মঙ্গলবার, ০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

ব্রেক্সিটের পর কী ঘটতে যাচ্ছে

প্রকাশের সময় : ২৫ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম


ইনকিলাব ডেস্ক
ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ত্যাগ করার পক্ষে (ব্রেক্সিট) ভোট দিয়েছেন যুক্তরাজ্যের জনগণ। এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত কেবল যুক্তরাজ্য সঙ্গে ইইউ-এর ৪৩ বছরের অম্লমধুর সম্পর্ককেই নয়, বিংশ শতকের সবচেয়ে বড় দুইটি বিশ্বযুদ্ধকেও নতুন করে দেখার অবকাশ তৈরি করেছে। ফল ঘোষণার পরই দেশটির রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা শুরু হয়েছে। ধস নেমেছে ব্রিটিশ পাউন্ডের মূল্যমানে। ধস নেমেছে এশিয়ার শেয়ার বাজারে। ইউরোপজুড়ে দেখা দিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। এমন অবস্থায় বিশ্লেষণ চলছে, ব্রেক্সিটের পর কী ঘটবে।  
‘ফেরার পথ নেই’- এই অনুমানে হোক বা ‘যৌথ ক্রেতা হারানোর ফলেই’- হোক; ব্রিটেনকে এ সিদ্ধান্তের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংবিধানিক ও কূটনৈতিক পরিণতি মোকাবেলা করতে হবে আগামী এক দশক বা তারও বেশি সময় ধরে। ব্রেক্সিটের ফলে বিশ্বক্ষমতার কেন্দ্রে যুক্তরাজ্যের যে অবস্থান ছিল, তা পরিবর্তিত হয়ে গেছে। লন্ডনের সব কর্তৃপক্ষ, ডাউনিং স্ট্রিট থেকে শুরু করে বড় বড় ব্যবসায়ী, অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ ও বৈদেশিক নীতি প্রণয়নকারী- কেউই এ বিষয়টি অগ্রাহ্য করতে পারবেন না।
এরপর কী?
গণভোটের ফল প্রকাশের পরই নিজের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন। গণভোটের ফলাফল নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকার পক্ষে ছিলাম। তবে ব্রিটিশ জনগণ না থাকার পক্ষে রায় দিয়েছেন। জনতার রায়ই চূড়ান্ত। পদত্যাগের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, চলতি বছরের অক্টোবরের মধ্যেই নতুন নেতৃত্ব দরকার।
এর আগে তিনি জানিয়েছিলেন, ব্রিটিশ জনগণের সিদ্ধান্তই তিনি মেনে নেবেন। পদত্যাগের ঘোষণা দিলেও তাকে ক্ষমতায় থাকার অনুরোধ জানানো হয়েছে। এখন পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী ২০১৯ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকবেন নাকি কনজারভেটিভ পার্টির নির্বাচন পর্যন্ত থাকবেন তা একান্তই ক্যামেরনের সিদ্ধান্ত। তবে কোনও পথই তার জন্য সহজ নয়। ব্রেক্সিটের পর যখন বাজারে স্থিতিশীলতা প্রয়োজন তখন ক্যামেরনের পদত্যাগ আরও অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে।
মন্ত্রিসভার নীতিমালা অনুসারে এটা স্পষ্ট যে, পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত রাণির উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে হবে ক্যামেরনকেই। তবে কোনওভাবেই ব্রেক্সিটের ফলে কোনও বিশেষ সুযোগ নিতে পারছেন না লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিন। সংসদে আস্থা ভোটের প্রস্তাব আনলেও তাতে করবিনের পাস হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। এছাড়া নতুন ক্যামরনের পরিবর্তে নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করা হতে পারে দলীয়ভাবেই, কোনও নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নয়।

রাজনৈতিক বিতর্ক যতই থাকুক, ক্যামেরন ও চ্যান্সেলর জর্জ অসবর্নকে এই দ্বিধাবিভক্ত পরিস্থিতি মোকাবেলা করতেই হবে। ইউরোপের পক্ষে থাকার মনোভাব প্রকাশ করে আসা প্রধানমন্ত্রীকে জনগণের মতামতের ভিত্তিতে সরে যেতে হচ্ছে। হাউজ অব কমন্সে বিরোধী সদস্যদের সংখ্যা ২০০-এর বেশি হবে না। কিন্তু সংখ্যালঘুদেরও এ ইস্যুতে সরব হতে দেখা গেছে। এতে যুক্তরাজ্যের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু টালমাটাল হয়ে গেছে।
ক্যামেরন বলেছেন, যদি ব্রেক্সিট হয় তাহলে তিনি লিসবন চুক্তির ৫০ ধারা অনুসরণ করবেন। এই চুক্তি অনুসারে ইইউভুক্ত কোনও সদস্য রাষ্ট্র যদি বেরিয়ে যেতে চায় তাহলে ইইউ কাউন্সিলকে জানাতে হবে। এরপর দুই বছরের একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ব্রিটেনকে যেতে হবে।  ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়ার পর তা শেষ হবে। যদি না ইইউ দুই বছর শেষে এই প্রক্রিয়া বর্ধিত করে।
সাংবিধানিকভাবে লিসবন চুক্তির ৫০ ধারা অনুসরণ করার সিদ্ধান্ত  ক্যামেরনের একার। সংসদও এ বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেনি। এছাড়া এক্ষেত্রে রাজপরিবারের বিশেষ ক্ষমতা প্রযোজ্য হবে। তাছাড়া পার্লামেন্টও চাইলে ক্যামেরন যেন ৫০ ধারা অনুসরণ না করেন সেজন্য প্রস্তাব পাস করতে পারবে। এরপর যুক্তরাজ্য ও ২৭ টি রাজ্যের ‘সুযোগ্য সংখ্যাগরিষ্ঠতা’র (বিশেষত ২০টি রাজ্য যেখানে ৬৫ শতাংশ জনগণ বসবাস করেন) সমর্থণের ভিত্তিতে আনুষ্ঠানিকভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাবে ব্রিটেন।
যদি দুই বছর শেষে চুক্তি না হয় অথবা বর্ধিত করার সিদ্ধান্তে ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত না হয়, তবে যুক্তরাজ্য স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নীতিমালার আওতায় পড়ে যাবে।  অর্থাৎ ইইউতে বিক্রি করা সব পণ্যের ওপর কর দিতে বাধ্য হবে যুক্তরাজ্য। ফলে ইউকে যদি ৫০ তম ধারা অনুসরণ করে তাহলে ব্রিটেন ইচ্ছাকৃতভাবেই দরকষাকষির ক্ষমতা ইইউয়ের হাতে তুলে দেবে।
প্রধানমন্ত্রীকে তার দলের ব্রেক্সিটপন্থীদের দুর্ভোগের মধ্যেই কাজ করে যেতে হবে।  ক্যামেরনের দলের ব্রেক্সিপন্থীরা ঐক্যবদ্ধ নয়। অপ্রত্যাশিত বিজয় হজম করতে কিছুটা সময় লাগবে। ব্রেক্সিটপন্থীদের অনেকেই মাসের পর মাস গণভোটের জন্য সুপারিশ করেছেন। কিন্তু সরে যাওয়ার প্রশ্নে তারা নীরব। বিপরীতে, আইরিশ গণভোট নির্দিষ্ট আইনি প্রশ্ন তুলেছে ও রাজনীতিবিদদের স্পষ্ট দিশা দিয়েছে।
ফলে ব্রেক্সিটপন্থীদের একক বাজার থেকে নিজেদের প্রত্যাহার ও জনগণের অবাধ যাতায়াত বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিতে হবে।  অথবা তাদেরকেও নরওয়ের মতো দুর্ভোগের মধ্য দিয়ে আধাআধি ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। ইউরোবিরোধী এমইপি ড্যানিয়েল হান্নান ব্রেক্সিটকে শুধু বেরিয়ে যাওয়ার একটি মুহূর্ত হিসেবে না দেখে একটি প্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচনা করার আহ্বান জানিয়েছেন। চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের আগ পর্যন্ত আগামী বছরগুলোতে নরওয়ের ব্যবস্থাকে বিবেচনায় আনার সুপারিশ করেছেন। ব্রেক্সিটপন্থীদের ব্যস্ততা কমে আসলে ভোটাররা আরও অধৈর্য হয়ে পড়বেন। ইইউপন্থীরা সাধারণ মানুষকে প্রভাবিত করতে শুরু করবে। নতুন নির্বাচনের পথ, নতুন রাজনৈতিক অনুশাসন আরও অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠবে। উগ্র ব্রেক্সিটপন্থীরা এতে আরও অধৈর্য হবেন।

এ সব হিসাবনিকাশে যুক্তরাজ্যের সংসদের ভূমিকাই এককভাবে প্রধান নয়। ইইউর কেন্দ্র ছাড়ার পক্ষের শক্তির চাপে সমাধানে যেতে পারে; যা ইইউ’র পক্ষে দুর্লভ। একাংশ সুপারিশ করতে পারে ইইউ যেন যুক্তরাজ্যকে ৫০ ধারায় অন্তর্ভুক্ত করে। ভোটের ফল দ্বারা প্রভাবিত অংশ পুনরায় ইইউতে ব্রিটেনের পুনরায় অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে দেশটির সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের শর্তাবলী পর্যালোচনার বিষয়টি সামনে নিয়ে আসতে পারে। অনেক কূটনীতিকই মনে করেন, জার্মান চ্যান্সেলর এঙ্গেলা মারকেল ক্যামেরনের চেয়ে অনেক বেশি অবাধ চলাচলের পক্ষে।  
যেকোনও বিভক্তিরই কিছু কেন্দ্রীয় বিষয় থাকে। এক্ষেত্রে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ইইউ পাসপোর্ট হারাবে কিনা? অথবা এক্ষেত্রে ভিন্ন কোনও প্রক্রিয়া অনুসরণ করার প্রয়োজন কিনা;  যা এতোদিন ধরে ইইউভুক্ত দেশের নাগরিক হিসেবে তারা ভোগ করে আসছেন। এক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের নতুন চুক্তির সুযোগ রয়েছে। তবে সবকিছু নির্ভর করছে ব্রেক্সিটের পর ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের সম্পর্ক কেমন হয় তার উপর। এই ভোটের ফল হিসেবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভবিষ্যৎও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়বে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ছোট দেশগুলোতেও একই ধরণের গণভোটের দাবি উঠবে। সুতরাং, এই গণভোটের ফলে ইউরোপও ভাঙনের পথে যাত্রা শুরু করতে পারে। ইতোমধ্যে ইউরোপের যেসব দেশে চরম ডানপন্থী বর্ণবাদী দলগুলো ধীরে ধীরে শক্তি অর্জন করেছে তারা নতুন করে উজ্জীবিত হবে এবং ইউরোপজুড়েই অভিবাসীরা বিশেষত মুসলিম শরণার্থীরা হয়রানি ও বৈষম্যের শিকার হবেন।
ওয়াশিংটন, ব্রাসেলস, বার্লিন, প্যারিস ও মস্কোতে সবাই এখন নড়েচড়ে বসতে বাধ্য। মুক্তবিশ্বের নেতা যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে ইউরোপে বিশ্বস্ত ও সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিল ব্রিটেন। এবং সে কারণে ইউরোপে ব্রিটেনের নেতৃত্বের যে ভূমিকা ছিল তা এখন দুর্বল হয়ে পড়বে এবং বিশ্বব্যবস্থায়, বিশেষত নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার প্রশ্নে নতুন রাজনৈতিক সমীকরণ অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠবে।



 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন