উন্নয়ন খোঁড়াখুড়িতে রাজধানীর সড়কাগুলো অবস্থা বেহাল দশা। একদিকে অপরিকল্পিত খোঁড়াখুঁড়ি অন্যদিকে কার্পেটিং, পাথরকুচি, ইট উঠে যাওয়ায় সীমাহীন দুর্ভোগ নগরবাসীর। অধিকাংশ রাস্তায় গর্তের সৃষ্টি হয়ে চলাচলের অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছে। যানবাহন চলতে গিয়ে রাস্তার মাঝখানে বিকল হয়ে পড়ছে। যখন তখন ঘটছে দুর্ঘটনা। সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। ওয়াসা, বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা, তিতাস গ্যাস ও টেলিফোন বিভাগসহ নানা উন্নয়ন সংস্থার দফায় দফায় খোঁড়াখুঁড়ির কারণে রাজধানীর-বেশিরভাগ রাস্তাঘাটের এ দুরবস্থা। নগরবাসীকে প্রতিনিয়ত ঝুঁকি, বিড়ম্বনা ও কষ্টকে সঙ্গী করেই রাস্তায় নামতে হচ্ছে।
সরেজমিন দেখা গেছে, রাজধানীর মতিঝিল এজিবি কলোনি, শাহজাহানপুর, কমলাপুর, আরামবাগ, ফকিরাপুল, কাকরাইল, বেইলি রোড় ও শাহবাগ এলাকার সড়কগুলো বর্তমানে চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। শাহজাহানপুর ইসলামি ব্যাংক হাসপাতালের সামনের সড়কটিতে প্রায় বছরখানেক আগে স্যুয়ারেজের পাইপ বসানোর কাজের জন্য খোঁড়া হয়েছি। কাজ শেষ হয়েছে প্রায় চার মাস আগে। আজো সড়কটি মেরামতের কাজ করা হয়নি। এজিবি কলোণির আশেপাশের সড়কগুলোতেও সড়ক উন্নয়ন ও ড্রেনেজ লাইন সংস্কারের কাজের জন্য কেটে রাখা হয়েছে ছয় মাস আগে। অথচ মাসের পর মাস চলে যাচ্ছে। এই সড়কগুলোর কার্পেটিংয়ের কাজ শেষ হচ্ছে না। উন্নয়ন কাজ শেষে সড়কাগুলো ভালভাবে মেরামত করা হচ্ছে না। যে কারণে এ রাস্তাগুলোর বেহাল দশা। এছাড়া মতিঝিল নটরডেম কলেজের সামনের মুল সড়কটির দুই পাশে বিশাল বিশাল পাইপ রেখে সড়কটির বড় অংশ দখল করে রাখা হয়েছে প্রায় ৮/৯ মাস ধরে। যে কারণে এই সড়কটিতে রাতদিন যানজট লেগেই থাকে।
এমন দুরাবস্থা এখন রাজধানীর প্রধান সড়কগুলোসহ বিভিন্ন এলাকার আলিগলির সড়কগুলোতেও বিরাজ করছে। রাজধানীজুড়েই চলছে উন্নয়ন খোঁড়াখুঁড়ি। নগরীর এমন কোনো সড়ক বা অলিগলি নেই, যেখানে খোঁড়াখুঁড়ি চলছে না। এরমধ্যে দুয়েকটি সড়ক দিয়ে কোন রকম চলাফেরা করা গেলেও অনেক রাস্তায় এখন চলাচল কষ্টসাধ্য। সিটি কর্পোরেশন ড্রেনেজ ব্যবস্থার কাজ, মেট্টোরেলের কাজ, ওয়াসা, তিতাস, ডেসকোসহ সবাই মিলে প্রতিদিনই কোনো না কোনো সড়ক, অলিগলি খুঁড়ছে। আজ এই প্রতিষ্ঠান কাটছে তো কাল কাটছে আরেক প্রতিষ্ঠান। এমনকি এক প্রতিষ্ঠান কাজ শেষ করে চলে যাওয়ার পরদিন আরেক প্রতিষ্ঠান এসে নতুন করে খুড়ছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের এমন সমন্বয়হীনতায় চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন রাজধানীবাসী। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রশাসনের ব্যর্থতা বা দুর্বলতার জন্যই নগরীর এই বেহাল দশা।
মতিঝিল এজিবি কলোনি, শাহজাহানপুর, কমলাপুর ও রাজারবাগ এলাকায় রয়েছে বেশ কিছু সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। উন্নয়ন খোঁড়াখুঁড়িতে এ সমস্ত এলাকার সড়কগুলোর অবস্থা এখন বেহাল। এতে ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রী ও আভিভাবকেরা পড়েছে চরম দুর্ভোগে। মতিঝিল সেন্ট্রাল গভমেন্ট স্কুলের উল্টো পাশের সড়কটিতে গত বছর খানেক আগে স্যুয়ারেজের পাইপ বসানোর কাজের জন্য কাটা হয়েছিল। মাসের পর পর মাস কেটে গেলেও সড়কটি সংস্কারের কাজের কোন উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। যে কারণে এই সড়কটিতে প্রতিদিন ভোর থেকেই শুরু হয় যানজট। রাত দুপুরেও এই যানজটের শেষ হয় না। এতে বিশেষ করে কোমল মতি ছাত্র ছাত্রীরাই পড়েছে বেশি ভোগান্তিতে।
মতিঝিল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী রিজিয় সরোয়ারের মা শিরিন আখতার হ্যাপি বলেন, একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকার রাস্তার সামন্য এই কাজটুকুন এতোদিন অসমাপ্ত আবস্থায় পড়ে থাকার কোন যুক্তিই থাকতে পারে না। বেহাল সড়কের এই টুকু অংশের কার্পেটিংয়ের কাজ শেষ হলেই আমাদের কিছুটা হলেও দুর্ভোগ কমতো। তিনি বলেন, বাচ্চাকে নিয়ে আগে স্কুলে আসতে সময় লাগতে মাত্র ১৫ মিনিট। আর এখন আধা ঘণ্টা, ৪৫ মিনিটের আগে আসাই যায় না। কখনো কখনো এক ঘণ্টাও লেগে যায়। এই দুর্ভোগের শেষ কবে হবে। কবে যানজটের এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবো কে জানে।
মতিঝিল শাপলা চত্বরের উত্তর দিক থেকে ফকিরাপুল পর্যন্ত সড়করে দুই পাশে বড় বড় পাইপ রেখে রাস্তার বিশাল অংশ দখল করে রাখা হয়েছে গত ৮/৯ মাস ধরে। যে কারণে গুরুত্বপূর্ণ এই সড়কটিতে রাতদিন ২৪ ঘণ্টাই যানজট লেগে থাকে। রাজধানী থেকে দেশের বিভিন্ন জেলার উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়া বিভিন্ন নামি-দামি বিলাসবহুল বাস সার্ভিসের বাসগুলোর কাউন্টার এই সড়কটির দুই পাশেই। যে কারণে দিনের ব্যস্ততা শেষে এই সড়কটিতে রাতের ব্যস্ততা বেড়ে যায় কয়েকগুণ। দিনের বেলায় শহর সার্ভিসের যানজট আর রাতের বেলায় আন্তঃজেলা বাস সার্ভিসের যানজটে যাত্রিদের দুর্ভোগ যেন চরমে উঠেছে। এ যেন দেখার কেউ নেই।
শ্যামলী পরিবহনের যাত্রি জাহাঙ্গীর আলম সাগর বলেন, আমার বাসা থেকে ইডেন কমপ্লেক্সের দুরত্ব বড় জোর তিন কি. মি. হবে। এটুকুন রাস্তা সিএনজিতে আসতে ১০ মিনিটের বেশি সময় লাগার কথা নয়। অথচ আধা ঘণ্টার বেশি সময় লেগেছে শুধু ফকিরাপুল সিগনাল পার হতেই। তিনি বলেন, উন্নয়ন কাজের নামে এই সড়কটিতে যা হচ্ছে তা মেনে নেয়ার মত নয়। দিনের পর দিন পাইপ রেখে একটি জনগুরুত্বপূর্ণ সড়ক আটকে রেখে এমন উন্নয়ন কাজ এ দেশের মানুষ কখনোই চায় না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডিএসসিসি’র বাজেট ঘোষণার কয়েক মাস আগে থেকে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি শুরু হয়। তারপর সেই রাস্তা যথাযথ মেরামতের জন্য আর কোনো সংস্থাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। সা¤প্রতিক সময়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের খিলগাঁও, শাহজাহানপুর, মালিবাগ, গোড়ান, সবুজবাগ এলাকায় সবচেয়ে বেশি রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। এই অবস্থায় থাকছে মাসের পর মাস। যে সংস্থা রাস্তা খুঁড়ছে এবং যে ঠিকাদার কাজ করছে তারা কেউই কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা করছে না।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন থেকে জানা গেছে, রাজধানীর পানিবদ্ধতা নিরসনে সিটি কর্পোরেশন একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। ছয় মাস আগে এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন করে পানিবদ্ধতা নিরসন করাই এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য। প্রকল্প হাতে নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে খিলগাঁও, শাহজাহানপুর, গোড়ান ও মালিবাগ এলাকাকে গুরুত্ব দিয়ে কাজ শুরু করা হয়। পর্যায়ক্রমে নগরীর অন্যান্য এলাকায়ও একই ধরনের উন্নয়ন কাজ শুরু হবে বলে জানা গেছে। নতুন অর্থবছরের উন্নয়ন কাজ করতে গেলে রাস্তা খোঁড়ার প্রয়োজন রয়েছে বলেও সূত্র জানায়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাপার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, নগর পারিকল্পনাবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব ইনকিলাবকে বলেন, রাজধানী শহরে যে সমস্ত উন্নয়ন কাজ চলছে তার সঠিক তত্ত¡াবধায়ন ও সমন্বয় হচ্ছে না। কর্তৃপক্ষের সঠিক তত্ত¡াবধায়ন ও সমন্বয় থাকলে সড়কের এই বেহল দশা হতো বলে আমার মনে হয় না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন