আবু হেনা মুক্তি : প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা ব্যায়ে নির্মিতব্য ব্যাপক আলোচিত রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণচুক্তি সই চলতি মাসেই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এ নিয়ে অবরোধ, হরতাল, মানববন্ধন, লংমার্চ প্রভৃতি কর্মকা- অব্যাহত থাকলেও ভারতের নির্বাচিত ঠিকাদারকেই কার্যাদেশ দিয়ে প্রকল্পটি যথাস্থানে বাস্তবায়ন করতে সরকার অনড় রয়েছে। ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার এই কেন্দ্রটিতে ২০১৯ সালে উৎপাদন শুরুর সম্ভাবনা প্রবল। বিশ্ব ঐতিহ্য ম্যানগ্রোভ ফরেষ্ট সুন্দরবন ও পরিবেশকে বিপণœ করে রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুাকেন্দ্র স্থাপন এখন আমজনতার গলার কাঁটা। আর সরকারের কাছেও যেন বিষফোঁড়া। বিশিষ্টজনেরা বলছেন, সরকার প্রকল্পটি যেমন বন্ধ করতে পারছে না তেমনি বাস্তবায়ন করতে হলে একটি বিশাল জনগোষ্ঠির রোষানলে পড়তে হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন সুন্দরবন থেকে সরকারি হিসাবে মাত্র ১৪ কিলোমিটার দুরত্বে অবস্থিত রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে যে লাখ লাখ টন কয়লা পোড়ানো হবে তা থেকে নির্গত বিষাক্ত ধোয়া, ছাই, রাসয়নিক পদার্থ ইত্যাদি আশপাশের বায়ু, পানি, মাটিকে দূষিত করবে। এই দূষণ পানি ও বাতাসের মাধ্যমে পরিবাহিত হয়ে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোপ বনাঞ্চল সুন্দরবনকে বিপণœ করবে। রামপাল বিদ্যুাকেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় বিপুল পরিমাণ কয়লা বহনকারী জাহাজ আসা-যাওয়া করবে বনের ভিতর দিয়ে। বহুল সমালোচিত এই প্রকল্প নিয়ে ইতিমধ্যে শুধু দেশে নয়, ইউনেস্কো-রামসারসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থাও প্রশ্ন তুলেছে।
আবার এই রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিদ্যুৎখাতে সহযোগিতার স্মারক। কেন্দ্রটি স্থাপনের জন্য বাংলাদেশের সরকারি প্রতিষ্ঠান বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) ও ভারতের সরকারি প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল থারমাল পাওয়ার কোম্পানির (এনটিপিসি) যৌথ উদ্যোগে গঠিত হয়েছে বাংলাদেশ-ভারত ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিআইএফপিসিএল)। বর্তমানে বাংলাদেশের বিদ্যুৎসচিব এই কোম্পানির চেয়ারম্যান। আর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এনটিপিসির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
সূত্র মতে ২০১০ সালের ডিসেম্বর থেকেই রামপালে ১৮৩৪ একর জমি অধিগ্রহণ এবং মাটি ভরাটের কাজ শুরু হয়। সব বিরোধিতা উপেক্ষা করে ২০১৩ সালের ৫ আগস্ট রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের ছাড়পত্র দিয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর। গত ৫ অক্টোবর ’১৩ প্রকল্প থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় কেন্দ্রটি উদ্বোধন করা হয়েছে। প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র-প্রক্রিয়ায় কেন্দ্রটি নির্মাণের জন্য ঠিকাদার নির্বাচিত হয়েছে ভারত হেভি ইলেকট্রিক লিমিটেড (ভেল)।
এদিকে বামমোর্চার পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, শুরু থেকে সরকার ও তাদের পক্ষের কিছু বিশেষজ্ঞ প্রচার চালাচ্ছে যে, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুাকেন্দ্র সুন্দরবনের কোন ক্ষতি করবে না। কয়লার কারণে পরিবেশ দূষণ না হলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ভারত-চীনের পরিবেশ রক্ষা দপ্তরগুলো কয়লাভিত্তিক বিদ্যুাকেন্দ্রের কারণে ভয়াবহ পরিবেশ দূষণের কথা বলছে কোন যুক্তিতে? রামপালে কয়লা পুড়বে বছরে ৪৭ লাখ ২০ হাজার টন, প্রতিদিন ১৩ হাজার মেট্রিক টন। এতে ছাই হবে প্রতিদিন প্রায় ৬০০ মেট্রিক টন।
সূত্রমতে, সাধারণভাবে ঋণ সংগ্রহের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত (ফিন্যান্সিয়াল ক্লোজার) হওয়ার পর ঠিকাদারের কাজ শুরু করার কথা। কিন্তু প্রকল্পের পক্ষ থেকে চেষ্টা করা হচ্ছে তার আগেই কাজ শুরু করে দেয়ার। কারণ, মূল সময়সূচির চেয়ে প্রকল্পটি প্রায় দুই বছর পিছিয়ে পড়েছে।
সূত্রমতে, ১৩২০ মেগাওয়াটের একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বছরে উৎপাদিত বায়ু দূষণকারী উপাদানগুলো হলো- ৭৯ লাখ টন কার্বন ডাই অক্সাইড যা প্রায় ৩৪ কোটি গাছ কেটে ফেলার সমান। ৫২ হাজার টন সালফার ডাই অক্সাইড। এই সালফার ডাই অক্সাইড এসিড রেইনের কারণ এবং অন্যান্য উপাদানের সাথে বাতাসে ক্ষুদ্র কণিকার পরিমাণ বাড়িয়ে তোলে যার ফলে ফুসফুস ও হার্টের রোগসহ বিভিন্ন অসুখ-বিসুখ হয়। ৩১ হাজার নাইট্রোজেন অক্সাইড। এই নাইট্রোজেন অক্সাইড ফুসফুসের টিস্যুর ক্ষতি করে। ১৩০০ টন ক্ষুদ্র কণিকা যার ফলে ব্রংকাইটিসসহ ফুসফুসের বিভিন্ন রোগ বেড়ে যায়। ১৯০০ টন বিষাক্ত কার্বন মনোক্সাইড। ৪৪০ পাউন্ড মারকারি বা পারদ। ২৫ একর আয়তনের একটা পুকুরে এক চা চামচের ৭০ ভাগের একভাগ পারদ পড়লে সেই পুকুরের মাছ বিষাক্ত হয়ে খাওয়ার অযোগ্য হয়ে পড়ে। পারদের কারণে ব্রেন ড্যামেজসহ স্নায়ুতন্ত্রের নানান রোগ হয়। ৫৯০ পাউন্ড বিষাক্ত আর্সেনিক যার ফলে আর্সেনিকোসিস এবং ক্যানসারের বিস্তার ঘটায়। ৩০০ পাউন্ড সীসা, ১০ পাউন্ড ক্যাডমিয়াম এবং পরিবেশ ও মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর অন্যান্য ভারী ধাতু। কয়লা পুড়িয়ে ছাই তৈরী হয় এবং কয়লা ধোয়ার পর পানির সাথে মিশে তৈরী হয় আরেকটি বর্জ্য। ছাই এবং এই তরল উভয় বর্জ্যই বিষাক্ত কারণ এতে বিষাক্ত আর্সেনিক, মার্কারি বা পারদ, ক্রোমিয়াম এমনকি তেজস্ক্রিয় ইউরোনিয়াম ও থোরিয়াম থাকে। কয়লা বিদ্যুাকেন্দের কঠিন ও তরল বর্জ্য বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে, সংরক্ষণ আধার থেকে চুঁইয়ে নানানভাবে গ্রাউন্ড ও সারফেস ওয়াটারের সাথে মিশে পানি দূষণ ঘটায় যার ফলে পানির মাছ, জলজ উদ্ভিদ ইত্যাদি হুমকির মুখে পড়ে। কয়লা বিদ্যুাকেন্দের টারবাইন, কমপ্রেসার, পামপ, কুলিং টাওয়ার, কনস্ট্রাকশনের যন্ত্রপাতি, পরিবহনের যানবাহনের মাধ্যমে ব্যাপক শব্দ দূষণ ঘটে থাকে। এই প্রকল্পে প্রতিদিন কয়লা ধোয়ার জন্য ২৫ হাজার কিউরিক মিটার স্বচ্ছ পানি ভূগর্ভস্থ স্তর থেকে উত্তোলন করতে হবে। ২৫ বছর এই প্রকল্পের আয়ুস্কাল ধরা হয়েছে। আশক্সক্ষা করা হচ্ছে, এর পরিণতিতে সুন্দরবন অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অনেক নিচে যাবে।
সূত্রমতে, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদিত প্রতি কিলোওয়াট বিদ্যুতের দামের বিপরীতে স্থানীয় উন্নয়নের জন্য তিন পয়সা করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিআইএফপিসিএল। এতে বছরে প্রায় ২৭ কোটি টাকা হবে। এই টাকা স্থানীয় রাস্তাঘাট, হাসপাতাল ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় খাতে ব্যয় করা হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন