শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

জিম্মি নাটকের রক্তাক্ত অবসান

বিদেশিসহ নিহত ২৮ : ২০ জনের বেশি আহত

প্রকাশের সময় : ৩ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১:৫৩ এএম, ৩ জুলাই, ২০১৬

বিশেষ সংবাদদাতা
দীর্ঘ ১২ ঘণ্টা শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার পর জিম্মি নাটকের রক্তাক্ত অবসান হয়েছে। শুক্রবার রাতে একদল সন্ত্রাসী গুলশানের হলি আর্টিসান বেকারি রেস্তোরাঁয় ঢুকে অস্ত্রের মুখে সবাইকে জিম্মি করে। বিশ্বব্যাপী তোলপাড় শুরু হয়। চরম উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা নিয়ে সারা বিশ্বের মানুষ তাকিয়ে ছিল গুলশানের দিকে। রাতভর আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর সতকর্তা ও উদ্ধার তৎপরতার পর গতকাল শনিবার ভোরে যৌথবাহিনী ওই রেস্তোরাঁয় কমান্ডো অভিযান চালায়। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) এক সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, হলি আর্টিসান বেকারি রেস্তোরাঁয় সন্ত্রাসী হামলা ও জিম্মির ঘটনায় দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ ২৮ জন নিহত হয়েছে। জিম্মিদের মধ্যে শুক্রবার রাতেই ২০ জন বিদেশিকে হত্যা করা হয়। যৌথ বাহিনীর কমান্ডো অভিযানে তিনজন বিদেশি যাদের মধ্যে একজন জাপানি ও দুজন শ্রীলঙ্কানসহ ১৩ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। অভিযানে সাতজন সন্ত্রাসীর মধ্যে ছয়জন নিহত হয় এবং এক সন্দেহভাজন সন্ত্রাসী গ্রেফতার হয়েছে। তবে এর বাইরেও বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি জিম্মি নিহত হওয়ার দাবি করেছেন তাদের পরিবার। বিদেশিসহ বেশ কয়েকজন নিখোঁজও রয়েছে। সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় ২০জনের বেশি পুলিশ সদস্য আহত হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস এই হামলার দায়িত্ব স্বীকার করেছে বলে সাইট ইন্টিলিজেন্স গ্রুপ জানিয়েছে। তবে এই সংগঠনটির তৎপরতার খবর বাংলাদেশ সরকার নাকচ করে আসছে। আইজিপি শহীদুল হক বলেছেন, যৌথ কমান্ডো অভিযানে নিহত ছয় জঙ্গি সবাই বাংলাদেশি। এর মধ্যে পাঁচজন ছিল পুলিশের তালিকাভুক্ত। বাংলাদেশের ইতিহাসে স্মরণকালের এই ঘটনায় সরকার দুই দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশে দেয়া এক ভাষণে দেশবাসীকে আওয়ামী লীগ সরকারের উপর আস্থা রাখতে বলেছেন।
সেনা সদর দপ্তরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মিলিটারি অপারেশন্সের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাঈম আশফাক চৌধুরী ঘটনা বর্ণনা করে বলেন, গুলশান-২ নম্বরের ৭৯ নম্বর সড়কের হলি আর্টিসান বেকারি নামের একটি রেস্তোরাঁয় দুষ্কৃতকারীরা গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে ভেতরে প্রবেশ করে। রেস্তোরাঁর সবাইকে জিম্মি করে। ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছায় এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। পরবর্তীতে পুলিশ কর্ডন করে সন্ত্রাসীদের যথেচ্ছ কর্মকা- থেকে নির্বৃত্ত করে। তিনি বলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ-র‌্যাব ও বিজিবি যে সাহসিকতা, আন্তরিকতা ও পেশাদারিত্ব প্রদর্শন করেছে, তা অনন্য। আইএসপিআরের সংবাদ সম্মেলনে এই সেনা কর্মকর্তা বলেন, এই অভিযানকালে দু’জন পুলিশ কর্মকর্তা শাহাদত বরণ করেন এবং ২০ জনের বেশি পুলিশ সদস্য আহত হন। উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনীকে সরকার প্রধানের পক্ষ থেকে আদেশ প্রদান করা হয়। সে মোতাবেক বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’ পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয়। সেনাবাহিনী শুক্রবার দিবাগত রাত থেকেই ঘটনাস্থলে অবস্থানরত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা বাহিনীর কাছ থেকে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করে। সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, র‌্যাব, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সম্মিলিতভাবে অপারেশন থান্ডারবোল্ট পরিচালনা করে। সংবাদ সম্মেলনে জানানো  হয়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর  এয়ার কমান্ডোর নেতৃত্বে কমান্ডো অভিযান সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে শুরু হয়। ১২ থেকে ১৩ মিনিটের মধ্যেই সব সন্ত্রাসীকে নির্মূল করে ওই এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরবর্তীতে অপারেশনের অন্যান্য কার্যক্রম সম্পন্ন করে সকাল আটটায় অপারেশনের সব কার্য সম্পন্ন করা হয়। ঘটনাস্থল থেকে প্রাথমিকভাবে সন্ত্রাসীদের ব্যবহৃত পিস্তল, ফোল্ডেট বাঁট একে ২২ রাইফেল, বিস্ফোরিত আইইডি, ওয়াকিটকি সেট ও অনেক ধারালো দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। অভিযানে অংশগ্রহণকারী সদস্যদের কেউ হতাহত হয়নি। সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন সেনাবাহিনীর ৪৬ পদাতিক ডিভিশনের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুজিবুর রহমান, প্যারা কমান্ডার ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. এম এম ইমরুল হাসান এবং র‌্যাব-পুলিশ ও বিজিবিসহ সমন্বিত অভিযানে অংশ নেওয়া বাহিনীর প্রতিনিধিগণ।
সংবাদ সম্মেলনে নাঈম আশফাক বলেন, অভিযানের মাধ্যমে তিনজন বিদেশি যাদের মধ্যে একজন জাপানি ও দুজন শ্রীলঙ্কানসহ ১৩ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। অভিযানে সাতজন সন্ত্রাসীর মধ্যে ছয়জন নিহত হয় এবং এক সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীকে গ্রেফর করা হয়। এ ছাড়া অভিযান শেষে তল্লাশিকালে ২০ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। যাদের সবাইকে গতরাতেই ধারালো অস্ত্র দিয়ে হত্যা করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, প্রচলিত নিয়ম মেনেই সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) মরদেহের ময়নাতদন্ত করা হবে। নিহত বিদেশিদের মধ্যে ৯ জন ইটালী, ৭ জন জাপানী এবং একজন ভারতীয় নাগরিক বলে জানা গেছে।
জিম্মিদের বর্ণনায় দুঃস্বপ্নের রাত্রি
কমান্ডো অভিযানে মুক্ত গুলশানের ক্যাফে থেকে উদ্ধার পাওয়া ব্যক্তিদের ‘দুঃস্বপ্ন’ কাটছে না। শুক্রবার রাতে একদল বন্দুকধারী রাজধানীর কূটনীতিকপাড়ার হলি আর্টিসান বেকারিতে ঢুকে বিদেশিসহ বেশ কয়েকজনকে জিম্মি করে। সকালে কমান্ডো অভিযানে মুক্ত হন তাদের অনেকে। এদের মধ্যে রয়েছেন প্রকৌশলী হাসনাত করিম। ১৩ বছর বয়সী সন্তানের জন্মদিন উদযাপন করতে স্প্যানিশ এই ক্যাফেতে গিয়েছিলেন তিনি। তার সঙ্গে ছিল স্ত্রী শারমিন পারভীন এবং ৮ বছর বয়সী অন্য সন্তান। রাতভর আটক থাকার পর সকাল ৮টার দিকে কমান্ডো অভিযানে হাসনাতের পরিবার উদ্ধার পায় বলে জানান তার মা। সন্তান, পূত্রবধূ ও নাতনীদের জন্য স্বামী এমআর করিমকে সঙ্গে নিয়ে সারারাত গুলশানে ছিলেন তিনি। ছেলেকে পাওয়ার পর হাসনাতের মা সাংবাদিকদের বলেন, ভেতরে সাতজন বাংলাদেশি একজন ভারতীয়ের পাশাপাশি আরও ২০-২২জন বিদেশি ছিল। আক্রমণকারীরা ছিল ৫ জন। হাসনাত ২০ বছর দেশের বাইরে ছিলেন। ইংল্যান্ডে প্রকৌশল বিষয়ে পড়াশোনার পর যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে এমবিএ করেন। দেড় বছর আগে দেশে ফিরে আসেন তিনি। ক্যাফেটিতে থাকা বিদেশি কয়েকজনকে রাতেই হত্যা করা হয় বলে হাসনাত তার মাকে জানান।  
উল্লেখ্য, শুক্রবার রাত পৌনে নয়টার দিকে ২০ থেকে ২৮ বছর বয়সী আট থেকে নয়জন অস্ত্রধারী গুলশানের কূটনৈতিক এলাকার হলি আর্টিসান বেকারি রেস্তোরাঁয় ঢুকে হামলা চালায়। রাত সাড়ে ১০টার দিকে সেখানে বড় ধরনের বিস্ফোরণ ও গোলাগুলির শব্দ পাওয়া যায়। এক পর্যায়ে পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলাম ও বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালাউদ্দিন নিহত এবং ৫০ জনেরও বেশি ব্যক্তি আহত হয়। গতকাল শনিবার সকাল সাড়ে সাতটার দিকে জিম্মিদের উদ্ধারে যৌথ কমান্ডো অভিযান শুরু হয়। বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, সোয়াত সদস্যদের নিয়ে এই কমান্ডো অভিযান চালানো হয়। সকাল সোয়া আটটার দিকে কমান্ডোরা পরিস্থিতি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। এতে তারা সময় নেয় মাত্র ৪৫ মিনিট। বেলা ১১টার দিকে যৌথ কমান্ডো অভিযান শেষ করা হয়। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) পরিচালক কর্নেল রাশিদুল হাসান জানান, অভিযান শেষ হয়েছে। পরিস্থিতি এখন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে।
নিহত ৫ জঙ্গির নাম প্রকাশ
পুলিশকে উদ্ধৃত করে বেসরকারি টেলিভিশনে চ্যানেল টোয়েন্টিফোর এবং সময় টিভি গুলশানে হামলাকারী ৫ জঙ্গির পরিচয় জানিয়েছে। তারা হল আকাশ, বিকাশ, বাঁধন, ডন ও রিপন। তবে সাইট ইন্টেলিজেন্সের প্রধান রিটা কাওজ তার টুইটার একাউন্টে ৫ জঙ্গির যে ছবি প্রকাশ করেছেন তাতে তাদের নামে লেখা রয়েছে, আবু মুসলিম, আবু সালমা, আবু রাহিব, আবু ওমায়ের ও আবু মাহারেব। তবে এসব নাম নির্ভরযোগ্য কোন সূত্র থেকে যাচাই করা সম্ভব হয়নি।



 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন