সোমবার ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

ধর্মীয় চরমপন্থা ইসলামের ইমেজকে ধ্বংস করছে

প্রকাশের সময় : ৪ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম

উবায়দুর রহমান খান নদভী : পবিত্র রমজানে যেসব নেতিবাচক বিষয় বাংলাদেশের মুসলমানদের সামনে এসেছে, সে সবই মূলত ধর্মীয় চরমপন্থীদের ছড়ানো বিভ্রান্তি। কোরআন, সুন্নাহ, ইজমা, কিয়াসের আলোয় রচিত শরীয়া বা ফিকহের স্বতঃসিদ্ধ নিয়মনীতি ভঙ্গ করা ও হাজার বছরের অনুসৃত ঐতিহ্যকে অস্বীকার করা যেসব চরমপন্থীর অভ্যাস; ইসলামের ইতিহাসে অবিসংবাদিত বিষয়ে বিশ্বমুসলিমের কোন মতানৈক্য নেই, ছিলও না। আল্লাহর একত্ববাদ, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর খতমে নবুওয়্যত, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের রাকাত সংখ্যা, যাকাত, হজ, রোজা, কিবলা, কা’বা ইত্যাদি নিয়ে মুসলমানদের ভেতর কোন দ্বিমতের সুযোগ নেই। কোরআন সুন্নাহর যেসব নির্দেশ পালনের বেলায় ঐচ্ছিক অপশন রয়েছে, যেসব বিষয়ে সাহাবায়ে কেরামের ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা, অভিমত বা পছন্দ রয়েছে, যেসব ক্ষেত্রে ইজতেহাদের প্রয়োজনে ইমামগণের আলাদা আলাদা মাজহাব রয়েছে, সেসব ক্ষেত্রে বিভিন্নতা ও বৈচিত্র্য ইসলামেরই স্বীকৃত রূপরেখা। এখানে গ্রহণযোগ্য স্থানে সাহাবী ও তাবেয়ীদের ইজতেহাদ বা মাজহাব না মানা বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বড় ফিতনা। চরমপন্থীদের একটি অংশ নিজেদের সালাফিষ্ট নামে প্রচার করে। তারা কোরআন-সুন্নাহর ইচ্ছামত ব্যাখ্যা দেয় এবং অনুসরণীয় ঐতিহ্য ও রীতি অনুসরণ না করে সমাজে ফিতনা ছড়ায়। তাদের মধ্যে মারাত্মক ক্ষতিকর গ্রুপটি হচ্ছে তাকফিরি গ্রুপ। যারা যে কোন ছুঁতায় মুসলমানদের কাফির সাব্যস্ত করে। মনগড়া কারণ দেখিয়ে মুসলমানদের হত্যা করে। সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের পরিবেশকে হাওয়া দেয়। যাদের অসহিষ্ণুতা ও বাড়াবাড়ির ফলে বিশ্বমুসলিম আজ বিপন্ন। যাদের সীমা লংঘন ও শরীয়ত বিরোধী আচরণের ফলে মহান ইসলামের শান্তিময় মানবিক ইমেজ আজ অনেকাংশেই ক্ষুণœ হওয়ার পথে।
একবার মধ্যপ্রাচ্যের মিডিয়ায় একটি প্রতিবেদন দেখেছিলাম, যেখানে বলা হয়েছিল যে, ইসলামসম্মত বৈচিত্র্য ও প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যকে অস্বীকার করা, মুসলিম সমাজে বিদ্বেষ-বিভেদ ছড়ানো এবং ইসলামী জগতে ব্যাপক অসহিষ্ণুতা সৃষ্টির জন্য ইসলামী ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত কিছু চরমপন্থীকে ইহুদী-খ্রিস্টানরা দাঁড় করিয়েছে। তারা অকারণেই মুসলমানদের মাঝে বিরোধ, বিদ্বেষ ও সংঘাত তৈরিতে নিয়োজিত। সর্বশেষ সউদী আরব সরকার এসব চরমপন্থীকে ধর্মহীন, নাস্তিক, মুরতাদ শক্তির দোসর বলে আখ্যায়িত করেছে। এদের ভেতর যারা ইসলামবিরোধী শক্তির এজেন্ট তারা তো মুসলমানই না। আর যারা মুসলমান হয়েও এ পথ অবলম্বন করেছে তাদের সম্পর্কে নবী করিম (সা.) বলেছেন, তোমরা তোমাদের ধর্মের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করো না। অতীতে অনেক জাতি ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ির ফলে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে।
বাংলাদেশের সমাজে প্রচলিত কিছু শুদ্ধ ও স্বাভাবিক বিষয়কে কেউ কেউ অজ্ঞতা বা ভয়ংকরী অল্প বিদ্যার ফলে ঘোলাটে করে তুলছেন। যা সর্বসাধারণকে ধর্মবিমুখ এবং নেক আমল থেকে বিচ্ছিন্ন করছে। এই রমজানে বেশ কিছু প্রশ্ন এমন এসেছে যা কোনদিনই বাংলাদেশের আলেম সমাজ আশা করেননি। কেউ হয়ত জিজ্ঞেস করল, হুজুর, তারাবীহ না পড়লে না কি গুণাহ হয় না। তাহলে তারাবীহ পড়বো কেন ? আপনি যদি একজন ইমাম-মুফতি বা আলেম হন, তখন আপনি এ প্রশ্নকর্তাকে কী বলবেন ? কীভাবে তাকে বোঝাবেন যে, রমজানে রাতে নামাজ পড়া আল্লাহর নবী (সা.) সুন্নত করেছেন, যা অবশ্য পালনীয় সুন্নত। যে ব্যক্তি রাতে নামাজে দাঁড়িয়ে রমজানকে পালন করবে তার অতীতের সব গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে। তাকে ফরজ নামাজের সমান সওয়াব দেয়া হবে। যদি শবে কদর লাভ করে তবে হাজার মাসের ইবাদতের চেয়ে উত্তম সওয়াব তার আমলনামায় জমা হবে। এরপর যদি কোন ব্যক্তি জানতে চায়, না পড়লে গুনাহ হবে কিনা, তাহলে তাকে এত সওয়াব ও সৌভাগ্যের কথা বলে কি কোন লাভ হবে ? কারণ, তাকে যারা বুঝিয়েছেন যে, তারাবীহ ফরজ নয় এটা না পড়লে কোন গুনাহ নেই, তারা যেহেতু ও ব্যক্তিকে তারাবীহ থেকে বিরত রাখাকেই ইসলামের বড় খেদমত মনে করছেন, তখন তাদেরকে বা এই ব্যক্তিকে আপনি কী করে বোঝাবেন যে, রমজান কেন এসেছে ? বিশ্বের কোটি কোটি মুসলমান গত প্রায় ১৫শ’ বছর ধরে কেন ২০ রাকাত তারাবীহ, ৮ রাকাত কিয়ামুল্লাইল, ইচ্ছামত তাহাজ্জুদ পড়ে এসেছেন? গুনাহ যদি না হয় তাহলে কেন এত নফল নামাজ, তিলওয়াত, ইফতার, সাহরি, দান-খয়রাত, তারাবীহ, কিয়ামুল্লাইল, তাহাজ্জুদ ও ইতেকাফÑ এর কোনটাই তো না করলে গুনাহ হয়না। তাহলে বিশ্ব মুসলিম কেন রমজানে ফরজ ইবাদতের বাইরে উল্লেখিত সুন্নত ও নফল ইবাদতগুলো পাগলপারা হয়ে ব্যাপক উৎসাহ,্ উদ্দীপনা এবং আবেগ-ভালোবাসা নিয়ে আদায় করে?
বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে কোরআন তেলাওয়াত নিয়েও। অর্থ না বুঝে পড়লে নাকি কোরআন পড়ার কোন সওয়াব নেই। কেন এমন নিরুৎসাহিতামূলক নেগেটিভ প্রচারণা চালান হচ্ছে। কারা কী উদ্দেশ্যে এসব প্রপাগা-া চালাচ্ছে, বোঝা মুশকিল। কোরআন বুঝে পড়লে বেশি সওয়াব হতে পারে, কিন্তু না বুঝে পড়লে সওয়াব হবে না, একথা কেউ বলতে পারেন না। নবী করীম (সা.) বলেছেন, কোরআনের প্রতি অক্ষরে দশটি করে নেকী দেয়া হয়। আমি বলব না যে আলিফ-লাম-মীম কেউ পড়লে দশটিই নেকী হবে। বরং এ তিনটি অক্ষরে ত্রিশটি নেকী দেয়া হবে। এখানে স্পষ্ট ইংগিত রয়েছে যে, না বুঝে পড়লেই অক্ষর প্রতি দশ নেকী দেয়া হবে। কেননা আলিফ-লাম-মীম-এর অর্থ দুনিয়ার কেউই জানে না। স্বয়ং আল্লাহ তার এ কথার অর্থ কাউকেই জানাননি। তাহলে নবী করীম (সা.) নেকীর উদাহরণ দিতে গিয়ে কোরআনের অর্থবোধক হাজারো শব্দ থেকে কোন একটি না বলে যে অক্ষরগুলোর অর্থ কেউই জানে না, সেগুলোই বললেন কেন? এ হাদীসে অক্ষরপ্রতি দশ নেকী বোঝানোর পাশাপাশি নবী করীম (সা.) এর উদ্দেশ্য এটিও ছিল যে, না বুঝে পড়লেও যে সওয়াব হবে তা বলে দেয়া। কেননা, বিশ্বের শত কোটি মুসলমান এমন আছে ও থাকবে, যারা অনারব হওয়ায় কোরআনের অর্থ জানবে না কিন্তু পড়তে জানবে। তারা যেন কোরআন পাঠের দ্বারা সওয়াব লাভ করতে পারে। না বুঝেই প্রতি অক্ষরে দশ নেকী করে, বুঝে পড়লে তার নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা অনুযায়ী যেন আরো বেশি পেতে পারে।
স্বতঃসিদ্ধ নির্দোষ ও জায়েজ বিষয় নিয়ে কেউ কেউ ইদানীং বাড়াবাড়ির পাশাপাশি অহেতুক বিতর্কের জন্ম দিতে ওঠে পড়ে লেগেছেন। একশ্রেণীর লোক এও বলছেন যে, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ও মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ বললে না কি ঈমান পূর্ণ হয় না। এটি নাকি কালেমায়ে তাইয়েবা নয়। এভাবে বললে নাকি শিরক হয়। পরশু চ্যানেল আইয়ে উপস্থাপক আরকান উল্লাহ হারুনী বরিশালের দিকে একটি বড় মসজিদের উপর প্রতিবেদন দেখাতে গিয়ে মসজিদের দাতা ও মুতাওয়াল্লিকে রীতিমত একারণেই নাজেহাল করলেন যে, মসজিদে কেন আল্লাহ মুহাম্মাদ (সা.) পাশাপাশি লেখা হলো? এভাবে লেখা নাকি শিরকের পর্যায়ে পড়ে। দর্শকদের অনেকেই মোবাইলে এবিষয়টি জানতে চান। কী বলব, ভেবে পাই না। ইসলাম, ঈমান, তাওহীদ, শিরক ইত্যাদি যেন এখন ছেলের হাতের মোয়ায় পরিণত হয়ে যাচ্ছে। যে যা বুঝছে তাই মিডিয়ায় প্রচার করে দিচ্ছে। কিছু জানুক না জানুক, বুঝুক না বুঝুক ফতওয়া দিয়ে দিচ্ছে। কোন আলেমের একটি শিক্ষামূলক আর্গুমেন্ট শুনেই নিজেকে জাহির করার জন্য বিষয়টি না বুঝেই অন্যকে নসিহত শুরু করে দিয়েছে। প্রত্যেকের অবস্থান ও পরিচয় জেনেও শুধু আল্লাহর নামের পাশে রাসূলের (সা.) নাম লিখলেই যদি শিরক হয়ে যায়, তাহলে তো কোরআন শরীফ বদলে ফেলতে হয়। আজান, ইকামতও সংশোধন করতে হয়। দুনিয়ায় সব মসজিদ এমনকি মসজিদে নববী থেকেও কেবল আল্লাহ রেখে মুহাম্মাদ (সা.) মুছে ফেলতে হয়। চার খলিফা, নবী পরিবার, প্রখ্যাত সাহাবীদের নাম মুছে ফেলতে হয়। তাহলে তো লা ইলাহা ইল্লাল্লাহর পাশে আর মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ লেখা কিংবা বলাও নিষিদ্ধ করে দিতে হয়। এসব স্থুল বুদ্ধির মূর্খ বা জ্ঞানপাপীদের কবল থেকে বাংলাদেশের ১৫ কোটি মুসলমান কী করে রক্ষা পাবে তা নিয়ে সবাইকে ভাবতে হবে। এরা যা করছে তা কেবল সালাফিষ্ট চরম পন্থারই প্রতিচ্ছায়া মাত্র। সনাতন পদ্ধতির শরীয়াসম্মত ইসলামী রীতি ঐতিহ্য মেনেই এদের থাবা থেকে নিজেদের ঈমান, আমল ও ঐতিহ্যকে রক্ষা করতে হবে।
পবিত্র কোরআনে অসংখ্য জায়গায় আল্লাহ তার নামের পাশে তার রাসূলের উল্লেখ করে বিধান ও নির্দেশনা জারি করেছেন, কোথায় দুনিয়ার কেউ তো এখানে শিরক দেখতে পেল না। আর আজ একশ্রেণীর অর্বাচীন রাসূল (সা.) এর প্রতি তাদের বিদ্বেষ প্রকাশের হাতিয়ার হিসেবে শিরকের দোহাই দিয়ে এ ধরনের অপব্যাখ্যা করে যাচ্ছে। (নাউজুবিল্লাহ)। আল্লাহ যেখানে বলেছেন, তোমরা আমার ও আমার রাসূলের অনুসরণ কর। যে ব্যক্তি রাসূলের অনুসরণ করল সে আমারই অনুসরণ করল। আল্লাহ এবং তার রাসূল মুশরিকদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। (আল কোরআন)। নবী করীম (সা.) বলেছেন, তোমাদের জন্য দু’টি বিষয় রেখে গেলামÑ এক. আল্লাহর কিতাব দুই. আমার সুন্নাহ। (আল-হাদীস)। আল্লাহ ও রাসূল (সা.) যৌথভাবে শরীয়তের বিষয় এভাবে বিধৃত করার মধ্যেও কি এসব নাদান শিরক খুঁজে পাচ্ছে? তারা কি আল্লাহকে পেতে চায় তার রাসূলকে ছাড়াই ? আল্লাহ তো বলেছেন, যদি আমার ভালবাসা লাভ করতে চাও তাহলে রাসূলের অনুসরণ কর। তখন আমিই তোমাদের ভালবাসব। মূর্খরা জানেনা যে, শত বছর আল্লাহকে ডাকলেও কোন কাজ হবে না, যদি একটি বারের জন্যেও কেউ আল্লাহর রাসূলকে অস্বীকার করে। এটাই আল্লাহর বিধান। রাসূলের মহব্বত, আনুগত্য এবং তাঁর প্রতি পরিপূর্ণ শ্রদ্ধা-ভালোবাসা ঈমানদার হওয়ার পূর্বশর্ত। রাসূল (সা.) এর নাম বা অবস্থানকে খাটো করতে যারা সর্বত্র শিরক খুঁজে বেড়ায়, তারাই চরমপন্থার ধারক। এদের উপর আল্লাহর গজব আসন্ন। এদের ব্যাপারে মুসলমানদের খুব সতর্ক থাকতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
রাসেল ৪ জুলাই, ২০১৬, ১:৩৩ পিএম says : 0
এদের ব্যাপারে মুসলমানদের খুব সতর্ক থাকতে হবে।
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন