ইনকিলাব ডেস্ক : ব্রেক্সিট গোটা যুক্তরাজ্যে পারিবারিক জীবনে কোন্দল-অশান্তির ঝড় তুলেছে। অসংখ্য পরিবারের সদস্যদের মধ্যে দেখা দিয়েছে কলহ, মা-বাবার সাথে সন্তানের মুখ দেখাদেখি, বন্ধ হয়ে গেছে কথাবার্তা, সৃষ্টি হয়েছে মানসিক দুরত্ব ও ক্ষোভ যা সহসা দূর হবার নয়।
১ জুলাই দি গার্ডিয়ানে প্রকাশিত প্রতিবেদনে যুক্তরাজ্যে ব্রেক্সিট পরবর্তী পরিস্থিতি তুলে ধরেছেন রিয়ানমন লুসি কসলেট। তিনি বলেন, এক বন্ধু তাকে বলেছেন যে ব্রেক্সিট ফলাফলের পরবর্তী ধাক্কায় তা আমার বয়স বাড়িয়ে দিয়েছে বলে আমি উদ্বিগ্ন। বাস্তবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগের পক্ষে ভোট দেয়ার পরপরই আবেগের পারদ চড়তে থাকে। ইউগোভ ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের ৭৫ শতাংশ ও ২৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সীদের ৫৬ শতাংশ ইইউতে থাকার পক্ষে এবং ৫০ থেকে ৬৪ বছর বয়সীদের ৪৪ শতাংশ ও ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে বয়সীদের ৩৯ শতাংশ ভোট দিয়েছে বলে জরিপের ফল প্রকাশের সময় থেকে ৫০-এর নিচে ও ৫০-এর উপরের বয়সীদের মধ্যকার সাগর সমান মতপার্থক্য দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। আমার বন্ধুসহ তরুণদের মধ্যে তখনি আমি ক্রোধ সঞ্চার হতে দেখেছি।
গত কয়েকদিনে হাজার হাজার তরুণ সামাজিক মাধ্যমগুলোতে তাদের কথা প্রকাশ করেছে। একজন টুইটে বলেছে, আমি আর কখনো ট্রেনে কোনো বৃদ্ধ ব্যক্তির প্রতি সম্মান দেখিয়ে নিজের সিট ছেড়ে দেব না। মিলেনিয়ালদের (যাদের বয়স ১৮ থেকে ৩৪) অধিকাংশ মনে করে যে, ব্রেক্সিটের পক্ষে ভোট দিয়ে বৃদ্ধ প্রজন্ম স্বার্থপরের মতো উত্তরসূরিদের বিরুদ্ধে কাজ করেছে। আপনি যদি নির্বাচনে দাঁড়ান আর আপনার পরিবারের সদস্যরা বাবা-মা, নাতি-নাতনী, চাচা-চাচিরা সবাই যদি আপনার বিরুদ্ধে ভোট দেয় তাহলে কি হবে?
মার্সিসাইডের স্টেফানির বয়স ২১। গণভোটের সপ্তাহটিতে সে তার বাবা-মার সাথে দেখা করতে এসেছিল। সে বলে, ফিরে যাবার পর মুহূর্ত থেকে আমাকে প্রশ্নের জোয়ারের সম্মুখীন হতে হবে যে, আমি কোন পক্ষে ছিলাম এবং কেন? তিনি বলেন, সুস্থ বিতর্কে আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু আমার বাবা-মা তােেদর নিজস্ব চিন্তার বাইরে কোনো কিছু দেখতে রাজি হননি এবং তারা আমার মতকে ভুল বুঝেছেন বা সম্পূর্ণ বাজে বলে উড়িয়ে দিয়েছেন।
ভোটে তাদের জয় হওয়ার পর তারা আমাদের ইউতে থাকতে চাওয়া ৪৮ শতাংশকে অপমান ও উপহাস করা অব্যাহত রাখে। আমাদের এক পারিবারিক বন্ধু ও ইইউ নাগরিক মহিলার সাথে তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে আমার বাবা তাকে বলেন যে, তিনি যদি ইইউকে এত ভালোবেসে থাকেন তাহলে চলে যেতে পারেন। এমনকি যখন বর্ণবাদ ও বিদেশি আতংকের বিষয়টি তুলে ধরা হলো তা যে ইইউ ত্যাগের আংশিক ফল তারা তাও স্বীকার করলেন না।
এ গণভোট স্টেফানির বাড়ি আসাকে বিনষ্ট করেছে, তবে তার পরিপ্রেক্ষিতে পরিবর্তন ঘটিয়েছে। যেটি হতে পারত পরিবারের সান্নিধ্যে তার সুন্দর একটি সপ্তাহ উদযাপন তা হয়ে উঠল এক বিবর্ণ ও সীমাহীন তর্কময়। স্টেফানি বলে, এর আগে কখনো আমার পরিবারের কাছে এত অপমানিত হইনি। যে বাবা-মাকে আমি এত ভালবাসতাম তাদেরকে আমি গণভোটের পর ভিন্ন আলোয় দেখতে পেলাম যারা অন্যের কথা শুনতে চায় না এবং তাদের মত অন্যদের জন্য কি উদ্বেগের কারণ হতে যাচ্ছে সে বিষয়ে তারা ভ্রƒক্ষেপহীন।
আলেক্স নামের এক তরুণ বলে, গণভোটের ফলাফলে আমার হৃদয় ভেঙে যায় এবং এ নিয়ে মায়ের সাথে আমার তুমুল ঝগড়া হয়। আমি বাবা-মাকে ব্রেক্সিটের পক্ষে ভোট না দিতে অনুরোধ করলেও তারা তা দেন। আমি তাদের বোঝানোর চেষ্টা করি যে এর ফলে আমার ও আমার সন্তানদের উপর কি প্রতিক্রিয়া হবে। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। এখন ব্যাপার যা দাঁড়িয়েছে আমি তাদের দিকে তাকাতে পারি না। আমার মনে হয়, তারা আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন।
২৮ বছরের জেমি তার ভাই সিঙ্গল মায়ের সাথে একটি কাউন্সিল ফ্ল্যাটে বড় হয়েছেন। তার মা তাদের তিনজনের ভালো থাকার জন্য কঠোর পরিশ্রম করেন। জেমি বলেন, মায়ের জন্য আমি গর্বিত। তিনি আমাদের জন্য ত্যাগ স্বীকার করেছেন। তিনি উদার ও সহৃদয়। কিন্তু তিনি অভিবাসীদের ঘৃণা করেন। গণভোটের ফলে আমার হৃদয় ভেঙে গেছে। তারপর এ নিয়ে মায়ের সাথে আমার ঝগড়া হয়। তিনি বলেন, তার মা ইইউ ছাড়ার পক্ষে ভোট দিয়েছেন, কারণ তিনি অ-ব্রিটিশদের এখানে দেখতে চান না। আমি ও আমার ভাই ইইউতে থাকার পক্ষে সোচ্চার হলেও যেহেতু তিনি এশীয়দের পছন্দ করেন না তাই বিপক্ষে ভোট দিয়েছেন।
সারাহ তার ঘনিষ্ঠজনদের সাথে তাদের অভিবাসী বিরোধী মনোভাবের জন্য তর্ক করেন। তিনি বলেন, আমার জন্ম মিডল্যান্ডে একটি কাউন্সিল স্টেটে। সেখানে আমার আত্মীয়দের অনেকেই এখনো বাস করে। তিনি বলেন, সবার মধ্যে একমাত্র আমিই ইইউতে থাকার পক্ষে। তারা সবাই বর্ণবাদী। আবার তারাই আমাকে জিজ্ঞেস করে, ইইউতে থাকার পক্ষের লোকেরা আমাদের বর্ণবাদী বলে কেন? তিনি বলেন, আমাদের মধ্যে যে বিভক্তি সৃষ্টি হয়েছে তা নিরসন হওয়ার সম্ভাবনা নেই। ২৪ জুন থেকে আমি তাদের কারো সাথে কথা বলি না। এক চরম তিক্ততা বিরাজ করছে।
স্বাভাবিকভাবেই সকল মতপার্থক্যই চরম তিক্ততায় রূপ নিয়েছে এমন নয়। এমা বলেন, আমার পুরো পরিবার ইইউ ছাড়ার পক্ষে ভোট দিয়েছে। আমার ৩১ বছর বয়স্ক ভাই এখন এ জন্য অপরাধবোধে ভোগে। আমার মা-বাবা কট্টর ইইউবিরোধী। ভোটের ফলাফলে তারা খুশি। কিন্তু আমি যেহেতু আঘাত পেয়েছি সে জন্য আমার মায়ের মন খারাপ। তার সকল বন্ধুর ছেলেমেয়েদেরও একই অবস্থা। আমি আমার মায়ের জন্য লজ্জিত। আমার প্রচ- রাগ এ জন্য যে, তিনি তার ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ বিবেচনা করেননি।
মা-বাবা ইইউর বিরুদ্ধে ভোট দেয়ায় তরুণী জো’র সাথে তাদের সম্পর্ক ছিন্ন হবার পথে। সে বলে, আমি খুবই আঘাত পেয়েছি। আমি ভাবতেই পারিনি ব্রিটেন ইইউ থেকে বেরিয়ে যাবে। আমার মনে হচ্ছে কিছু একটার মৃত্যু হয়েছে যা আমরা ফিরে পাব না। আমার বাবা-মা প্রায় ৩০টি আমার বাস করার ও কাজ করার অধিকারের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে।
এক তরুণীর চাচা ইইউ ত্যাগের পক্ষে ভোট দিয়েছে বলে সে এমন খেপেছে যে তার বিয়েতে তাকে আমন্ত্রণ না জানানোর কথা বিবেচনা করছে।
বহু তরুণই বয়স্ক লোকদের ইইউ বিরোধী ভোটের ঘটনাকে শুধু রাজনৈতিকভাবে দেখছে না, তারা এটাকে মনে করছে তাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে। পশ্চিম ওয়েলসের এক ব্যক্তি ইউরোপের কয়েকটি দেশে সারা জীবন ইইউ-অর্থায়নপুষ্ট কর্মসূচিতে পড়াশোনা বা কাজ করেছেন। তিনি ক্রুদ্ধ যে তা সত্ত্বেও তার মা ইইউ ছাড়ার পক্ষে ভোট দিয়েছেন। আরেক ব্যক্তি যিনি ইউরোপের দু’টি ভাষা জানেন তিনি কাজ করেন আরেকটি দেশে। তিনি বলেন, সবকিছু জেনেও আমার বাবা-মা ইইউ ছাড়ার পক্ষে তাদের ভোট দিয়েছেন।
কিছু বিপরীত ঘটনাও ঘটেছে। যুক্তরাজ্যের তরুণদের সবাই কিন্তু একচেটিয়াভাবে ইইউতে থাকার পক্ষে ভোট দেয়নি। যেমন ২৬ বছর বয়স্কা এমিলি। তিনি ইইউ ছাড়ার পক্ষে ভোট দিয়েছেন। আর তার বাবা-মা ও পিতামহ ভোট দিয়েছেন ইইউতে থাকার পক্ষে। তিনি জানান, আমি ও আমার ছোট বোন ইইউ ছাড়ার পক্ষে ভোট দেই। এ জন্য আমার মা আমাকে তিরস্কার করেন। আমার বাবা ভোটের ফলাফলে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সৈনিক আমার পিতামহ বলেন যে, তিনি ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত। এমিলি বলেন, আমি সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছি কিনা সে ব্যাপারে নিশ্চিত নই।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন