শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

ফুটপাতে চাঁদা এখন দ্বিগুণ

বন্ধে পুলিশের কার্যকর পদক্ষেপ নেই

প্রকাশের সময় : ১ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম

নূরুল ইসলাম : ঈদকে সামনে রেখে রাজধানীর ফুটপাতের চাঁদার হার দ্বিগুণ করা হয়েছে। সাথে বকশিস নেয়া হচ্ছে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা। জুরাইন, গুলিস্তান, ফার্মগেইট, নিউমার্কেট, মহাখালী, মোহাম্মদপুর, মিরপুর এলাকার হকারদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ফুটপাতে চাঁদাবাজি বন্ধে পুলিশের কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই। বরং ডিএমপি কমিশনারের নির্দেশে গুলিস্তান রাস্তার উপর থেকে হকার উচ্ছেদ করার পর লাইনম্যান নামধারী চাঁদাবাজদেরকেই ফুটপাত দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়েছে পুলিশ। ভুক্তভোগি হকাররা জানান, ঈদ সমাগত বলে দ্বিগুণ চাঁদা আর বকশিস দিয়েই তাদের ব্যবসা করতে হচ্ছে।
রাজধানীর ফুটপাতগুলো হকাররা দখল করে ব্যবসা করলেও এর নেপথ্যে সরকারদলীয় প্রভাবশালী নেতা ও পুলিশ। হকাররা জানান, চাঁদা তোলার জন্য পুলিশই ‘লাইনম্যান’ নিয়োগ করে। লাইনম্যানরা চাঁদা তুলে দখলদার নেতা ও পুলিশকে বুঝিয়ে দেয়। এভাবেই চলে আসছে বছরের পর বছর। সরকার পরিবর্তন হলে নেতা বদলায়। বাকী সবই ঠিক থাকে। প্রতিবছরের মতো এবারও পুলিশ সদর দপ্তরে ‘ঈদ পূর্ববর্তী’ বৈঠকে ঈদকে সামনে রেখে সব ধরনের চাঁদাবাজি বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেন আইজিপি একেএম শহীদুল হক। হকারদের অভিযোগ পুলিশ ফুটপাতে চাঁদাবাজি বন্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। বরং পুলিশকে ম্যানেজ করেই চাঁদাবাজরা ঈদকে সামনে রেখে ফুটপাতের চাঁদা দ্বিগুণ করেছে। গুলিস্তান এলাকার হকারদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, রমজানের শুরুতে ডিএমপি কমিশনারের নির্দেশে গুলিস্তানের রাস্তা থেকে হকারদের উচ্ছেদ করা হয়। হকাররা যাতে রাস্তায় আর না বসতে পারে এজন্য লাইনম্যান নামধারী চাঁদাবাজদেরকে দায়িত্ব দেয় গুলিস্তান সার্জেন্ট আহাদ বক্সের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা। লাইনম্যানরা এই ক্ষমতা কাজে লাগিয়েই চাঁদার অংক দ্বিগুণ করেছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, আগে যেসব দোকান থেকে দিনে দেড়শ’ টাকা করে চাঁদা নেয়া হতো, এখন তা তিনশ’ টাকা হয়েছে। দুশ’ টাকার চাঁদা হয়েছে ৫শ’ টাকা। এভাবে প্রতিদিন কয়েক লাখ টাকা চাঁদা তুলছে লাইনম্যান নামধারী চিহ্নিত চাঁদাবাজরা। এই চাঁদার বড় অংশ যায় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা, মতিঝিল থানা ও সার্জেন্ট আহাদ পুলিশ বক্সের কর্মকর্তাদের পকেটে। অথচ যারা সরাসরি এই চাঁদা তোলে তারা সব সময় থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। জানা গেছে, গুলিস্তান সুন্দরবন স্কোয়ারের উত্তর পাশের ফুটপাত থেকে চাঁদা তোলে মোটা জজ, বাবুল, আমীর হোসেন, ভোলা ও কানা সিরাজ। গুলিস্তানের সবচেয়ে ব্যস্ততম এলাকা বলে এখানকার দর একটু বেশি। হকাররা জানান, এখানে ফুটপাতের দোকানগুলোর চাঁদা আগে ছিল দেড়শ’ টাকা। এখন হয়েছে তিনশ’। বঙ্গভবনের পার্কের সামনে সার্জেন্ট আহাদ পুলিশ বক্সের সাথে ফুটপাতের দোকান থেকে চাঁদা তোলে লম্বা হারুন ও তার শ্যালক দেলোয়ার। গুলিস্তান ট্রেড সেন্টারের (গুলিস্তান সিনেমা হল) পূর্ব পাশের ফুটপাত ও রাস্তার দোকান থেকে চাঁদা তোলে সরদার বাবুল। এই বাবুল এক সময় পুরো গুলিস্তান ও মতিঝিল এলাকার লাইনম্যানদের সর্দার হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিল। কোন রাস্তায় বা ফুটপাতে দোকান বসবে তা বাবুলই পুলিশের সাথে সমঝোতা করে নির্ধারণ করে দেয় বলে হকাররা জানান। গুলিস্তান হলের (এখন নেই)  উত্তর পাশের ফুটপাত থেকে চাঁদা তোলে খোরশেদ ও হাসান। রাজধানী হোটেলের সামনের ফুটপাত ও রাস্তার দোকান থেকে চাঁদা তোলে হিন্দু বাবুল ও রব। জাতীয় গ্রন্থ ভবনের সামনের রাস্তা ও ফুটপাতের দোকান থেকে চাঁদা তোলে সুলতান ও লিপু। রমনা ভবনের পশ্চিম পার্শ্বের রাস্তা ও ফুটপাতের দোকান থেকে চাঁদা তোলে মনির ও তরিক আলী। পূর্ণিমা স্নাকসের সামনের রাস্তা ও ফুটপাতের দোকান থেকে চাঁদা তোলে আখতার ও জাহাঙ্গীর। বেলতলা বেল্টের গলির রাস্তা ও ফুটপাত থেকে চাঁদা তোলে কালা নবী, বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের সোনালী ব্যাংকের সামনের রাস্তা ও ফুটপাতের দোকান থেকে চাঁদা তোলে সাবেক সর্দার ছালাম। জিপিও’র দক্ষিণের রাস্তার দোকান থেকে চাঁদা তোলে শহীদ ও দাড়িওয়ালা সালাম। মাওলানা ভাসানী স্টেডিয়ামের সামনের ফুটপাত থেকে চাঁদা তোলে আলী মিয়া। জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটের ফুটপাতের দোকান থেকে চাঁদা তোলে কাদের ও খলিল। বায়তুল মোকাররম মসজিদের পশ্চিম দিকের মিনারের কাছের ফুটপাতের দোকান থেকে চাঁদা তোলে কোটন, জাহাঙ্গীর ও নসু। বায়তুল মোকাররম মসজিদের স্বর্ণের মার্কেটের সামনের রাস্তা ও ফুটপাতের দোকান থেকে চাঁদা তোলে তমিজ উদ্দিন ও বাবুল ভূঁইয়া। জাতীয় মসজিদের উত্তর গেটের ফুটপাত থেকে চাঁদা তোলে সাজু। বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সামনের ফুটপাতের দোকান থেকে চাঁদা তোলে কবির হোসেন, ফুলবাড়ীয়া টিএন্ডটির সামনের ফুটপাত থেকে চাঁদা তোলে ঘাউরা বাবুল, গুলিস্তান ট্রেড সেন্টারের পশ্চিমের রাস্তা ও ফুটপাতের দোকান থেকে চাঁদা তোলে বিমল। হকাররা জানায়, পুলিশের সাথে সরাসরি যোগাযোগ বলে এরা কাউকে ভয়ও করে না। এরা নিজেদেরকে ‘পুলিশ’ মনে করে। সে কারণে কথায় কথায় হকারদেরকে লাঠিপেটা করে, অপমান করে, মালামাল কেড়ে নেয়। দোকান তুলে দেয়ার হুমকি দেয়। বাংলাদেশ হকার্স ফেডারেশনের হিসাব মতে, শুধুমাত্র গুলিস্তান থেকে বায়তুল মোকাররম মসজিদ হয়ে ফুলবাড়ীয়া পর্যন্ত রাস্তা ও ফুটপাতে কমপক্ষে সাড়ে চার হাজার দোকান বসে। এসব দোকান থেকে প্রতিদিন কমপক্ষে ৫ লাখ টাকা চাঁদা তোলে লাইনম্যানরা। যা ঈদকে সামনে রেখে ১০ লাখ টাকা হয়েছে। রমজান মাস শেষে এই টাকার পরিমাণ দাঁড়াবে ৩ কোটি টাকা।
নিউ মার্কেট এলাকার চাঁদাবাজি নিয়ে ডিএমপি কমিশনারের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছিলেন  জয়নাল আবেদীন নামে এক ব্যবসায়ী। ডিএমপি কমিশনার এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিলে রমনা জোনের ডিসি হয়ে তা আসে সংশ্লিষ্ট জোনের এসির কাছে। এসি তদন্তের নির্দেশ দেন ওসিকে। ওসি তদন্ত না করে লাইনম্যানদেরকে ডিসির সাথে সাক্ষাৎ করতে পাঠান। দু’দিন আগে লাইনম্যানরা রমনা জোনের এডিসির সাথে সাক্ষাৎ করে নিজেদেরকে ‘নিরপরাধ’ বলে দাবি করে। তদন্ত ওই পর্যন্তই। হকাররা জানান, এডিসির সাথে সব লাইনম্যান সাক্ষাৎ করতে যায়নি। যারা গিয়েছে তারা এখন আরও অধিক ‘ক্ষমতাধর’ হয়ে চাঁদাবাজি করছে। এরাই ঈদ বকশিসের নামে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা করে আদায় করছে।
জুরাইন আলম মার্কেটের সামনে সড়ক ও জনপদের জায়গা থেকে হকারদের উচ্ছেদের প্রক্রিয়া শুরু হয় দুই মাস আগে। হকাররা জানায়, বেশ কয়েকটি দোকান উচ্ছেদের পর এমপি সানজিদার অনুরোধে ঈদ উপলক্ষে সেই উচ্ছেদ বন্ধ রাখা হয়। এই সুযোগে খায়রুল, মোশাররফসহ স্থানীয় চিহ্নিত কিছু চাঁদাবাজ উচ্ছেদকৃত জায়গায় আবার নতুন করে দোকান বসায়। বিনিময়ে হকারদের কাছে থেকে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা করে নেয় তারা। এভাবে কয়েক লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়ার সময় খায়রুলকে ধরে জনতা ‘গণধোলাই’ দেয়। হকাররা জানায়, গণধোলাইয়ের পর খায়রুল কিছুদিন নিষ্ক্রিয় থাকলেও ঈদকে সামনে রেখে তারা আবার তৎপর হয়েছে। এখন সমানে চলছে চাঁদাবাজি। জুরাইন বাজার নিয়েও চাঁদাবাজির অভিযোগ করেছেন সাধারণ ব্যবসায়ীরা। তারা জানান, জুরাইন বাজারের চাঁদাবাজির নেপথ্যে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী জড়িত। রাজধানীর মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটের কাঁচাবাজারে রাস্তা দখল করে বসানো হয়েছে ঈদের বাজার। অভিযোগ রয়েছে কাঁচা বাজার মার্কেট কমিটির নেতারা মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে রাস্তা দখল করে দোকান বসানোর সুযোগ করে দিয়েছেন। একই সাথে প্রতিটি দোকান থেকে প্রতিদিনই চাঁদা তোলা হচ্ছে।
একইভাবে ফার্মগেইট, মিরপুর, মহাখালী এলাকার ফুটপাতগুলো থেকে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকার চাঁদাবাজি হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ হকার্স ফেডারেশন ও হকার্স লীগের সভাপতি এমএ কাশেম বলেন, আমরা বহুদিন ধরেই ফুটপাতের চিহ্নিত চাঁদাবাজদেরকে গ্রেফতারের দাবি জানিয়ে আসছি। কিন্তু তাদেরকে গ্রেফতারে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। ঈদকে সামনে রেখে চাঁদা দ্বিগুণ করা হয়েছে স্বীকার করে তিনি বলেন, পুলিশ ইচ্ছা করলেই একদিনে সবকিছু বন্ধ করে দিতে পারে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন