আশরাফুল ইসলাম নূর, খুলনা থেকে : কোরবানির জন্য পশু ও প্রতিদিনের গোশতের জন্য আর ভারতের ওপর নির্ভরশীল হতে হবে না। সংকট মেটানোর জন্য আমেরিকার ব্রাহমা জাতের গরু উৎপাদন শুরু হয়েছে খুলনা বিভাগের দুই জেলায়। পূর্ণ বয়স্ক ষাঁড় ১৫ মণ গোশত এবং গাভী প্রতিদিন ১৮ কেজি করে দুধ দেবে। সে লক্ষ্যে ৩৩৪টি গাভীর প্রজনন হয়েছে ব্রাহমা জাতের সিমেন দিয়ে। এ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে। শুরু থেকে এ পর্যন্ত ৩৫টি বাচ্চা উৎপাদন হয়েছে। নতুন জাতের গরু উৎপাদনকারী জেলাগুলো হচ্ছে খুলনা ও বাগেরহাট।
সংশিষ্ট সূত্র জানায়, দক্ষিণাঞ্চলে প্রতিদিন মাথাপিছু গোশতের চাহিদা ১২০ গ্রাম, সরবরাহ ১০২ গ্রাম। মাথাপিছু প্রতিদিন দুধের চাহিদা ২৫০ গ্রাম, সরবরাহ ১১২ গ্রাম। গত কয়েক বছর যাবৎ ভারতীয় গরু কোরবানির ও প্রতিদিনের গোশতের চাহিদা মেটাত। ভারত থেকে আমদানি বন্ধ হওয়ার পর গরুর তীব্র সংকট দেখা দেয়।
এ সংকট মেটাতে প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তর বিফ ব্রিড ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের আওতায় আমেরিকার ব্রাহমা জাতের গরু উৎপাদনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। এই প্রক্রিয়ার আওতায় খুলনা মহানগরী, রূপসা উপজেলা, ফুলতলা উপজেলা ও বাগেরহাটের মোল্লাহাট উপজেলাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতাভুক্ত এলাকা হচ্ছে নগরীর লবণচরা, পশ্চিম বানিয়া খামার, বাগমারা, গল্লামারী, রূপসা উপজেলার আইচগাতি, রাজাপুর, বাধাল, ফুলতলা উপজেলার ধোপাখোলা, মশিয়ালী, দক্ষিণডিহি, উত্তরডিহি, শিরোমনি, যুগ্নীপাশা, গাবতলা, বুড়িরডাঙ্গা, আলকা, দামোদর, ডাকাতিয়া, বাগেরহাটের মোল্লাহাট উপজেলার গাংনী, বুড়িগাংনী, রাজপাট, গাওলা, মাদারতলী, নতুন ঘোষগাতি, ঘাটভিলা, সুড়িগাতি, সারুলিয়া ও মেঝের গাওলা।
জানা গেছে, দেশীয় জাতের গরু দৈহিক ওজন প্রতিদিন ২০০-৩০০ গ্রাম বৃদ্ধি পেলেও ব্রাহমা জাতের গরুর ওজন বাড়ে ১ হাজার থেকে ১৫শ’ গ্রাম। বাছুর জম্মের পর মায়ের দুধের পাশাপাশি দানাদার খাবার খেতে শুরু করে। দু’মাস থেকে ছয় মাস বয়সী বাছুরের জন্য প্রতিদিন ১০০ টাকা খাবার বাবদ খরচ হয়। ছয় মাসের বেশি বয়সের ষাঁড়ের জন্য প্রতিদিন দেড় থেকে দুশ’ টাকা খবার বাবদ খরচ হয়।
সূত্র জানান, এ প্রক্রিয়ার আওতায় ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে গত মাস পর্যন্ত ৩৩৪টি গাভীর প্রজননে ব্রাহমা জাতের সিমেন ব্যবহার হয়েছে। প্রকল্পভুক্ত এলাকায় এ পর্যন্ত ১৬টি এঁড়ে ও ১৯টি বকনা বাছুরের জন্ম হয়েছে। এ বছরের শেষ নাগাদ অনেক খামারের ষাঁড় বিক্রির উপযোগী হয়ে উঠবে।
মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ ব্রাহমা জাত সম্পর্কে বলেছেন, প্রোটিনের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি জৈব সারের উৎপাদনের উদ্দেশ্যে এ জাতের গরু উৎপাদন কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। এই প্রকল্পে বেকার মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। বিশেষজ্ঞদের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় এই জাতের গরুর গোশতের ক্ষতিকারক দ্রব্য পাওয়া যায়নি। কোরবানির পশু ও প্রতিদিনের গোশতের ঘাটতি পূরণে দুই তিন বছর সময় লাগবে।
প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এক প্রকাশনায় উল্লেখ করেছেন অধিক গোশত সম্পন্ন জাতের গরু উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টির চাহিদা পূরণ, কর্মসংস্থান, পুঁজি বিনিযোগ, জৈব সার উৎপাদন, জমির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি, গোশত রপ্তানি, বায়ো গ্যাস উৎপাদন, রাসায়নিক সারের উপর নির্ভরশীলতা কমানো, গোশত উৎপাদনে স্বর্নিভরতা অর্জনে সহায়ক হবে।
কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্র খুলনার সহকারী পরিচালক ডা. কিরণ কান্তি রায় জানান, খামারিদের মধ্যে নতুন এ জাত নিয়ে সাড়া পড়েছে। খামারিরা স্বাবলম্বী হয়ে উঠবে এবং অভ্যন্তরীণ বাজারে আমিষের চাহিদা পূরণ হবে।
খুলনা কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্রের সহকারী কর্মকর্তা শেখ সালাহউদ্দিন জানান, রূপসা ও মহানগরী এলাকায় ৯৮ জন খামারি এই জাতের গরু উৎপাদন কার্যক্রম শুরু করেছে। ৬ মাস বয়সী এঁড়ের ওজন দাঁড়িয়েছে সাড়ে তিন মণে। তিনি আশাবাদী পূর্ণ বয়স্ক ষাঁড়ের ওজন ১৫ মণ হবে।
মোল্লাহাট উপজেলা পাণী সম্পদ কর্মকর্তা আকবর আলী হাজরা জানান, আগামী তিন বছরের মধ্যে এ অঞ্চলে গরুর গোশত ও দুধের সংকট কাটবে। ফুলতলা উপজেলা কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্রের সহকারী জিল্লুর রহমান জানান, এ উপজেলা নতুন জাতের ২৪টি বাচ্চা জন্মেছে। চাষিদের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি জানান, দেশীয় জাতের তুলনায় ব্রাহমা জাতে তারা আর্থিকভাবে লাভবান হবে।
মোল্লাহাট উপজেলার নাশুখালি গ্রামের চাষি হাসান শেখ জানান, দু’মাস বয়সী এঁড়ের ওজন ৬০ কেজি ছাড়িয়ে গেছে। তার খামারে দুটি এঁড়ের জন্য প্রতিদিন খাবার খরচ ১৫০ টাকা।
খুলনার ফুলতলা উপজেলার খামারি রবিউল মোল্লা জানান, তার খামারের দুটি বাছুরের ওজন প্রতিদিন গড়ে ৫০০ গ্রামের উপরে। তিনি আশাবাদী দু’বছর পর দুটি ষাঁড় ৪ লাখ টাকা মূল্যে বিক্রি করতে পারবেন।
উল্লেখ্য, কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্র সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাটের ২৫টি উপজেলায় এক লাখ ৪৮ হাজার গাভীকে প্রিজিয়াম, সাইওয়াল ও লোকাল প্রিজিয়াম জাতের সিমেন দিয়ে প্রজনন করতে সক্ষম হয়েছে। এ সময় বাচ্চা হয়েছে ৫২ হাজার ৮৬৫টি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন