা সম্ভব হয়নি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন