গাড়ি ভাঙচুর ও বাসভবনের ফটকে ছাত্রলীগের তালা : রাতে আন্দোলন স্থগিত
স্টাফ রিপোর্টার : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে প্রকাশিত স্মরণিকায় মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানকে প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে উল্লেখ করার প্রতিবাদে উত্তাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। এ কারণে গতকাল শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের ব্যক্তিগত গাড়ি ভাঙচুর করে এবং তার পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ ও বাসভবনের প্রধান ফটকে তালা দেয় ছাত্রলীগ। একই কারণে ছাত্রলীগের প্রতিবাদের তোপের মুখে বিকালে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার রেজাউর রহমানকে অব্যাহতি দিতে বাধ্য হয়।
এ ধরনের ইতিহাস বিকৃতি এবং ভিসির গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করে তদন্ত করা হবে বলে ভিসি প্রফেসর ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক সাংবাদিকদের জানিয়েছেন। এদিকে শুক্রবার বিকেলে ভিসির বাসভবনের সামনে ছাত্রলীগের অবস্থানকালে ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ সম্পাদক মোতাহার প্রিন্স বলেন, ভিসির প্রত্যক্ষ ইন্ধনে এ ধরনের ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে। তাই এ ঘটনার দায়ে ভিসির পদত্যাগ চায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগ। ভিসি পদত্যাগ না করলে আজ বেলা ১১টা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘটের ডাক দেয়া হবে।
জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯৫তম প্রতিষ্ঠাবর্ষিকী উপলক্ষে শুক্রবার দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি মিলনায়তনে ‘সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ ও মানবিক চেতনা বিকাশে উচ্চশিক্ষা’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রতিষ্ঠাবর্ষিকী উপলক্ষে উপস্থিত সবাইকে একটি করে স্মরণিকা দেয়া হয়। এ স্মরণিকার ১৯নং পৃষ্ঠায় জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি উল্লেখ থাকায় অনুষ্ঠানস্থলে এর কড়া প্রতিবাদ করেন বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য সুভাষ সিংহ রায়। পরে অনুষ্ঠানেই ভিসি প্রফেসর ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক স্মরণিকাটি বাজেয়াপ্ত করার ঘোষণা করেন। একই সঙ্গে তদন্ত কমিটি গঠন করে ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দেন এবং অনুষ্ঠান চালিয়ে যান।
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর ৩৪ পৃষ্ঠার স্মরণিকায় দেখা গেছে, ১৯ নম্বর পৃষ্ঠায় ‘স্মৃতি অম্লান’ শিরোনামে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন আবাসিক হলের বর্ণনা দিতে গিয়ে জিয়াউর রহমান হলের পরিচয়ে বলা হয়, জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট, সাবেক সেনাপ্রধান এবং একজন মুক্তিযোদ্ধা। এটি লেখেন ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার সৈয়দ রেজাউর রহমান। শুধু তাই নয়, এর ১৩ নম্বর পৃষ্ঠায় জগন্নাথ হলের প্রতিষ্ঠার ইতিহাস তুলে ধরতে গিয়ে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যালঘু তথা হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সম্প্রদায় এবং উপজাতি ছাত্রদের থাকার জন্য এই হলটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি আদিত্য নন্দী ও মেহেদী হাসান রনি বিষয়টি দেখতে পান এবং অনুষ্ঠান শেষে দুপুর ১২টা থেকে পৌনে একটা পর্যন্ত আদিত্য নন্দী ও মেহেদী হাসান রনিসহ ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার রেজাউর রহমানকে তার কার্যালয়ে তালাবন্দি করে রাখেন। এ সময় তারা প্রতিবাদে স্মরণিকায় আগুন ধরিয়ে দেন। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর অধ্যাপক ড. এএম আমজাদ ঘটনাস্থলে গিয়ে রেজাউর রহমানকে তালামুক্ত করে বের করে নিয়ে যান।
এরই প্রতিবাদে জুমার নামাজের পর মধুর ক্যান্টিন থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। পরে তারা ভিসির বাসভবনের সামনে তার পদত্যাগ দাবি করে বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন। বিকেল তিনটার দিকে ভিসি তার ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে বাসায় ঢোকার পথে তাদের বিক্ষোভের মুখে পড়েন। একপর্যায়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তার গাড়ির কাচ ভাঙচুর করে। এ সময় ভিসি গাড়ির ভেতরেই ছিলেন। এ সময় ভিসির দেহরক্ষী আগ্নেয়াস্ত্র প্রদর্শন করলে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আরও বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি আবিদ আল হাসান ও সাধারণ সম্পাদক মোতাহার হোসেন নেতাকর্মীদের শান্ত করার চেষ্টা করে বিফল হন। পরবর্তীতে ভিসি গাড়ি নিয়ে বাসভবনে প্রবেশ করেন। এ সময় ভিসির বাসভবনের সামনে ছাত্রলীগ অবস্থান নেয় এবং ভিসি ও রেজিস্ট্রারের পদত্যাগের দাবিতে স্লোগান দিতে থাকে। বেলা চারটার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ঘটনাস্থালে এসে এ ঘটনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার রেজাউর রহমানকে অব্যাহতির বিষয়টি জানান।
এ ঘোষণার পর প্রক্টর ঘটনাস্থল ত্যাগ করলে ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় সভাপতি আবিদ আল হাসান জানান, শুধু রেজিস্ট্রার নয়, এ ঘটনায় জড়িত সবাইকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অব্যাহতি দিতে হবে। এজন্য আমরা আগামী ১৭ জুলাই পর্যন্ত আল্টিমেটাম ঘোষণা দিচ্ছি। এ সময় তিনি আজকের মতো ওই কর্মসূচি মুলতবি ঘোষণা করেন।
এদিকে, বেলা ৫টার দিকে ভিসির বাসভবনে এক সংবাদি সম্মেলনে অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক সাংবাদিকদের বলেন, স্মরণিকায় লেখাটি রেজাউর রহমানের নিজের লেখা। যেহেতু এটা ভারপ্রাপ্ত রেজাউর রহমানের ‘বাইলাইন লেখা’ তাই এর দায়-দায়িত্ব লেখককে বহন করতে হবে। এ কারণে রেজাউর রহমানকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। গাড়ি ভাঙচুরের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে ছিলাম। আমি যখন বাংলোতে প্রবেশ করছিলাম, সেই সময় আমার গাড়িতে হামলা করা হয়েছে। কে বা কারা, কেন করেছে, সেটা তদন্ত করে দেখা হবে। এদিকে সংবাদ সম্মেলন চলাকালে ভিসির বাসভবনের সামনে ফের বিক্ষোভ করেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এ সময় তারা এ ঘটনায় ভিসির পদত্যাগ দাবি করে নানা স্লোগান দিতে থাকেন। বেলা সাড়ে ৫টার পর ছাত্রলীগের নেতারা ভিসির বাসভবনের প্রধান ফটকের তালা ঝুলিয়ে রাখেন। এ সময় ঢাবি শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মোতাহার হোসেন প্রিন্স বলেন, আন্দোলন মুলতবি করে চলে গিয়েছিলাম, কিন্তু পরে জানতে পেরেছি এর সঙ্গে ভিসি নিজেই জড়িত, যার কারণে আমরা আবার এসেছি। তিনি আরো বলেন, আমাদের এখন একটাই দাবিÑভিসির পদত্যাগ। যতক্ষণ ভিসি পদত্যাগ করবেন না, ততক্ষণ আমরা আমরণ অবস্থান নিয়ে কর্মসূচি চালিয়ে যাব। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ভিসির বাসভবনের সামনে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন। এ সময় তারা জুতা প্রদর্শন করা থেকে শুরু করে ব্যঙ্গাত্মক বিভিন্ন স্লোগান দেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন