শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

রংপুরের বিএনপি কি ‘ফিনিক্স পাখি’

প্রকাশের সময় : ২৮ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

স্টালিন সরকার (রংপুর থেকে ফিরে) : রংপুর থেকে ‘বিএনপি’ শব্দটি কার্যত উধাও হয়ে গেছে। কারো মুখে এ নাম উচ্চারিত হয় না। বিভাগীয় শহরের গ্রা- হোটেল মোডে একটি অফিস থাকলেও নেতাকর্মীদের কোনো আনাগোনা নেই। উপজেলা এবং গ্রামের হাট-বাজারের চিত্রও একই। সর্বত্রই আওয়ামী লীগ নিয়ে হৈচৈ শোরগোল, কোথাও নেই বিএনপি। অথচ দলটির জনসমর্থন ব্যাপক। সাধারণ মানুষ মনে করেন পুলিশি জুলুম-নির্যাতনে বিএনপি ‘হারিয়ে গেছে’। কেউ কেউ বলে থাকেন জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী দলটি জুলুম-নির্যাতনের আগুনে জ্বলেপুড়ে ছাইভস্ম হয়ে গেছে। কিন্তু নীরব থাকা বিএনপির কর্মী-সমর্থকদের বক্তব্য হলো- সময়ের প্রয়োজনে রংপুরে বিএনপি ফিনিক্স পাখির কৌশল নিয়েছে। সময় হলেই ছাইভস্ম থেকে বেরিয়ে আকাশে উড়বে।
দেশে অসংখ্য রাজনৈতিক দল থাকলেও জনগণের ভোটে ক্ষমতায় যাওয়ার সাংগঠনিক অবস্থা মাত্র দু’টি দলের। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। বর্তমানে ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারীর বিতর্কিত নির্বাচনের আগে যতগুলো জরিপ হয়েছে সবগুলোতে শতকরা ৭০ থেকে ৮০ ভাগ মানুষ ধানের শীষে ভোট দেয়ার পক্ষে মত দেন। ৮ থেকে ১০ প্রতিষ্ঠানের করা সে জরীপের চিত্র দেশী-বিদেশী মিডিয়ায় তুলে ধরা হয়। কিন্তু ৫ জানুয়ারীর নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। নজীরবিহীন ও নির্বাচনের পর এখন সর্বত্রই আওয়ামী লীগ। গাছের মগডালে আওয়ামী লীগ; নীচেও আওয়ামী লীগ। ক্ষমতায় টিকে থাকার লক্ষ্যে পুলিশ দিয়ে প্রতিপক্ষ বিএনপিকে করা হয়েছে ‘সাইজ’। পুলিশের স্ট্রীম রোলার, গ্রেফতার, জুলুম-নির্যাতন এমন পর্যায়ে চলে যায় যে, ক্ষমতাসীন দলের বাইরে থাকা বৃহৎ দল বিএনপির কেন্দ্র থেকে শুরু করে শেকড় পর্যায়ের নেতাকর্মীদের নাস্তানাবুদ করা হয়। কেন্দ্রের কিছু সুবিধাবাদী নেতা ‘সমঝোতা’ করে নিজেদের টিকিয়ে রাখলেও তৃণমূলের অধিকাংশ নেতাকর্মী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখার অপরাধে (!) নানাভাবে হয়রানীর শিকার হন। মাসের পর মাস পলাতক জীবন-যাপন করেন। কর্মী সমর্থকদেরও একই হাল। হামলা মামলা নাস্তানাবুদ হয়ে পড়েন তৃর্ণমূলের নেতারা। বিশেষ করে রংপুর বিভাগের বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটের নেতারা পড়েন চরম বিপর্যয়কর অবস্থায়। তাদের ওপর বয়ে যায় সুনামী। পুলিশি জুলুম-নির্যাতন, গ্রেফতারের ভয়ে নেতারা কার্যত ‘রাজনীতি’কে ছুটি দিতে বাধ্য হন। আর জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী সাধারণ মানুষ (ধানের শীষের ভোটার) ঝামেলামুক্ত থাকার চেষ্টায় আওয়ামী লীগের দিকে ঝুঁকে গেছেন। যারা সারাজীবন আওয়ামী লীগ বিরোধী রাজনীতি করেছেন, আওয়ামী লীগ করেন এমন ব্যাক্তিদের সঙ্গে আত্মীয়তা পর্যন্ত করতেন না; তারাও হাট-বাজার, রাস্তা-ঘাটে আওয়ামী লীগ হিসেবে পরিচয় দিয়ে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করছেন।
রংপুর শহর ও কয়েকটি গ্রামে তিন দিন ঘুরলেও ইচ্ছে করেই আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কোনো নেতার সঙ্গে কথা বলিনি। সব রাজনৈতিক দলের নেতার সঙ্গে পরিচয় ও জানাশোনা থাকলেও তাদের এড়িয়ে চলেছি; সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি। বাস্তবচিত্র বোঝার চেষ্টা করেছি। গ্রাম এবং বিভাগীয় শহরের সাধারণ মানুষ ও পেশাজীবীরা জানান, প্রশাসনিক থানা, উপজেলা পরিষদ থেকে শুরু করে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতারা। উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবং ওসিরা শুধুই ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাদের আজ্ঞাবহ। হাট ইজারা, মামলা মোকদ্দমা, কৃষক কার্ড, বিচার-সালিশ, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা পরিচালনা সবকিছু আওয়ামী লীগ নেতাদের নিয়ন্ত্রণে। থানায় মামলা মোকদ্দমা হবে কি হবে না; হলে কার বিরুদ্ধে হবে, আসামী হবে কারা কারা সবকিছু ঠিক করে দেন নেতারা। রাষ্ট্রের কর্মচারীরা কার্যত সে আদেশ নির্দেশ পালন করেন। স্থানীয় নেতাদের ইচ্ছা মাফিক কারণে-অকারণে পুলিশের গ্রেফতার, সাধারণ মানুষের দৌঁড়ানি ইত্যাদি উপদ্রব চলছেই। জামায়াত-শিবির ধরার নামে গত তিন বছরে সবচেয়ে বেশি মানুষ গ্রেফতার হয়েছে রংপুরে। আইন-শৃংখলা বাহিনীর চোখে রংপুর নাকি এখন ডেঞ্জার জোন। সাধারণ নিরীহ মানুষ ঝুট ঝামেলা এড়িয়ে চলতে চায়। তাই জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী হয়েও সময়ের প্রয়োজনে আওয়ামী লীগের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। বিএনপির রাজনীতি কার্যত ছিঁকেয় তুলে রাখা হয়েছে। আর এরশাদের জাতীয় পার্টি! এরশাদের নাম শুনলেই মানুষ খিস্তিখেউর করেন। থুথু বাবা, জুতা বাবা বলে গালিগালাজ করেন। সুবিধাবাদী রাজনীতি, সকাল-বিকাল সিদ্ধান্ত বদল, স্ত্রী রওশনের আঁচলে বন্দীত্ববরণ সর্বপরি রংপুরের মানুষের জন্য কিছু না করায় অধিকাংশ মানুষ তাদের ভোটের ডিকশনারী থেকে এরশাদের নাম মুঁছে দিয়েছেন। ফলে রংপুরে আওয়ামী লীগের বাইরে যে সব ভোট রয়েছে তার বেশিরভাগই ২০ দলীয় জোটের পক্ষে। অথচ সাধারণ মানুষ এ মুহূর্তে বিএনপির নামটি পর্যন্ত উচ্চারণ করছেন না। পীরগাছা বাজারে একজন পান ব্যবসায়ী এর কারণ ব্যাখ্যা করে বলেন, বিএনপির কোনো সাংগঠনিক কর্মসূচি নেই। বিএনপির কথা বলে আমরা কেন অযাচিত বিপদে পড়বো? সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে আওয়ামী লীগ। তার মতে ৫ জানুয়ারি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অনাকাক্সক্ষীত ঘটনায় রংপুরের বিভিন্ন থানায় বিএনপির অসংখ্য নেতাকর্মীর নামে মামলার খড়গ ঝুলছে। মামলার কারণে অনেক নেতাকর্মী প্রকাশ্যে কাজ করতে পারেননি। তারা ছিলেন আত্মগোপনে। কেউ কেউ কারারুদ্ধ হয়েছেন। আবার রংপুর মহানগর কমিটির নেতা মুক্তিযোদ্ধা মোফাফ্ফর হোসেন কয়েকদিন নিখোঁজ ছিলেন। অতঃপর তাকে লালমনিরহাট থেকে উদ্ধারের নাটক করা হয়। এই নিখোঁজ প্রকৃত চিত্র সবাই জানা। যার কারণে দলের সাংগঠনিক কর্মকা- হয়ে পড়েছে স্থবির। কার্যত হারিয়ে গেছে বিএনপি
সুবিধাবাদীরা সব সময় ক্ষমতাসীন দলে থাকেন। তবে বর্তমানে সাধারণ মানুষের মধ্যে যারা নিজেদের আওয়ামী লীগ হিসেবে পরিচয় দিচ্ছেন তাদের কথাবার্তায় রহস্যময় মনে হলো। কয়েকটি বাজারে বিভিন্নজনের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, টিকে থাকার প্রয়োজনে আওয়ামী লীগ হয়েছি। এটা প্রকাশ্যের খবর; পর্দা আড়ালের চিত্র উল্টো। জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসীরা কি কখনো আওয়ামী লীগ করতে পারে? জুলুম-নির্যাতন আর কত সহ্য করা যায়? অনেকেই জানান, তারা মূলত সময় পার করছেন। বিএনপি কর্মসূচি ঘোষণা করলেই যথারীতি মাঠে নামবেন। কয়েকজন জানান, তারা কৌশলগত কারণে এখন নৌকায় উঠেছেন। সময় হলেই নেমে পড়বেন। রংপুর শহরের শাপলা চত্বরে কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেল, প্রকাশ্যে বিএনপি কার্যক্রম কার্যত নেই। এতে আওয়ামী লীগ নেতারা দারুণ খুশি। কিন্তু ভিতরে ভিতরে সবাই চান নির্বাচন। বৃহত্তর রংপুরের একই অবস্থা জানতে চাইলে একজন ফিনিক্স পাখির সঙ্গে রংপুর বিভাগের বর্তমান বিএনপির তুলনা করলেন। বললেন, এই যে হাট-বাজারে ঘুরে দেখছেন সবাই আওয়ামী লীগ। কোথাও বিএনপি নেই। অথচ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারীর নির্বাচন ঠোকানো এবং ২০১৫ সালের ৯২ দিন হরতাল অবরোধ কর্মসূচি রংপুরে যেভাবে পালিত হয়েছে অন্য কোনো জেলায় সেভাবে হয়নি। ওই সময় রংপুর কার্যত ছিল অচল। যার কারণে পুলিশি জুলুম-নির্যাতন এখানে বেশি হয়েছে। ঝামেলা এড়াতে ‘আমরা সবাই আওয়ামী লীগ’ হুজুগ তুলে টিকে আছি। বিএনপিকে কোথাও পাচ্ছেন না? অনেকের ভাষায় বিএনপি রংপুরে ধ্বংস হয়ে গেছে; ছাইভস্ম হয়ে গেছে? আন্দোলনের ডাক আসুক। ফিনিক্স পাখি মতো ঘুরে দাঁড়াবে রংপুর বিএনপি। ক্ষমতাসীনদের জুলুম নির্যাতনে অতিষ্ট মানুষ এটা বিশ্বাস করে।
প্রশ্ন হলো ফিনিক্স পাখির উপমা কেন? ফিনিক্স পাখি হলো পুর্নজন্ম ও নিরাময়ের প্রতীক। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পর নতুন জীবনের দিক-নির্দেশনা রুপক। মূলত উপকথার অবিনাশী এক আগুনপাখির নাম ফিনিক্স। ওই আগুনরঙা পাখি নাকি পাঁচশ বছর বেঁচে থাকতে পারে। জীবনের শেষপ্রান্তে এসে পাখিটি দারুচিনি, গন্ধরস প্রভৃতি সুগন্ধী উদ্ভিদ দিয়ে তৈরি করে নীড়। তারপর সে নীড়ে ধরিয়ে দেয় আগুন। বাসাসহ ফিনিক্স পাখিটি পুড়ে ছাই হয়ে যায়। ভস্মীভূত সেই ছাই থেকে আবার জেগে ওঠে আরেকটি আগুনরঙা ফিনিক্স পাখি। রংপুরের বিএনপি কি সত্যিই ফিনিক্স পাখির মতোই জেগে উঠতে পারবে?

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (3)
আসিফ ২৮ জুন, ২০১৬, ১:০৬ পিএম says : 2
শুধু রংপুর থেকে নয় সারা দেশে থেকে ‘বিএনপি’ শব্দটি কার্যত উধাও হয়ে গেছে।
Total Reply(0)
ইনশা আল্লাহ ২৮ জুন, ২০১৬, ২:১৪ পিএম says : 0
রংপুরসহ সারা দেশে বিএনপি ফিনিক্স পাখির মতোই জেগে উঠবে।
Total Reply(0)
সাইফ ২৮ জুন, ২০১৬, ২:২৫ পিএম says : 0
ব্রিটেনের মত আমাদের দেশেও গণভোট হওয়া দরকার।
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন