স্পোর্টস ডেস্ক : পণ করেছিলেন দেশকে এবার শিরোপা উপহার দেবেন। তাঁর দীপ্ত অনুপ্রেরণায় টুর্নামেন্টে তাঁর দল আর্জেন্টিনাও ছিল দুরন্ত-দুর্বার। কিন্তু ফাইনালে এসে আবারো সেই বিষাদময় ব্যর্থতার কাব্যগাঁথা। এ নিয়ে টানা তিনবার (মোট চারবার) বৈশ্বিক ফুটবল আসরের ফাইনালে উঠেও ভক্তদের শিরোপার স্বাদ দিতে পারলেন না লিওনেল মেসি। বার বার এত কাছে এসেও ব্যর্থ হওয়ায় মেসিও যেন এক ক্লান্ত পথিক। ভাগ্য যেন তাঁর সাথে মরীচিকার মতো মিথ্যে খেলায় মাতোয়ারা। আর কেন? দুঃখ, ক্ষোভ আর হতাশায় তাই এবার সিদ্ধান্ত নিলেন জাতীয় দলের জার্সি খুলে রাখার!
খেলায় হার-জিত থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তাই বলে হারের হতাশায় পুড়ে প্রিয় খেলোয়াড় এভাবে অবসরের ঘোষণা দেবেন, এ তো ফুটবলপ্রেমিদের কল্পনাতেও আসেনি। আসলে আর্জেন্টাইন অধিনায়ককে সবচেয়ে বেশি পোড়াচ্ছে তাঁর সেই পেনাল্টি মিসের ঘটনাটি। তার কারণেই তো টাইব্রেকারের শুরুতে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ হাতছাড়া হয় আর্জেন্টিনার। চিলির হয়ে আর্তুরো ভিদালের পেনাল্টি মিসের পর দলের হয়ে প্রথম শট নিতে এসে বল ক্রসবারের ওপর দিয়ে উড়িয়ে মারেন মেসি। দলও চিলির কাছে হারে ৪-২ গোলে। দেশের হয়ে একটি শিরোপা জয় যার আজন্ম ইচ্ছে, তার মতো মানুষ এই ব্যর্থতা মেনে নেবেন কেন! শেষ পর্যন্ত তাই একবুক ক্লেষ নিয়ে জাতীয় দলকে গুডবাই জানালেন ফুটবল জাদুকর।
ম্যাচ শেষে ৫ বারের বর্ষসেরা বলেন, “এটা হৃদয়বিদারক, যা বিশ্লেষণ করা যায় না। ড্রেসিংরুমে আমার মনে হলো, জাতীয় দলে আমার খেলা শেষ। এটা আমার জন্য না।” শ্লেষমিশ্রিত ভগ্নকণ্ঠে ২৯ বছর বয়সী মেসি বলেন, “আমি আর্জেন্টিনার হয়ে চ্যাম্পিয়ন হতে জোর চেষ্টা করেছি, কিন্তু হয়নি। আমি এটা করতে পারিনি।” তিনি বলেন, “এটা অনেক কঠিন সিদ্ধান্ত; কিন্তু এটা নেয়া হয়ে গেছে। আমি আর চেষ্টা করব না। আর ফিরে যাওয়া হবে না।”
ক্যারিয়ারের শুরুতে ২০০৭ সালে কোপার ফাইনালে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিলের কাছে হারতে হয়েছিল মেসিকে। সেবার টুর্নামেন্টের সেরা উদীয়মান খেলোয়াড়ের পুরস্কার জিতেছিলেন তিনি। এরপর ক্লাব বার্সেলোনার হয়ে দ্যুতি ছড়িয়েছেন, ছড়াচ্ছেন। ভক্তদের আজন্ম স্বাদ দেশের হয়েও একদিন বড় কোনো শিরোপা ঠিকই জিতবেন মেসি। কিন্তু ফুটবল বিধাতা যেন বার বার তাকে ভেঙচি কেটে বলতে থাকেÑ তুই বিশ্বসেরা বটে, কিন্তু দেশের হয়ে কোনো শিরোপা জিততে পারবি না।
২০১৪ সালে আর্জেন্টাইনদের কাছে একবুক স্বপ্ন নিয়ে আসে বিশ্বকাপের ফাইনাল। জার্মানির কাছে অতিরিক্ত সময়ের একমাত্র গোলে হারের সেই ক্ষত এখনো নিশ্চয় পোড়ায় তাদের। সেই দগদগে ক্ষত নিয়েই পরের বছর আবার কোপার ফাইনালে টাইব্রেকার ভাগ্যে চিলির কাছে ৪-১ গোলের সেই ব্যর্থকাব্য। কতই না গঞ্জনা সইতে হয়েছিল এরপর লিওনেল মেসিকে। বছরান্তে আবার যখন সুযোগ আসল দলের ২৩ বছরের শিরোপা বন্ধ্যাত্ব ঘোচাবার, তখনই আবার তাদের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াল সেই চিলি। এই সব স্মৃতি রোমন্থন করেই ফুটবল জাদুকর বলেন, “চারটা ফাইনাল হলো, এটা আমার জন্য না। আমরা চেষ্টা করেছি, আমি চেষ্টা করেছি। আমি এখন বড়ই ক্লান্ত। এখন আমি শুধু এটাই অনুভব করছি। আবার এটা ঘটতে দেখে আমি খুবই ব্যথিত।” কম্পিত কণ্ঠে মেসি বলেন, “আমি আমার পেনাল্টি মিস করেছি। ওটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল।”
২০০৫ সালে জাতীয় দলের জার্সি গায়ে চড়ানোর পর এ পর্যন্ত ১১২টি ম্যাচ খেলেছেন মেসি। সেমি-ফাইনালে দুর্দান্ত ফ্রি-কিকে যুক্তরাষ্ট্রের জালে বল পাঠিয়ে গাব্রিয়েল বাতিস্তুতার রেকর্ড ভেঙে হয়েছেন দেশের সর্বোচ্চ (৫৫টি) গোলদাতা। কিন্তু বার্সেলোনার হয়ে ২৮টি শিরোপা জেতা মেসির আজন্ম আক্ষেপ থেকে যাবে জাতীয় দলের হয়ে কোনো শিরোপা না জেতার ব্যর্থতা! তাঁর নৈপুণ্যে অবশ্য অলিম্পিকে সোনা জিতেছিল আর্জেন্টিনা। কিন্তু সেটা তো জাতীয় দলের হয়ে নয়, অনূর্ধ্ব-২৩ দলের হয়ে।
পরাজয়ের পর প্রচ- ভেঙে পড়েন মেসি। সতীর্থ ও বন্ধু সার্জিও আগুয়েরোর বলেন, মেসিকে নাকি এর আগে এমন ভেঙে পড়তে দেখেননি কখনো। ম্যানচেস্টার সিটি ফরোয়ার্ড বলেন, “দুর্ভাগ্যবশত, পেনাল্টি মিস করার জন্য সবচেয়ে বেশি ভেঙে পড়েছে মেসি। ম্যাচ শেষে ড্রেসিংরুমে তাকে এর চেয়ে বাজে অবস্থায় আমি আর কখনো দেখিনি।”
দলের আরেক সদস্য ও গোলরক্ষক সার্জিও রোমেরো মনে করেন হতাশা থেকেই মেসির এই সিদ্ধান্ত। ম্যানচেস্টার গোলরক্ষক বলেন, “আমি মনে করি, লিও আবেগময় হয়ে এটা বলেছে। কারণ, ভালো একটি সুযোগ ফসকে যেতে দিয়েছি আমরা। আমাদের মতো একই ভাবনা তার।” রোমেরো বলেন, “আমি মেসিকে ছাড়া জাতীয় দল কল্পনাই করতে পারছি না।”
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন