ছাত্রী ধর্ষণের প্রতিবাদে ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবিতে সভা, সমাবেশ, কুশপুত্তলিকা দাহ, প্রতিকী ফাঁসিসহ বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে চতুর্থ দিনের মতো আন্দোলন করেছে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থীরা। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন তারা। শিক্ষার্থীরা ধর্ষণবিরোধী ফ্ল্যাশমব করেন।
১ম বর্ষের গণরুমের ছাত্ররা ধর্ষক মজনুর কুশপুত্তলিকা দাহ করেন। প্রতিবাদে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ৬ষ্ঠ সেমিস্টারের ১৬ শিক্ষার্থী পরীক্ষার হলে সাদা খাতা জমা দিয়ে পরীক্ষা স্থগিতের জন্য আন্দোলন করে। ধর্ষণের শিকার ঢাবি ছাত্রীকে ছাড়পত্র দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। অন্যদিকে, গ্রেফতারকৃত ব্যক্তি আসল ধর্ষক নাকি ‘জজ মিয়া নাটক’ মানুষ এ নিয়ে প্রশ্ন তুলছে বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) ভিপি নুরুল হক নুর। দুপুর ১২ টার দিকে অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে সমাবেশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থীরা। অর্ধশতাধিক ছাত্রীর অংশগ্রহণে এই সমাবেশে ধর্ষণের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার ঘোষণা দেন।
এরপরই বিক্ষোভ সমাবেশ করে ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। এতে অংশ নিয়ে ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের প্রফেসর ড. মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন বলেন, আমরা চাই ওই নরপিশাচের ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদÐ হোক এবং তা দ্রæত তার সাথে কার্যকর করা হোক। যাতে আর কোন ধর্ষক এই ধরনের কাজ করতে সাহস না পায়। জনগণের মধ্যে সংশয় কাটেনি: ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনায় গ্রেফতার মজনুকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার বিষয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ডাকসু ভিপি নুরুল হক নুর বলেছেন, একটা দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি কতটুকু অনাস্থা তৈরি হলে মানুষ গ্রেফতার হওয়া অপরাধীকে নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে। আপনারা দেখেছেন, ইতোমধ্যে মানুষ প্রশ্ন তুলছে সে আসল ধর্ষক কিনা নাকি এটি একটি জজ মিয়া নাটক। যদিও আমরা জানি না, আসলে সেটা কি। তবে, আমরা ধরে নিচ্ছি, সে প্রকৃত অপরাধী। কিন্ত এটা দেশের জন্য এলার্মিং যে, একটি দেশের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি মানুষের দিন দিন অনাস্থা তৈরি হচ্ছে।
গতকাল বিকেলে ঢাবির রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে ধর্ষণ ও নিপীড়নের প্রতিবাদে আয়োজিত এক গণপদযাত্রা শুরুর সময় ভিপি নুর এসব কথা বলেন। বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ এই গণপদযাত্রার আয়োজন করে। গণপদযাত্রাটি রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশ থেকে শুরু হয়ে ক্যাম্পাসের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে একই স্থানে এসে শেষ হয়। এ সময় পরিষদের আহŸায়ক হাসান আল মামুন, যুগ্ম আহŸায়ক রাশেদ খাঁন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। ডাকসু ভিপি বলেন, আমরা ধরে নিচ্ছি সে প্রকৃত ধর্ষক। কিন্তু সাধারণ মানুষ বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এ প্রশ্নের সুরাহা করতে হবে। আইনশ্ঙ্খৃলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকাÐের প্রতি মানুষের অনাস্থা ও সন্দেহ-সংশয় তৈরি হচ্ছে। সরকার ও আইনশ্ঙ্খৃলা রক্ষাকারী বাহিনীকেই সেই সংশয় দূর করতে হবে। তিনি বলেন, রাষ্ট্রকে মেরামত করতে হলে, রাষ্ট্রে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হলে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এজন্য তরুণ সমাজকে প্রতিবাদ করতে রাজপথে নেমে আসতে হবে।
ডাকসু ভিপি বলেন, যদি কিছু ঘটনায় প্রতিবাদমুখর হয়ে বাকি ঘটনাগুলোতে আমরা প্রতিবাদ না করি, তাহলে অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করা এবং সমাজ থেকে অপরাধ নির্মূল করা সম্ভব হবে না। সেজন্য ধর্ষণ, নারী নির্যাতনসহ সব অপরাধের বিরুদ্ধে আমাদের সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
ঢামেক থেকে ছাত্রীর রিলিজ: ধর্ষণের শিকার ঢাবির সেই ছাত্রীকে ছাড়পত্র দিয়েছেন চিকিৎসকরা। গতকাল দুপুর ১২টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টার থেকে ছাড়পত্র নিয়ে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে হাসপাতাল ছেড়ে যান ওই ছাত্রী। ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল একেএম নাসির উদ্দিন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, নিপীড়নের শিকার শিক্ষার্থীকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেয়া হয়েছে। তিনি আগের চেয়ে অনেকটাই সুস্থ। এক সপ্তাহ পর ওই শিক্ষার্থীকে ফলোআপের জন্য হাসপাতালে আসতে বলা হয়েছে। এদিকে, মেয়ের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন ভুক্তভোগীর বাবা। তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, র্যাব, পুলিশ প্রশাসনসহ দায়িত্বশীল সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন।
ধর্ষক মজনুর কুশপুত্তলিকা দাহ: এদিকে, ছাত্রী ধর্ষণের প্রতিবাদে দুপুর ১টার দিকে টিএসসির রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে ধর্ষক মজনুর কুশপুত্তলিকা দাহ করেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের গণরুমের শিক্ষার্থীরা। এর আগে ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদÐ চেয়ে ক্যাম্পাসে ডাকসু সদস্য তানবীর হাসান সৈকতের নেতৃত্বে তারা একটি কালো পতাকা মিছিল বের করেন। পরে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গা প্রদক্ষিণ করে সেটি রাজু ভাস্কর্যের সামনে এসে শেষ হয়। সেখানেই ধর্ষক মজনুর কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়। গণরুমবাসীর উদ্যোগে এ কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়েছে। এসময় তানবীর হাসান সৈকত বলেন, আজ হয়তো আমাদের বোন ধর্ষণ হওয়ার কারণে সর্বস্তরের মানুষ প্রতিবাদ করছে। আমাদের যে বাকী বোনরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে সরকার কি ব্যবস্থা নিচ্ছে? আমরা চাই, ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড করে আইন প্রণয়ন করা হোক।
ঢাবিতে ধর্ষণবিরোধী ফ্ল্যাশমব: ছাত্রী ধর্ষণের প্রতিবাদে ঢাবিতে ধর্ষণবিরোধী ফ্ল্যাশমব করেছে বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। গতকাল দুপুর দেড়টার দিকে ঢাবির রাজু ভাস্কর্যের সামনে তারা এই কর্মসূচি পালন করে। এর আগে গত মঙ্গলবার থেকে শুরু করে দুইদিন জাতীয় জাদুঘর, ঢাবির কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার, রাজু ভাস্কর্য, দোয়েল চত্বর ও শিল্পকলা একাডেমির সামনে ফ্ল্যাশমোবের ট্রায়াল দেয় শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীরা বলেন, ধর্ষণ কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থারই ফসল হলো ধর্ষণ। আমরা ধর্ষণের প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও তার সংলগ্ন এলাকাগুলোতে কথায় ও গানে আসল ধর্ষক ও এই সিস্টেমের দিকে আঙুল তুলতে ধর্ষণবিরোধী ফ্ল্যাশমোব করছি।
টিএসসিতে মজনুর প্রতিকী ফাঁসি: ধর্ষণকারী মজনুর ফাঁসির দাবি জানিয়ে প্রতিকী ফাঁসির আয়োজন করেছে ডাকসু। এর উদ্যোক্তা স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক সাদ বিন কাদের চৌধুরী। এদিন বিকেল ৫টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্রে (টিএসসি) স্থাপিত ‘নিপীড়ন বিরোধী ডাকসু মঞ্চে; এই কর্মসূচী করা হয়। সাদ বিন কাদের চৌধুরী বলেন, ঢাবি শিক্ষার্থী আমাদের এক বোন ধর্ষণের শিকার হন। ধর্ষককে গ্রেপ্তার করায় প্রশাসনকে ধন্যবাদ জানাই। এবং অতি দ্রæত যেন এর বিচার কাজ সম্পন্ন করা হয় এবং ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদÐ রেখে আইন প্রণয়ন করা হয় সেই দাবী জানাই।
পরীক্ষায় সাদা খাতা জমা: পরীক্ষার হলে ঢাবি শিক্ষার্থীর ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানান সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা। বুধবার বিভাগের ৬ষ্ঠ সেমিস্টারের শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার হলে পরীক্ষা স্থগিতের জন্য আন্দোলন করে। এরমধ্যে প্রতিবাদ স্বরূপ মোট ১৬ জন সাদা খাতা জমা দিয়ে পরীক্ষার হল ত্যাগ করে। বিভাগের ‘মাইগ্রেশন এন্ড ডায়েস্টপোরা’ কোর্সের পরীক্ষা চলাকালীন এই ঘটনা ঘটে বলে একাধিক শিক্ষার্থী বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। বিভাগের শিক্ষার্থী সুপ্তি দাস চৈতি বলেন, যখন ধর্ষককে গ্রেফতার করতে পারেনি তখন আমরা এই প্রতিবাদস্বরুপ ১৬জন শিক্ষার্থী সাদা খাতা জমা দেই। আমরা যেহেতু পরীক্ষায় অংশ নিয়েছি সেখানে আগামীতে ইম্প্রুভমেন্ট দিতে পারব।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন