ভোরে মেঘের কোল ঘেঁষে অপরূপ সৌন্দর্য নিয়ে সূর্যের উদয়। পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে সাদা মেঘের ঢেউ। দিনভর রোদের সঙ্গে ঝিরঝির বাতাস। গোধুলী বেলায় রক্তিম আভা ছড়িয়ে পশ্চিমাকাশে সূর্যের ডুব।
সবুজের বুকে ছুটে চলা আঁকাবাঁকা উঁচুনিচু পথ যেন অন্তহীন। হাত বাড়ালেই ছুঁয়ে দেয়া যায় মেঘেদের। নীরব প্রকৃতিতে বাতাসের তোড়ে কলাপাতায় ফড়ফড় শব্দ। ঝিঁঝিঁসহ নানা পতঙ্গের ছন্দবদ্ধ সুর। প্রকৃতির এত কাছাকাছি আসা, বুক ভরে নির্মল বাতাস নেয়া, আর স্বর্গীয় দৃশ্য দেখে চোখ জুড়ানো জায়গার নাম বান্দরবান! যেখানে পাহাড় আর আকাশের মিতালী, দূরে সবুজ বন কিংবা চট্রগ্রামের সমুদ্র সৈকতের সৌন্দর্য আবছা আবছা উপভোগ করা যায়।
যাতায়াত ব্যবস্থা : বান্দরবানে পর্যকটদের পরিবহন সুবিধা দেবার জন্যে রয়েছে জীপ, মাইক্রোবাস, ল্যান্ড রোভার, নিশান পেট্রোল, প্যাজেরা, চাঁদের গাড়িসহ বিভিন্ন মানের গাড়ি। পরিবহন মালিক সমিতির নির্ধারিত ভাড়ায় এসব গাড়ির সার্ভিস দিয়ে থাকে। শহরে ট্রাফিক মোড়ে সিএনজি স্ট্যান্ড। গাড়ির মান ভেদে ভাড়ার তারতম্য হয়। এখানে সর্বনিম্ন এবং সর্বোচ্চ ভাড়া উল্লেখ করা হয়েছে।
কীভাবে আসবেন : ঢাকা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও রাঙামাটি থেকে সরাসরি বাস সার্ভিস রয়েছে। চালু আছে এসি, নন-এসি বিভিন্ন মানের বাস। ঢাকা থেকে ভাড়া ৬৬০ থেকে ১৫০০ টাকা পর্যন্ত। ঢাকা থেকে বান্দরবান আসতে সময় লাগবে প্রায় ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা। চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট বাস টার্নিমাল হয়ে বাসে আসলে সময় লাগবে প্রায় ২ঘণ্টা।
সাইরু রিসোর্ট : বান্দরবান জেলার “সাইরুল রিসোর্ট” পর্যটন প্রেমীদের সর্বশেষ সংযোজন। পর্যকটদের মতে, এটি দার্জিলিংকে ও হার মানাবে। জেলা শহর থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে চিম্বুক সড়কে ওয়াই জংশন নামক সেনা ক্যাম্প সংলগ্ন এলাকায় প্রকৃতিক অপরূপ পাদদেশে এটি অবস্থিত। সাইরু নাম করণে ১টি বেদনা বিধূর ইতিহাস ও রয়েছে। সাইরুর অভ্যন্তরে নিজস্ব টমটম নিয়ে আঁকাবাঁকা পাহাড়ে নি:শব্দ গতিতে প্রতিনিয়ত পর্যটকদের নিয়ে চলা সাইরুর জিরো পয়েন্টে নিয়ে যাওয়াকে দারুন আন্দোলিত করা। সাইরুর অন্যতম নান্দনিক নিদর্শন হল সুইমিংপুল। যা ভ‚-পৃষ্ঠ থেকে ১৮০০ ফুট উপরে অবস্থিত।
মেঘলা : বান্দবানের প্রবেশ পথেই জেলা পরিষদ অফিস সংলগ্ন এলাকায় মেঘলা পর্যটন কমপ্লেক্স। ছায়া সুনিবিড় বৈচিত্র্যে ভরা মেঘলা পর্যটন কমপ্লেক্স পেতে পারেন অনাবিল আনন্দের সন্ধান। জেলা প্রশাসনের পরিচালনায় বান্দরবান শহর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরের এই পর্যটন কেন্দ্রে রয়েছে স্বচ্ছ পানির নয়নাভিরাম হ্রদ, হ্রদের ওপর দু’টি ঝুলন্ত সেতু, উন্মুক্ত মঞ্চ, একাধিক পিকনিক স্পট, অরুন সারকী মিউজিয়াম, ক্যান্টিন, মিনি চিড়িয়াখানা, হ্রদের পানিতে প্যাডেল বোটে চড়ার ব্যবস্থা, বিশ্রামাগার, শিশুপার্ক ইত্যাদি।
নীলাচল : শহরে খুব কাছেই ১৮শ ফুট পাহাড় চ‚ড়ায় এই পর্যটন স্পট বান্দবানের পর্যটন শিল্পে যোগ করেছে ভিন্নমাত্রা। আকাশ ছোয়ার স্বপ্ন সবারই থাকে। নীলাচল থেকে আকাশ ছোঁয়া না গেলেও মনে হবে আকাশ আপনাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। মেঘের রাজ্যে হারিয়ে যাবার স্বপ্ন যদি কারো থাকে, তাহলে সে স্বপ্নও পূরণ হবে নীলাচাল গেলে। শহর থেকে নীলাচলের দূরত্ব ৬ কিলোমিটার। নীলাচলের কোল ঘোঁষেই তঞ্চঙ্গ্যা, মারমা ও ত্রিপুরাদের বসবাস। নীলাচলে দাঁড়ালে চারপাশে দেখা যাবে সারি সারি পর্বতমালা। মনে হবে আকাশ যেন নুয়ে পড়েছে পাহাড় চ‚ড়ায়।
শৈল প্রপাত : বান্দরবান শহর থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত প্রাকৃতিক ঝর্না শৈলপ্রপাত। পাহাড়ের কোল বেয়ে স্বচ্ছ পানির অবিরাম ঝর্নাধারা শৈলপ্রপাত বান্দরবানের আকর্ষণীয় পর্যটন স্পটের একটি। দূর থেকে দূরে ছুটে চলা হিমশীতল পানিতে গা জুড়াতে পর্যটকদের আনাগোনা লেগে থাকে সব মৌসুমে। পাহাড়ের পাদদেশে ঝর্নার পাড়ে পিকনিক করার উপযোগী পরিবেশ রয়েছে। বন-বানীর নিস্তব্ধতার মাঝে পাখির কলাকাকলিতে মুখর শৈলপ্রপাত নগর জীবনের কোলাহল থেকে অনেক দূরে।
শৈলপ্রপাতে গেলেই চোখে পড়বে বম নৃ-গোষ্ঠীর জীবনধারা। এখানে রয়েছে বমদের কয়েকটি পাড়া। তাদের হাতে বোনা চাদর, মাফলার, বেডশীটসহ বেত ও বাঁশের তৈরি বিভিন্ন আসবাব ও তৈজসপত্র এখানে পাওয়া যায় এখানে। বন নারী পুরুষরা শৈল প্রপাতকে ঘিরে এসব জিনিসের পসরা সাজিয়ে বসে। নিজেদের বাগানে উৎপাদিত তাজা আনারস, পেঁপে, কাঁঠালসহ নানা ফলমূল ও এখানে বিক্রি করেন তারা।
প্রন্তিক লেক : প্রায় ২৫ বছর জায়গা জুড়ে সৃষ্ট কৃত্রিম জলাশয় প্রান্তিক লেক। এর জলাভূমির আয়তন ২৫ একর হলে ও পুরো কমপ্লেক্সটি আরো অনেক বড়। এর স্পটকিস্বচ্ছ জলে বাতাসের খোলা দেখে আপনি কাটিয়ে দিতে পারেন সারা দিন। বিশেষ করে পিকনিকের জন্য এটি অত্যন্ত লোভনীয় স্থান হিসাবে ইতোমধ্যে পরিচিত পেয়েছে সবত্র। এটি বান্দরবান-কেরণীহাট সড়কের পাশে হলুদিয়া নামক জায়গার অবস্থিত। মূল সড়ক থেকে এর দূরত্ব প্রায় ৫ কিলোমিটার।
চিম্বক
সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে আনুমানিক ১ হাজার ৫শ ফুট উঁচু চিম্বুক পাহাড়ের চ‚ড়া। সমতল থেকে যে পাহাড়গুলো অনেক উঁচু মনে হয়, চিম্বুক পাহাড়ের চ‚ড়া থেকে সেগুলোকে মনে হবে ছোট ছোট টিলার মত। চিম্বুক পাহাড়ের উপর থেকে পরিস্কার আবহাওয়ায় কক্সবাজারের সমুদ্র পর্যন্ত দেখা যায়। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথে সর্পিল গতিতে চিম্বুক পাহাড়ের দিকে যেতে যেতে অনেক পর্যটকই এটিকে বাংলার দার্জিলিং হিসেবে অ্যাখ্যায়িত করেন। এর সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হলো বর্ষকালে। ভারী মেঘ তখন একদম নিচে নেমে এসে আপনাকে ঢেকে ফেলবে। মেঘের রাজ্যে হারিয়ে যাওয়া কল্পনার ব্যাপার হলেও এখানে তা সত্যি হয়ে যায় কখনো কখনো। এটি বান্দরবান শহর থেকে ২৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।
নীলগরি : সেনাবাহিনী পরিচালিত নীলগিরি পর্যটন কেন্দ্র বান্দরবানে পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ। বান্দরবান শহর থেকে নীলগিরির দিকে যেতে যেতে পাহাড় ক্রমশ: উঁচু হবে। রাস্তার দু’পাশে ঘন সবুজে ঢাকা সারি সারি পাহাড়, জুমচাষ আর ছোট ছোট গ্রাম আপনাকে নিয়ে যাবে এক অন্য জগতে। নীলগিরি ও এর আশপাশের এলাকাগুলোতে প্রায় সারা বছরই মেঘের আনাগোনা লেগে থাকে। রাস্তার কোনো বাঁকে এই রোদের দেখা পেলেন তো পরের বাঁকে আবার সারি সারি মেঘ ছুটে এসে আপনাকে ঢেকে দেবে। মেঘ ছুঁতে চাওয়ার সাধ যদি থাকে, তাহলে নীলগিরিই আপনার কাঙ্কিত ঠিকানা। বান্দরবান শহর থেকে নীলগিরির দূরত্ব ৪৭ কিলোমিটার।
রিজুক ঝর্ণা : পাহাড়ের গা বেয়ে অবিরল ধারায় সাঙ্গু নদীর বুকে ঝরে পড়া ও জলপ্রপাতটি বান্দরবান শহর থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে রুমা উপজেলায় অবস্থিত। প্রায় ৩শ’ ফুট উঁচু থেকে ঝরে পড়া জলপ্রপাতের রিমঝিম সুরের মুর্ছনা আপনাকে নিয়ে যাবে অন্য এক জগতে। এর আশেপাশে জায়গাগুলোও মনকাড়া প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ভরপুর। রিজুক দেখতে গিয়ে নৌকা ভ্রমণের আনন্দ আর ঝর্নার অপরূপ দু’টোই উপভোগ করা যায়।
বগা লেক : পাহাড় চুড়ায় প্রায় ১৫ একর জুড়ে স্বচ্ছ জলের মনোরম সরোবর এটি। এর গঠনশৈলী দেখে অনেকে এটিকে মৃত আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ বলেও ধারণা করেন। এটি রুমা উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। শুকনো মৌসুমে রুমা বাজার থেকে জীপে যাওয়া যায়। তবে বর্ষা মৌসুমে বগা লেক যেতে হলে পায়ে হাঁটা ছাড়া উপায় নেই।
কেওক্রাডং : দেশের উচ্চতম পর্বকশৃঙ্গের মধ্যে একটি হলো কেওক্রাডং। এর উচ্চতা ৩ হাজার ১৭২ ফুট। এটি রুমা উপজেলার রেমাক্রী প্রাংসা মৌজার পাসিং ¤্রাে পাড়ার কাছে অবস্থিত। রুমা উপজেলা সদর থেকে এটি ২৫ কিলোমিটার দুরে। আর বগা লেক থেকে এটির দূরত্ব প্রায় ৮ কিলোমিটার। শুকনো মৌসুমে যানবাহনে বগা লেক থেকে কেওক্রাডং যাওয়া সম্ভব হলেও বর্ষা মৌসুমে সেখানে যাওয়ার একমাত্র উপায় পায়ে হাঁটা।
শুকনো মৌসুমে রুমা বাজার থেকে জীপে চড়ে কেওক্রাডং পাহাড়ের কাছাকাছি যাওয়া সম্ভব। এছাড়া বগা লেক থেকে হেঁটে কেওক্রাডং যাওয়া যায়। সেক্ষেত্রে ভোরে রওনা দিয়ে চিংড়ি ঝর্ণা ও হারমন পাড়া পেরিয়ে দার্জিলিং পাড়া হয়ে কেওক্রাডংয়ে পৌঁছতে হবে। স্থানীয় গাইডের সহায়তায় এসব এলাকা পেরিয়ে কেওক্রাডং পৌঁছানো মোটেও কঠিন নয়। শুধু হাটার মনোবল এবং শারিরীক সক্ষমতা থাকতে হবে।
তাজিংডং : এটিও বাংলাদেশের উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গগুলোর মধ্যে অন্যতম। তাজিংডংকে এক সময় বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পাহাড় হিসেবে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি তথ্যে উল্লেখ করা হলেও পরে বিভিন্ন ব্যক্তিও প্রতিষ্ঠান বান্দরবানে আরো উঁচু পাহাড়ের তথ্য প্রকাশ করেছেন। তবে এগুলোর কোনোটিই এখনো সরকারিভাবে স্বীকৃত হয়নি। রুমা উপজেলা সদর থেকে তাজিংডংয়ের দূরত্ব ৩৪ কিলোমিটার। বান্দরবানের রুমা ও থানচি দুই উপজেলা থেকেই তাজিংডং যাওয়া যায়।
এছাড়া নাফাখুং ও রেমাক্রীখুং রেমাক্রী খালের পাানি পাথুরে পাহাড় বেয়ে নামতে গিয়ে এই জলপ্রপাতের সৃষ্টি হয়েছে। নাফাখুম যাবার পথেই রেমাক্রী বাজারের কাছে রয়েছে রেমাক্রীখুম। এর রূপেও যে কোনো সৌন্দর্য পিপাসু মানুষের মন মাতিয়ে দেবে সহজেই।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন