তাবলীগ জামাত আয়োজিত বিশ্ব ইজতেমা টঙ্গীর তুরাগ নদীর পূর্ব তীরে আজ বাদ ফজর আম বয়ানের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে ঢাকাসহ দেশের ৬৪ জেলা থেকে বাস-ট্রাক, ট্রেন, লঞ্চযোগে ও আশপাশের এলাকা থেকে পায়ে হেঁটে মুসল্লিরা ইজতেমা ময়দানে সমবেত হন। পুরো মাঠের জেলাওয়ারী খিত্তায় তাবলীগ জামাতের মুসল্লিরা গত বুধবার থেকে অবস্থান নিতে শুরু করেন। গতকাল সারাদিনই বিভিন্ন যানবাহন ও পায়ে হেঁটে দলে দলে মুসল্লিদের কাফেলা বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে প্রবেশ করতে দেখা গেছে। মুসল্লিদের স্রোত গতকাল রাত পর্যন্ত ইজতেমা মাঠের অভিমুখে অব্যাহত ছিল। লাখো মুসল্লির অংশগ্রহণে আজ দেশের বৃহত্তম জুমার জামাত অনুষ্ঠিত হবে ইজতেমা ময়দানে।
গতকাল সকাল সাড়ে ৮টার দিকে এক পশলা হালকা বৃষ্টি হয় টঙ্গীতে। এতে মুসল্লিরা কিছুটা সমস্যায় পড়েন। সকাল থেকে থেমে থেমে বৃষ্টি হয়। তবে এবার যেসব মুসল্লি ময়দানে তাদের খিত্তায় অবস্থান নিয়েছেন তাদের প্রায় সবাই বৃষ্টির বিষয়টি মাথায় রেখে পলিথিন-কাগজ সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। বেশি বৃষ্টি হলে ময়দানে চটের নিচে অবস্থান নেয়া মুসল্লিরা দুর্ভোগে পড়বেন। বিশেষ করে খোলা আকাশের নিচে রান্না-বান্না এবং খিত্তায় অবস্থান করাও কঠিন হয়ে যাবে।
ইয়াকুব আলী শিকদার (৮৫) নামে এক মুসল্লির গতকাল সকালে ইজতেমা ময়দানে মৃত্যু হয়েছে। তিনি গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার লাখিরপাড় এলাকার মৃত হাসেম আলীর ছেলে। ইজতেমার মুরব্বি হাজি রেজাউল করিম জানান, সকালে সাড়ে ৬টার দিকে ইয়াকুব আলী শিকদার নিজ খিত্তায় হৃদরোগে আক্রান্ত হন। এতে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। জোহরের নামাজের পর জানাজা শেষে তার লাশ গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে পাঠানো হয়েছে।
এদিকে মুসল্লিদের নিরাপত্তায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ইজতেমা ময়দান ও আশপাশের এলাকায় ৫ স্তরের নিরাপত্তা বলয় গড়ে তুলেছে। যাতে কোন কুচক্রী মহল ইজতেমা ময়দানে কোন নাশকতা সৃষ্টি করতে না পারে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা যে কোন জঙ্গি কার্যক্রম প্রতিহত করতে প্রস্তুত রয়েছে বলে জানান গাজীপুরের পুলিশ সুপার শামসুন্নাহার।
গতকাল থেকে ইজতেমা ময়দানের চারপাশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। এবারও বিশ্ব ইজতেমা ময়দানসহ আশপাশ সিসি ক্যামেরার আওতায় আনা হয়েছে। ইজতেমাস্থলের আইনশৃঙ্খলা নিয়ে অলিম্পিয়া টেক্সটাইল মিলস প্রাঙ্গণে পুলিশের এক ব্রিফিংয়ে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো. আনোয়ার হোসেন এসব তথ্য জানান।
তিনি জানান, ইজতেমা মাঠের সার্বিক নিরাপত্তার জন্য র্যাব-পুলিশসহ এবার বিশ্ব ইজতেমার দুই পর্বে ১০ হাজারের মতো নিরাপত্তাকর্মী দায়িত্ব পালন করবে। টঙ্গী ব্রিজ থেকে জয়দেবপুর চৌরাস্তা, মন্নু গেট থেকে কামারপাড়া পর্যন্ত এবং তুরাগ নদসহ পুরো এলাকাকে পাঁচটি সেক্টরে ভাগ করা হয়েছে। প্রতিটি সেক্টরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা কঠোর নজরদারির মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করবেন। ইজতেমা প্রবেশ পথগুলোতে চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। ইজতেমাকে ঘিরে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে মুসল্লিরা আসছেন। আমাদের কাজ তাদের সার্বিক নিরাপত্তা বিধান করা। গাজীপুর সিটি মেয়র জাহাঙ্গীর আলম জানান, সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে প্রশাসনের নজরদারির জন্য পর্যাপ্ত কন্ট্রোল রুম নির্মাণ করা হয়েছে। ইজতেমায় আগত দেশি-বিদেশি মুসল্লিদের স্বাগত জানিয়ে বিভিন্ন পয়েন্টে তোরণ, ইজতেমার নিরাপত্তার জন্য র্যাব ও পুলিশের ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ, ইজতেমায় নিয়োজিত নিরাপত্তা সদস্যদের জন্য অস্থায়ী টয়লেট নির্মাণ, ফগার মেশিনের মাধ্যমে মশক নিধন কার্যক্রম গ্রহণ, ইজতেমা কর্তৃপক্ষের চাহিদা মোতাবেক বিøচিং পাউডার সরবরাহ, ইজতেমা চলাকালে পর্যাপ্ত গার্বেজ ট্রাকের মাধ্যমে দিন-রাত বর্জ্য অপসারণ কার্যক্রম নিশ্চিতকরণ, কন্ট্রোল রুমসমূহ ও অন্যান্য স্থানে অস্থায়ীভাবে খুঁটি স্থাপনের মাধ্যমে শতাধিক বৈদ্যুতিক বাতির ব্যবস্থা করণ, তুরাগ নদীতে নিরাপত্তার জন্য টঙ্গী ব্রিজ ও কামারপাড়া ব্রিজের নীচে দুই পার্শ্বে বাঁশ দ্বারা ২টি বেষ্টনী নির্মাণ, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের চৌরাস্তা পর্যন্ত দুই পার্শ্বে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ ও রাস্তায় পার্কিং করা গাড়িসমূহ অপসারণ, ধূলাবালি নিয়ন্ত্রণের জন্য সার্বক্ষণিক পানি ছিটানোর ব্যবস্থা, রাস্তার দুই পাশে দেয়ালের অশ্লীল পোস্টার অপসারণের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এছাড়াও বিশ্ব ইজতেমা উপলক্ষে সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটি বাতিল করে ২৪ ঘণ্টা ইজতেমায় মুসল্লিদের সেবায় নিয়োজিত করা হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, ইজতেমাস্থলে তাদের একটি কন্ট্রোল রুম স্থাপন করা হয়েছে। যেখানে সার্বক্ষণিক কর্মকর্তাসহ ফায়ারম্যানরা অবস্থান করবেন। ময়দানের প্রতি খিত্তায় ফায়ার এক্সিস্টিংগুইসারসহ ফায়ারম্যান, গুদাম ঘর ও বিদেশি মেহমানখানা এলাকায় পানিবাহী গাড়ি, ডুবুরি ইউনিট, ১টি স্ট্যান্ডবাই লাইটিং ইউনিট এবং ৫টি অ্যাম্বুলেন্স থাকবে।
ডেসকো কর্তৃপক্ষ জানায়, ইজতেমা এলাকায় সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ সরবরাহের সকল প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। উত্তরা, টঙ্গী সুপার গ্রীড ও টঙ্গী নিউ গ্রীডকে মূল ১৩২ কেভি সোর্স হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছে। যে কোন একটি গ্রীড নষ্ট হলেও সামগ্রিক বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘিœত হবে না বলে জানায় ডেসকো কর্তৃপক্ষ। ইজতেমা এলাকায় ৪টি স্ট্যান্ডবাই জেনারেটর এবং ৫টি ট্রলি-মাউন্টেড ট্রান্সফর্মারও সংরক্ষণ করা হয়েছে মুসল্লিদের সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ সরবরাহ করার লক্ষ্যে।
ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশের প্রায় কয়েক হাজার বিদেশি মুসল্লি ঢাকার কাকরাইল মসজিদ, উত্তরা, টঙ্গী ও আশপাশের এলাকার মসজিদে মসজিদে অবস্থান করছেন। তাদের মধ্য থেকে প্রায় শতাধিক বিদেশি মুসল্লি ইতোমধ্যে ইজতেমা ময়দানের নির্ধারিত তাঁবুতে অবস্থান নিয়েছেন।
বিশ্ব ইজতেমার মাওলানা জুবায়ের অনুসারী মুরব্বি ইঞ্জিনিয়ার মাহফুজুর রহমান জানান, ময়দানকে মোট ৯২টি খিত্তায় ভাগ করা হয়েছে। এবার দেশের ৬৪ জেলার মুসল্লিরা অংশ নিচ্ছেন। তাদের জন্য ৮৭টি খিত্তা নির্ধারণ করা হয়েছে। পাঁচটি খিত্তা সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বে দেশের মুসল্লিদের পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা অংশ নেবেন। বিদেশি মেহমানদের জন্য বিশ্ব ইজতেমা ময়দানের উত্তর-পশ্চিম পাশে নিবাস তৈরি করা হয়েছে। সেখানে তাদের জন্য গরম পানি, রান্নার জন্য গ্যাস, উন্নত টয়লেটসহ নানা ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
এদিকে, ইজতেমা ময়দানে মুসল্লিদের যাতায়াতের সুবিধার্থে গতকাল থেকে বিআরটিসির শতাধিক স্পেশাল বাস সার্ভিস চলাচল করতে দেখা গেছে। বিআরটিসির সূত্র জানায়, আব্দুল্লাহপুর-মতিঝিল ভায়া ইজতেমাস্থল, শিববাড়ী-মতিঝিল ভায়া ইজতেমাস্থল, টঙ্গী-মতিঝিল ভায়া ইজতেমাস্থল, গাজীপুর-চৌরাস্তা, মতিঝিল-ভায়া ইজতেমাস্থল, গাবতলী-গাজীপুর ভায়া ইজতেমাস্থল, গাবতলী-মহাখালী ভায়া ইজতেমাস্থল, গাজীপুর-মতিঝিল ভায়া ইজতেমাস্থল, মতিঝিল-বাইপাল ভায়া ইজতেমাস্থল বিআরটিসির বাস সার্ভিস চলাচল করবে।
অপরদিকে বিশ্ব ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের যাতায়াতের সুবিধার্থে বাংলাদেশ রেলওয়ে বিশেষ ট্রেন সার্ভিস পরিচালনা করবে। এছাড়াও সকল আন্তঃনগর, মেইল এক্সপ্রেস ও লোকাল ট্রেনে অতিরিক্ত কোচ সংযোজন করা হয়েছে। ইজতেমা চলাকালীন সময়ে সকল আন্তঃনগর ট্রেন টঙ্গী রেলস্টেশনে দুই মিনিট করে যাত্রা বিরতি করবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন