এ.টি.এম. রফিক ও আশরাফুল ইসলাম নূর, খুলনা থেকে : বিশ্বখ্যাত ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনের খাল ও কুমির জরিপ চলছে। বিলুপ্তির পথে থাকা নোনাপানির প্রজাতির কুমিরের সংখ্যা নির্ণয়ের জন্যই বন বিভাগ ও সেন্টার ফর এ্যাডভান্সড রিসার্চ ইন ন্যাচারাল রিসোর্সেস অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট (ক্যারিনাম) যৌথভাবে এ জরিপ কাজ চলছে। একই সাথে সুন্দরবন জুড়ে চলছে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসস্থল, চিত্রল হরিণসহ বন্যপ্রাণী, জীববৈচিত্র ও খাল জরিপের কাজও। সুন্দরবনের বাঘ প্রকল্পের আওতায় ইউএসএআইডি ও বনবিভাগের ওয়াইল্ড টিমের বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশ অংশে এ জরিপ ও গণনার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এদিকে, বনবিভাগের নাকের ডগায় সরকারের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে কাঁকড়া শিকারে ব্যস্ত করেছে সুন্দরবন উপকূলীয় জনগোষ্ঠি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রোববার বিকেলে মংলা ফরেস্ট ঘাটে এক অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে কুমির জরিপ কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন খুলনা সার্কেলের বন সংরক্ষক জহিরউদ্দিন আহমদ। বন বিভাগ ও ক্যারিনামের সমন্বয়ে গঠিত ৪০ সদস্যের টীম সুন্দরবনে ১৫ দিন ধরে জরিপ করবে।
খুলনা সার্কেলের বন সংরক্ষক জহিরউদ্দিন আহমেদ জানান, সুন্দরবনের নোনাপানির প্রজাতির কুমিরের প্রকৃত সংখ্যা জানার জন্য এই জরিপ চালানো হচ্ছে। আর এ জরিপ কাজে আর্থিক সহায়তা করছে বিশ্বব্যাংক। ১৯৮৫ সালে আইআরএমের জরিপ শেষে দেয়া পরিসংখ্যানে জানা যায়, ১৫০ থেকে ২০০টি নোনাপানির কুমির রয়েছে সুন্দরবনে। তবে তা কমে বর্তমানে একশ’র নিচে বলে জানিয়েছেন বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ আবদুর রব।
সূত্রে জানা যায়, বন্য প্রাণী জরিপে ইউএসএআইডি ব্যয় করছে এক কোটি ২৪ লাখ টাকা। জরিপ কাজ শেষ হবে ১০ ফেব্র”য়ারি শেষ হবে। সুন্দরবনের বন্যপ্রাণী বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা (ডিএফও) জাহিদুল কবির জানান, ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনের বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্যের জরিপের পাশাপাশি এই বনের খালগুলো গণনাসহ হালনাগাদ প্রকৃত অবস্থা জানতে জরিপ শুরু হয়েছে। সুন্দরবনের অপরূপ সৌন্দর্য্য ধরে রাখতে এক হাজার ৮৭৪ বর্গ কিলোমিটার নদ-নদী ও খাল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। জোয়ারের পানির পলিমাটি ‘জমে’ বনের খালগুলোর বর্তমান অবস্থা কোন পর্যায়ে রয়েছে হাল নাগাদ সেসব তথ্য জরিপে উঠে আসবে। এছাড়া বিগত বছরগুরোতে সুন্দরবনের বঙ্গোপসাগর উপকূল জুড়ে বিশাল বিশাল চর জেগে ওঠার পর প্রাকৃতিকভাবে সেখানে ম্যানগ্রোভ বনের সৃষ্টি হয়েছে। এসব নতুন বন এলাকায়ও সৃষ্টি হয়েছে নতুন নতুন খাল। এসব খাল এখনো রয়ে গেছে সুন্দরবন বিভাগের জরিপ বা গণনার বাইরে।
নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে কাঁকড়া শিকার : সুন্দরবনের খালে জেলেরা নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মাছ শিকারের আড়ালে কাঁকড়া নিধন করছে খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরাসহ সুন্দরবন উপকুলীয় জনগোষ্ঠি। সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে সুন্দরবন উপকূলে প্রজনন মৌসুমেও ডিমওয়ালা কাঁকড়া শিকারের মহোৎসব চলছে। হাজার হাজার মণ মা কাঁকড়া অবাধে আহরণ করা হচ্ছে এই ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল থেকে। এভাবে প্রজননকালীন কাঁকড়া শিকার চলতে থাকলে চিংড়ির চেয়েও উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় এ মৎস্যসম্পদ অচিরেই বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বিশ্বের অন্যতম মৎস্যসম্পদ কাঁকড়ার প্রধান প্রজননক্ষেত্র হল ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল। অন্যদিকে বিশ্বের প্রধানতম ম্যানগ্রোভ এলাকা হল সুন্দরবনসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকা। এখান থেকে সংগৃহীত কাঁকড়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রফতানি হয়ে থাকে। এসব কাঁকড়ার প্রজনন মৌসুম জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি দুই মাস। প্রজনন মৌসুমে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের লোনাপানিতে এরা ডিম ছাড়ে। মাঘ মাসের প্রথম অমাবস্যায় সবচেয়ে বেশি ডিম দিয়ে থাকে স্ত্রী কাঁকড়া। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি এ দুই মাসজুড়ে সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, হংকং, চীনসহ বিভিন্ন দেশে নানা ধরনের উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। এসব উৎসবের খাদ্য তালিকায় ডিমওয়ালা কাঁকড়ার চাহিদা সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে ডিমওয়ালা কাঁকড়ার চাহিদা সবচেয়ে বেশি এবং এ সময় দামও থাকে সর্বোচ্চ। তাই বেশি দামের আশায় এবং সুন্দরবন ছাড়া অন্য ম্যানগ্রোভ এলাকায় প্রজননকালীন কাঁকড়া শিকার বন্ধের সরকারি উদ্যোগ না থাকার ফলে ডিমওয়ালা কাঁকড়া শিকারে চলে মহোৎসব। খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলার সুন্দরবন পাশ্ববর্তী এলাকার হাজার হাজার জেলে ডিমওয়ালা কাঁকড়া শিকার করছে।
একাধিক কাঁকড়া সংগ্রহকারী জানান, প্রতিদিন ৫ থেকে ৭ কেজি কাঁকড়া পান। ২-৩টি কাঁকড়ায় এক কেজি হয় এবং প্রতি কেজি ছয়-সাতশ’ টাকায় বিক্রি করেন। এখন কাঁকড়া বেশি ধরা পড়ছে এবং দামের দিক দিয়েও ভালো। একাধিক জেলে জানান, বর্তমানে সরকারিভাবে কাঁকড়া শিকার নিষিদ্ধ থাকার কারণে তারা মাছ ধরার পাস নিয়ে বনে ঢুকে কাঁকড়া শিকার করছেন।
স্থানীয় কাঁকড়ার আড়তদাররা জানান, এখন ডিমওয়ালা কাঁকড়া পাওয়া যায় বলে ঢাকার আড়তে এসব কাঁকড়ার বেশ চাহিদা রয়েছে এবং দামের দিক দিয়েও ভালো। অন্য সময় ডিমওয়ালা কাঁকড়া পাওয়া যায় না বলে তেমন চাহিদা থাকে না। খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরাসহ আশপাশ এলাকার সহস্রাধিক আড়তদার প্রতিদিন কয়েক হাজার মণ ডিমওয়ালা কাঁকড়া ঢাকায় পাঠান বলেও জানান।
এ ব্যাপারে মংলা উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ কুমার দেব জানান, উপকূলীয় ম্যানগ্রোভ অঞ্চল কাঁকড়ার প্রজনন ক্ষেত্র হলেও শুধু সুন্দরবন এলাকায় প্রজননকালীন শিকার নিষিদ্ধে আইন রয়েছে। এ ছাড়া কাঁকড়া শিকার বন্ধে তেমন কোন নির্দেশনা না থাকায় মৎস্য বিভাগ থেকে কোন উদ্যোগ নেয়া যাচ্ছে না।
পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জ কর্মকর্তা বেলায়েত হোসেন জানান, প্রজনন মৌসুমকে ঘিরে সুন্দরবনে কাঁকড়া আহরণের পাস-পারমিট বন্ধ রয়েছে। তবে চোরাই পথে কাঁকড়া আহরণের প্রবণতা বন্ধে বনবিভাগের টহল ও নজরদারিও বাড়ানো হয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন