রেজাউর রহমান সোহাগ : “বিনা মেঘে বজ্রপাত” এই প্রবাদটির সাথে আমরা সবাই অত্যন্ত পরিচিত। কিন্তু বিনা মেঘে বজ্রপাতের চেয়েও যে বড় ঘটনা পৃথিবীতে ঘটতে পারে তার এক জ্বলন্ত প্রমাণ দেখলেন সারা পৃথিবীর মানুষ গত ২৭ জুন ফুটবলের বিস্ময়কর প্রতিভা বর্তমানে বিশ্বের সেরা ফুটবলার আর্জেন্টিনার লিওনেল মেসির অপ্রত্যাশিতভাবে আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে অবসর গ্রহণের সিদ্ধান্তে। মেসির এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারছেন না মেসিভক্তরা কেউই। এমনকি ফুটবলে মেসি ও তার দল আর্জেন্টিনার সবচেয়ে শক্ত ও প্রবল প্রতিপক্ষ ব্রাজিলের সমর্থকরাও মেসির এই অকালে অবসর গ্রহণের সিদ্ধান্তে হতবাক ও হতাশ। শত্রুপক্ষও যখন এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারছে না তখন সারা পৃথিবীর শত শত কোটি মেসি ও আর্জেন্টিনা ভক্তদের মনের অবস্থা কী হতে পারে তা বেশ সহজেই অনুমেয়। এমনিতেই কোপা আমেরিকার ফাইনালে চিলির কাছে পরাজয়ের পর শোকে আর হতাশায় একেবারে ভেঙে পড়েছিলেন আর্জেন্টিনার সমর্থকরা। এমন একটি বিপর্যস্ত অবস্থায় যখন মেসি তার অবসরের ঘোষণা দেন তখন অধিক শোকে রীতিমতো পাথর বনে গেছেন মেসি ভক্তরা। বিশ্বকাপের ফাইনালে আর কোপা আমেরিকার ফাইনালে আর্জেন্টিনার পরাজয় মেনে নেওয়ার শোক সইতে পারলেও আর্জেন্টিনার সমর্থকদের জন্য মেসির বিদায়ের সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া নিঃসন্দেহে এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ। আর্জেন্টিনা ফুটবল খেলবে বিশ্বকাপ খেলবে আর সেই দলে মেসি থাকবে না এটা কল্পনাও করতে পারেন না মেসি ভক্তরা এবং এটাই বাস্তবতা। নিঃসন্দেহে এই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে মেসির অবসর গ্রহণের খবরটিই হচ্ছে সারা বিশ্বের প্রধান আলোচিত বিষয়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ইংল্যান্ডের বের হয়ে আসার আলোচিত খবর মুহূর্তেই হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে মেসির এই অবসরের ঘোষণার খবরের পরপরই। ইতোমধ্যে সারা পৃথিবীতে জোরালো দাবি উত্থাপিত হওয়া শুরু হয়েছে মেসির এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের জন্য। হঠাৎ মেসি কেন এমন কঠিন একটি সিদ্ধান্ত নিলেন তারও পর্যালোচনা করছেন ফুটবল বিশেষজ্ঞরা। তবে এই পর্যালোচনায় সকলেই একটি বিষয়ে একমত হয়েছেন যে, হঠাৎ মেসির এই অবসরে যাওয়ার মূল কারণ হচ্ছে আর্জেন্টিনার হয়ে তার ধারাবাহিক ব্যর্থতার গ্লানি আর হতাশা। মেসি যত বড় খেলোয়াড়ই হন না কেন তিনি বেশ ভালোভাবেই একটি বিষয় গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছেন যে, পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় ফুটবল দল আর্জেন্টিনার ফুটবলের মূল চরিত্র আর চাওয়া-পাওয়াই হচ্ছে বিশ্বকাপ জেতা। ম্যারাডোনা আর্জেন্টিনার মানুষের কাছে দেবতার তুল্য কারণ তিনি আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ জয় করে দিয়েছেন একাই। আর মেসি প্রায় এক যুগ ধারাবাহিকভাবে আর্জেন্টিনার হয়ে খেললেও তিনি আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ জেতাতে পারেননি। এই মাপকাঠিতে আর্জেন্টিনার জনগণের কাছে মেসির অবস্থান একজন ব্যর্থ তারকা হিসেবেই। এ ক্ষেত্রে আর্জেন্টিনার জনগণের মনে সবচেয়ে বড় হতাশা হচ্ছে তারা আজ পর্যন্ত ম্যারাডোনার সাথে মেসিকে তুলনা করার মতো কোনো উপাদান মেসির কাছ থেকে পাননি, যা মেসির ফুটবল ক্যারিয়ারের জন্য এক নির্মম বাস্তবতা। মেসি ৩টি বিশ্বকাপসহ ৭৩টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলে ৫৫ গোল করে যতই আর্জেন্টিনার হয়ে সর্বোচ্চ গোলদাতা হোক, যতই জাদুকরী নৈপুণ্য দেখিয়ে বার্সেলোনাকে একের পর এক শিরোপা জয় করে দেক, আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ ও কোপা আমেরিকার ফাইনালে এনে দেক না কেন, এসবের তেমন কোনো গুরুত্ব ও মূল্য আর্জেন্টিনার জনগণের কাছে নেই। এই বাস্তবতা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পেরেছেন মেসি নিজেও। গত বিশ্বকাপের ফাইনালে ওঠার পর সারা পৃথিবীর মতো মেসির দল আর্জেন্টিনার জনগণও প্রত্যাশা করেছিলেন হয়তোবা মেসি তার সাফল্যের নজির স্থাপন করবেন দীর্ঘ ২৮ বছর পর পুনরায় আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ জিতিয়ে। কিন্তু ফাইনালে জার্মানির কাছে পরাজয়ের পর মেসির ওপর বিশাল ব্যর্থতার চাপ সৃষ্টি হয় আর্জেন্টিনার জনগণের তরফ থেকে, যা ছিল খুবই স্বাভাবিক। আর্জেন্টিনার সমর্থকদের মনে একটি ধারণা বেশ বদ্দমূল হয়ে যায় যে, ম্যারাডোনা যেটা পেরেছেন মেসিকে দিয়ে সেটা সম্ভব নয়। এমন একটি পরিস্থিতিতে এবারের কোপা আমেরিকার ফাইনালে ওঠার পর অতীতের সব ব্যর্থতা এবং আর্জেন্টিনার সমর্থকদের মনে তৈরি হওয়া নেতিবাচক ধারণাটিকে মিথ্যা প্রমাণ করার একটি সুবর্ণ সুযোগ পেয়েছিলেন মেসি। কিন্তু কোপা আমেরিকার ফাইনালেও চিলির কাছে আর্জেন্টিনা হেরে যাওয়ার পর এই ধারাবাহিক ব্যর্থতার দায়ভার নিজের কাঁধে নেয়া ছাড়া মেসির সামনে দ্বিতীয় আর কোনো পথ খোলা ছিল না। খেলা শেষে মেসির বিষণœ চেহারার অভিব্যক্তিতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল, দলের এই ব্যর্থতায় তিনি যে কতটা বিপর্যস্ত, বিষণœ, ক্ষুব্ধ, হতাশ, লজ্জিত ও অনুতপ্ত। যে কারণেই তার হঠাৎ করে এই অবসর গ্রহণের সিদ্ধান্তের ঘোষণাটি। তবে এ সিদ্ধান্তে হতবাক ও ব্যথিত সারা পৃথিবীর কোটি কোটি মেসি ভক্ত। সবারই প্রত্যাশা মেসি তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে যত দ্রুত সম্ভব আন্তর্জাতিক ফুটবলে ফিরে আসুক। ২৯ বছর বয়সী মেসির যে বর্তমান ফিটনেস ও পারফরমেন্স তাতে নির্দ্বিধায় বলা যায়, তিনি আরও দুটি বিশ্বকাপ খেলার যোগ্যতা রাখেন অনায়াসে। এমনিতেই বর্তমানে বিশ্ব ফুটবলে মারাত্মক সংকট রয়েছে তারকা খেলোয়াড়ের। আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, জার্মানি, স্পেন, ইতালি, হল্যান্ড, পর্তুগালের মতো বিশ্বের সেরা দলগুলোতে এখন আর নেই আগের মতো একাধিক তারকা খেলোয়াড়ের সমারোহ। তারকা ফুটবলারদের এমন একটি সংকটময় মুহূর্তে যদি পৃথিবীর সেরা খেলোয়াড় মেসি তার অবসর নেওয়ার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন তাহলে সেটা মারাত্মক প্রভাব ফেলবে বিশ্ব ফুটবলে। বিশেষ করে আগামী বিশ্বকাপ এতে আকর্ষণ হারিয়ে ফেলবে অনেকটাই। তাই ফুটবলবোদ্ধারা মনে করেন শুধু আর্জেন্টিনার স্বার্থে নয়, বিশ্ব ফুটবলের বৃহত্তর স্বার্থেই মেসি তার এই অবসর গ্রহণের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে দ্রুত আবারও আর্জেন্টিনার ফুটবলে ফিরে আসবেন। বাংলাদেশের ফুটবলের কিংবদন্তি, দেশের সর্বকালের সেরা ফুটবলার কাজী সালাউদ্দীনকে এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে বলা হলে তিনি ইনকিলাবকে বলেন, “মেসির এই অবসরের সিদ্ধান্তটি অনেকটাই ইমোশনাল। আমি মনে করি মেসির অবশ্যই নেক্সট ওয়ার্ল্ড কাপ পর্যন্ত খেলা উচিত। তবে যেহেতু ম্যারাডোনা মেসিকে সিদ্ধান্ত বদলাতে অনুরোধ করেছেন তাই এই অনুরোধ ফিরিয়ে দেয়া মেসির জন্য খুবই ডিফিকাল্ট। আর আর্জেন্টিনার জনগণ এখন কিছুটা চুপ থাকলেও কিছু দিন পর তারাও মেসিকে সিদ্ধান্ত বদলাতে অনুরোধ করবে।” এ ব্যাপারে মেসিভক্তরা অবশ্য এখন আশাবাদী হতেই পারেন পরবর্তী একটি ঘটনায়। বিশ্বের সর্বকালের সেরা ফুটবলার ও ফুটবলের প্রকৃত জাদুকর ডিয়েগো ম্যারাডোনা হচ্ছেন মেসির আদর্শ, অনুপ্রেরণা, অভিভাবক সবকিছু। মেসি নিজেও গর্ববোধ করেন এই ভেবে যে, তিনি ম্যারাডোনার দেশের মানুষ এবং ম্যারাডোনার দলের খেলোয়াড়। শুধু মেসি কেন, পৃথিবীর যে কোনো ফুটবলারই জানেন এবং বোঝেন ফুটবল মানেই ম্যারাডোনা, ম্যারাডোনা মানেই আর্জেন্টিনা আর ম্যারাডোনা এককভাবে নিজেই একটা পৃথিবী। এত বড় ফুটবলার হওয়ার পরেও মেসি ম্যারাডোনার মতো গ্রেট ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন দেখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেননি কখনোই। মেসির একটি বিরাট উপলব্ধি হচ্ছে, তিনি এতদিন বিশ্ব ফুটবলকে দাপিয়ে বেড়িয়ে একটি বিষয় নিশ্চিত পরিষ্কার বুঝতে পেরেছেন যে, ফুটবলে ম্যারাডোনাদের জন্ম একবারই হয় এবং অনেকেই নৈপুণ্য দেখিয়ে অনেক বড় ফুটবলার হতে পারেন কিন্তু কারো পক্ষেই ম্যারাডোনা হওয়া কখনোই সম্ভব নয়। সেই ফুটবল জাদুকর ম্যারাডোনাই মেসিকে অনুরোধ করেছেন তার অবসরের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে দ্রুত আবার আর্জেন্টিনা ফুটবল দলে ফিরে আসতে। নিঃসন্দেহে ম্যারাডোনার এই অনুরোধ মেসির জন্য এত বিশাল ওজনের এক চাপ, যে চাপ সহ্য করার ক্ষমতা মেসির নেই। ম্যারাডোনা মেসির কাছে এতটাই পূজনীয় যে, ভাষাগত প্রয়োগে মেসির প্রতি এটা ম্যারাডোনার অনুরোধ হলেও বাস্তবিকতায় এই অনুরোধ মেসির কাছে নির্দেশের চেয়েও অনেক বড় কিছু। তাই হতভম্ব ও আশাহত পৃথিবীর কোটি কোটি মেসিভক্ত এখন আশা করতেই পারেন এবং ম্যারাডোনার এই অনুরোধের পর অনেকটা নিশ্চিত করেই বলা যায়, মেসি তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে দ্রুতই আবার ফিরবেন আর্জেন্টিনা দলে। কারণ সারা পৃথিবীর মতো মেসি নিজেও জানেন ফুটবলে সারা পৃথিবীর ওজনের চেয়েও একা ম্যারাডোনার ওজনের পাল্লা অনেক ভারী এবং ম্যারাডোনার যে কোনো অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করা মেসির জন্য পৃথিবীর সব থেকে কঠিন কাজ। তাই ধন্যবাদ ম্যারাডোনাকে। বাস্তবতা হচ্ছে ফুটবলে ফলাফলের দিক থেকে আর্জেন্টিনার ধারাবাহিক এত ব্যর্থতার পরেও হতাশাগ্রস্ত আর্জেন্টিনার সমর্থকরা হতাশা কাটিয়ে আবারও আগামী বিশ্বকাপ জেতার স্বপ্ন মনেপ্রাণে লালন করে আছেন শুধুমাত্র মেসির নৈপুণ্যের ওপর আশা করেই।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন