ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনে বইছে নির্বাচনী হাওয়া। আগামী ৩০ জানুয়ারি এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। দুই সিটিতে নির্বাচনের করণে নগরীর বিভিন্ন সেবা কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে। পদত্যাগ করে উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম নির্বাচনে অংশ নেয়ায় সেখানে দাপ্তরিক কাজ পরিচালনা কারছেন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল হাই। মেয়র না থাকায় উত্তর সিটির দৈনন্দিন কার্যক্রম অনেকটাই ঝিমিয়ে পড়েছে। আর দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে দক্ষিণ সিটির মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন স্বপদে বহাল রয়েছেন। তবে দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে তিনিও অনেকটা বিমর্ষ ও হতাশ। এখানেও প্রতিদিনের সেবা প্রার্থীদের কার্যক্রমে নেমে এসেছে চরম স্থবিরতা। দুই সিটির দুই রকম সমস্যার কারণে দৈনন্দিন বিভিন্ন সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন নগরবাসী।
বিশেষ করে রাজধানীর যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা, মশার উপদ্রব, ফুটপাথ দখল, উচ্ছেদ কার্যক্রমে স্থবিরতা, রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, ড্রেন অপরিষ্কার, ভাঙাচোরা রাস্তাঘাট, ম্যানহোলের ঢাকনা খোলা, উন্নয়ন কাজে ধীরগতি, সেবা খাতগুলোতে প্রয়োজনীয় লোকবলের অভাবে সেবা পেতে হয়রানিসহ বিভিন্ন সমস্যায় এখন দুই সিটিই জর্জরিত। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কপোরেশনে এখন শুধু রুটিন কাজ চলছে। এতে থমকে আছে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ। উত্তরে মেয়র না থাকার কারণে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাজের মধ্যেও দেখা দিয়েছে ঢিলেমি। আর দক্ষিণে মেয়রের মৌনতায় সঠিক তদারকির অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। এতে সব কাজেই মন্থরতা দেখা দিয়েছে।
এ মুহূর্তে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের প্রধান সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে মশার উপদ্রব, যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা, ফুটপাথ দখল ও ধীর গতির উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা। নির্বাচনের কার্যক্রম শুরুর আগে সংস্থা দুটি অনেকটা ঢাকঢোল পিটিয়ে মশক নিধন কার্যক্রম চালালেও দিন যত গড়িয়েছে স্তিমিত হয়েছে এ উদ্যোগ। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মশার উপদ্রব। দুই সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে বার বার ফুটপাথ থেকে অবৈধ দখলদারদেরকে উচ্ছেদ করা হলেও বর্তমানে আবারও দখল হয়ে গেছে রাজধানীর ফুটপাথগুলো। ফুটপাথের অবৈধ হকার উচ্ছেদের নিয়মিত অভিযানও এখন ধরে বন্ধ । যে সুযোগে রাজধানীর সবকটি ফুটপাথই চলে গেছে হকারদের অবৈধ দখলে। এছাড়া দুই সিটি কর্পোরেশেনের যত্রতত্র ছড়িয়ে আছে ময়লা-আবর্জনা। সঠিক তদারকির অভাবে পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার কাজেও নেমে এসেছে স্থবিরতা। রাজধানীতে পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার কাজ পরিচালনার ক্ষেত্রে কিছু নিয়ম নীতি থাকলেও বর্তমানে মানা হচ্ছে না সেই নিয়মগুলো। রাত ১২টার পর থেকে ভোর ৬টার মধ্যে পরিচ্ছন্ন কর্মীরা তাদের কাজ পরিচালনা করবেন। আর ওই সময়ের মধ্যেই ময়লাগুলো ট্রাকের মাধ্যমে শহরের বাইরে নিয়ে যাওয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় এর বিপরিত দৃশ্যই দেখা গেছে। দিনের বেলাতেই রাজপথে দুর্গন্ধ ছড়াতে ছড়াতে ময়লা-আবর্জনা ভর্তি ট্রাক ছুটে চলে। এসব দেখার এখন কেউ নেই।
এছাড়ও রাজধানীর প্রতিটি সড়কই খোঁড়াখুঁড়ির কবলে পড়ে এখন বেহাল হয়ে আছে। গত দেড় থেকে দুই বছর ধরে এই সড়কগুলোতে উন্নয়ন কাজ চললেও এর শেষ হবে কবে, সেই তথ্য কারো জানা নেই। বিশেষ করে রাজধানীর প্রাণ কেন্দ্র মতিঝিলের পাশে দিলকুশার মুল সড়কটি অনেকদিন ধরে অচল হয়ে আছে। এই সড়কটির উপর দিয়ে চলা উন্নয়ন কাজ শেষ হয়েছে প্রায় ৭/৮ মাস আগে। শুধু কার্পেটিংয়ের কাজ বাকি রয়েছে। সামান্য এই কাজটুকুর অভাবে এ সড়কটি দিয়ে চলাচলকারী কয়েক লাখ মানুষকে প্রতিদিন সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। অন্যদিকে মতিঝিল শাপলা চত্বর থেকে ফকিরাপুলের দিকের সড়কের দুই পাশের রাস্তা কেটে রাখা হয়েছে গত ৬ মাস ধরে। গত দুই মাস আগে স্যুয়ারেজের পাইপগুলো মটি চাপা দিয়ে রাখা হলে রাস্তাটির কার্পেটিংয়ের কাজ এখনো শুরু হয়নি। যে কারণে প্রতিদিন এই সড়কটিতে দীর্ঘ যাটজট লেগেই থাকছে।
এই সড়ক দিয়ে মতিঝিলের অফিসে যাতায়াত করেন একটি বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা জামাল উদ্দিন। তিনি বলেন, সেবা দানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য রাস্তা কাটতেই পারেন। এটা উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনার স্বার্থে করতে দিতে হবে। তবে এ কাজ মাসের পর মাস চলতে পারে না। তিনি বলেন, গত এক বছরেরও বেশি সময়ধরে এই সড়কটি দুই পাশদিয়েই সরু করে রেখেছে। এই অচলাবস্থার থেকে আমরা মুক্তি চাই। ঢাকার দুই সিটিতে নির্বাচনের এই সময়ে গত কয়েকদিন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা সরেজমিনে ঘুরে দুই সিটি কর্পোরেশনের সেবা কার্যক্রমের এই চিত্র দেখা গেছে।
এদিকে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় বর্তমানে ময়লা-আবর্জনার অবস্থা অত্যন্ত নাজুক দেখা গেছে। যত্রতত্র ময়লায় ভাগাড় চোখে পড়েছে। রাস্তাঘাট, অলিগলি, আবাসিক, বাণিজ্যিক এলাকা সর্বত্রই ময়লা-আবর্জনার ছড়াছড়ি। কোথাও কোথাও ড্রেন-নর্দমার নোংরা তরল ময়লা-পানি ঢুকে পড়ছে বাড়িঘরেও। চারদিকের উৎকট গন্ধে বাতাস ভারি হয়ে থাকছে। প্রতিটি বাড়ির ফাঁকে, খোলা জায়গায়, গলিপথে ময়লা-আবর্জনার স্তূপ। যে কারণে নগরবাসীকে নাকে মুখে রুমাল চেপে চলাফেরা করতে হয়। নানা ধরনের ময়লা-আবর্জনার উৎকট গন্ধ নাগরিক জীবনকে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ফেললেও এর বিন্দুমাত্রও টের পান না নগর কর্তারা।
রাজধানীতে প্রতিদিন গড়ে প্রায় পাঁচ হাজার মেট্রিক টন বর্জ্য উৎপন্ন হচ্ছে বলে জানিয়েছে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ। তারা জানান, ঘনবসতির এ শহরে বিপুল পরিমাণ বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় হিমশিম খাচ্ছে দুই কর্পোরেশনই। অভিযোগের পর অভিযোগ, বর্জ্য অপসারনে কর্পোরেশনের উল্লেখযোগ্য কোনো সাফল্য দেখেছেন না সেবাগ্রহণকারী নগরবাসী।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের অতিরিক্ত প্রধান বর্জ্য কর্মকর্তা খন্দকার মিল্লাতুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, ঢাকা দক্ষিণ সিটির কোথায়ও এখন আগের মত আর ময়লা আবর্জনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে না। আমাদের পরিচ্ছন্নকর্মীদের নির্দেশ দেয়া আছে, তারা যেন সকাল ৬টার মধ্যেই রাস্তা-ঘাট ও জনসমাগমের স্থানের ময়লার ডাস্টবিন থেকে ময়লা অপসারন করে নেয়। রাতের মধ্যেই যেন ট্রাকে করে এই ময়লা ঢাকার বাইরে নির্ধারিত স্থানে নিরাপদে নিয়ে ফেলতে পারে। তিনি বলেন, এর ব্যতিক্রম যেন না ঘটে সে জন্য পরিচ্ছন্নকর্মীদেরকে কাজে যথা সময়ে হাজির করতে আমরা নানা কার্যকর পদক্ষেণ গ্রহণ করেছি। ডিএসসিসিতে এখন ময়লা আবর্জনা নিয়ে আর কোন সমস্যা আছে বলে আমার মনে হয় না।
সরেজমিন দুই সিটির বিভিন্ন রাস্তা ঘুরে দেখা গেছে, যেখানে-সেখানে অপরিকল্পিতভাবে স্থাপিত ডাস্টবিনের ছড়াছড়ি। রাজধানীর গুলিস্তান থেকে তাঁতীবাজার যেতে নাজিরাবাজার মোড়ে ওভারব্রিজের নিচে রাখা হয়েছে বড় বড় কয়েকটি ময়লার কনটেইনার। এসব কনটেইনার উপচে পড়ছে ময়লা-আবর্জনা। ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ। এতে ফুট ওভারব্রিজটি হয়ে পড়েছে কার্যত পরিত্যক্ত। ভিকারুননিসা নূন স্কুলের শিক্ষার্থী সাবরিনা বলেন, রাস্তায় ময়লার কন্টেইনার রাখার কারণে স্কুল ছুটির সময় প্রায়ই যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। আর দুর্গন্ধ তো আছেই। দ্রæত এসব সরানোর দাবি অভিভাবদের।
জানা গেছে, ঢাকা মহানগরীতে ভ্রাম্যমাণ মানুষের দ্বারা সৃষ্ট বর্জ্য যত্রতত্র ফেলা থেকে বিরত রাখার লক্ষ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটির আওতাধীন এলাকায় প্রতিটি ওয়ার্ডে ১০০টি করে মোট ৫ হাজার ৭০০টি ওয়েস্ট বিন স্থাপন করা হয়েছি। যদিও সেই ওয়েস্ট বিনগুলো এখন অস্তিত্বহীন। গৃহস্থালী বর্জ্য সংগ্রহে প্রাইমারি কালেকশন সার্ভিস প্রোভাইডার (পিএসপি) হিসেবে এনজিও, সিবিও কাজ হয়েছে। এর মাধ্যমে ৬০০ ভ্যানগাড়ি এবং ৩ হাজার জন পরিচ্ছন্নতাকর্মী নিয়োজিত রয়েছে। সূত্র জানায়, দক্ষিণ সিটিতে প্রতিদিন প্রায় ৭৫০ ট্রিপের মাধ্যমে প্রায় ২ হাজার ৬০০ থেকে ৩ হাজার টন বর্জ্য মাতুইল স্যানেটারি ল্যান্ডফিলে চ‚ড়ান্ত অপসারণ করা হয়।
মগবাজার এলাকার বাসিন্দা আবদুল কাদের বলেন, ইস্কাটন এলাকায় রাস্তার ওপর ময়লার কন্টেইনার রাখা হয়েছে। এখানে একটি বিশাল শপিংমলের সামনে ময়লার কন্টেইনার রাখায় মানুষের যাতায়াতে বাধা সৃষ্টি করা হয়েছে। পাশাপাশি মগবাজার ফ্লাইওভার থেকে মিনিবাসগুলো নামার সময় যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। এসবের জন্য ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) খামখেয়ালিপনা দায়ী। এ সমস্যা দ্রæত সমাধানের জন্য ডিএনসিসির হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি। মগবাজারের স্থায়ী বাসিন্দা শহীন আলম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এখন তো মেয়র হতে ভোট লাগে না। এ কারণে যেনতেনভাবে ময়লা রাখা হচ্ছে।
এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা মোহাম্মদ মঞ্জুর হোসেন বলেন, সিটি কর্পোরেশন নান্দনিক করার জন্য সব সময় সচেষ্ট। তবে কিছু সমস্যার কারণে রাস্তার ওপর ময়লার কন্টেইনার রাখতে হচ্ছে। মগবাজার এলাকায় জায়গার অভাবে ময়লা ফেলার স্টেশন স্থাপন করা যাচ্ছে না। জায়গা পেলেই সমস্যার দ্রæত সমাধান হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন