করোনা পরিস্থিতিতে একের পর এক বিশ্বের বড় বড় শহরগুলো বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। চীন, ইতালি, ইরান, দক্ষিণ করিয়া, স্পেনসহ পৃথিবীর অনেক দেশ কার্যত অচল। মহামারি আকার ধারণ না করলেও দক্ষিণ এশিয়ার জনবহুল বাংলাদেশে করোনা রোগী ধরা পড়েছে। মারাত্মকভাবে আক্রান্ত দেশগুলোর সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ থাকায় বাংলাদেশ শঙ্কামুক্ত নয়। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি), বুয়েটসহ ঢাকা শহরের বড় বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়লে তা সামাল দেয়া অসম্ভব। প্রশাসনের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেয়া না হলেও বুয়েটের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা ক্লাস, পরীক্ষায় অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অন্যদিকে মারাত্মক পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আগে আবাসিক হল ও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দিতে প্রয়োজনে শিক্ষার্থীরা ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে জানিয়েছেন ডাকসু সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসেন।
ঢাবির গণরুমে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে ছোট জায়গায় মেজেতে বিছানা পেতে ৩০ জন, কোন কোন হলে আরও বেশি শিক্ষার্থী থাকছে। ১৮টি হলের গণরুমে সাড়ে তিন হাজারের বেশি শিক্ষার্থী এভাবেই আছে। শুধুমাত্র সূর্য সেন হলেই ২১টি গণরুমে ৫০০ এর বেশি শিক্ষার্থীর বসবাস। এসব শিক্ষার্থীদের সাধারণত নিজস্ব কোন বিছানা থাকে না। যে যেখানে সুযোগ পায় পালাবদল করে থাকে। তারা নিয়মিত ক্লাস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ; রিডিংরুম, লাইব্রেরীতে যাতায়াত করছে। কলা ভবনে ৮০ জন ধারণ ক্ষমতার শ্রেণীকক্ষে ঠাসাঠাসি করে ২০০ জনের অধিক শিক্ষার্থীকে ক্লাস করানোর অভিযোগ রয়েছে। একই অবস্থা অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের পরিবহণ বাসেও। ফলে প্রশাসনের দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে শিক্ষার্থীরা সহজেই সংক্রামিত হওয়ার আশঙ্কা করছেন। করোনাভাইরাসের সম্ভাব্য বিস্তার রোধে কর্তৃপক্ষের প্রস্তুতির ঘাটতিতে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন শিক্ষার্থীরা।
করোনা আতঙ্কে শুক্রবার রাত ৮টায় বুয়েটের বিভিন্ন বিভাগের ক্লাস রিপ্রেজেন্টেটিভ শিক্ষার্থীদের বৈঠক হয়। এতে অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্লাসে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তারা। বিশ^বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করতে প্রশাসনের সাথে বৈঠক করারও সিদ্ধান্ত নেন তারা। শিক্ষার্থী ইমাম উদ্দিন সুবহা বলেন, আমরা সবাই আলোচনা করেছি ক্লাসে যাব না, ইতিমধ্যে অনেকেই বাড়িতে চলে গেছে এবং আমরা আছি তারা স্যারের সাথে কথা বলব। তবে আমরা ক্লাস করছি না। তিনি বলেন, আমরা নিজেদের সেফটির কথা চিন্তা করে আমরা নিজেরাই এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি কারণ বুয়েট প্রশাসন এখন পর্যন্ত কার্যত দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে সক্ষম হয়নি। ১৫তম ব্যাচসহ নবীন ব্যাচগুলো এ সিদ্ধান্ত নেয়। তবে বুয়েটের ছাত্র কল্যাণ পরিষদের পরিচালক ড. মিজানুর রহমান এখনও কোন ধরণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি বলে গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন।
গত বৃহস্পতিবার রাতে ঢাবি প্রভোস্ট কমিটির এক বৈঠকে বিশ্ববিদ্যালয়ে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পরলে তা রোধের জন্য একাধিক পরিকল্পনা গ্রহণ করে কর্তৃপক্ষ। এতে মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতা দিবস উদযাপন অনুষ্ঠানগুলোতে দর্শকের সংখ্যা কমানোর পরামর্শ দেয়া হয়। তারা আরও বলেছেন, সব হলে পর্যাপ্ত ও নিরবচ্ছিন্ন পানি এবং হ্যান্ড স্যানিটাইজার সরবরাহ করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, সম্ভাব্য ভাইরাসের আক্রমণের জন্য ঢাবির মেডিকেল সেন্টার প্রস্তুত রাখা হবে এবং যাদের ঠান্ডাজনিত সমস্যা আছে তাদের সেখানে বিশেষ চিকিৎসা দেওয়া হবে। এদিকে বিদেশে গবেষণা বা উচ্চতর পড়াশুনা করার জন্য যেসব শিক্ষক দেশের বাইরে আছেন আপাতত তাদের দেশে ফিরে আসতে নিরুৎসাহিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় সভায়। ঢাবির স্যার পিজে হার্টগ আন্তর্জাতিক হলে থাকে বিদেশি আবাসিক শিক্ষার্থীরা। বর্তমানে তারা বাংলাদেশে নেই। পরবর্তী বিজ্ঞপ্তি না দেওয়া পর্যন্ত তাদের বাংলাদেশে ফিরতে নিষেধ করা হয়েছে। তাদের কেউ স¤প্রতি বাংলাদেশে এসে থাকলে সেল্ফকোয়ারেন্টাইনে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সবগুলো হলের কর্তৃপক্ষকে বলা হয়েছে সতর্কতামূলক পোস্টার ঝুলিয়ে রাখতে।
তবে উদ্ভুত পরিস্থিতি বিবেচনায় ঢাবি বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন ডাকসু সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসেন। তিনি বলেন, প্রয়োজনে নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেদের নিতে হবে। আগে সেফটি, পরে পড়াশোনা। বিশ^বিদ্যালয় বন্ধের পক্ষে জনমত যাচাই করতে জনপ্রিয় ফেসবুক গ্রুপ স্বপ্নের ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় ফেসবুক পুল করে। সেখানে শনিবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত ২৭৫৬ জন শিক্ষার্থী মতামত প্রকাশ করেন। যার মধ্যে ২০১৭ জন বিশ^বিদ্যালয় বন্ধের পক্ষে মত দিয়েছেন। ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের নবীন শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে বিশ^বিদ্যালয় বন্ধের দাবিতে রোববার মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের পক্ষ থেকে আহ্বায়ক হাসান আল মামুন স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের দাবি জানিয়ে শনিবার দুপুরে বলা হয়, গতবছর ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়লে বাংলাদেশের বিশ^বিদ্যালয়গুলোর পক্ষে তা প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়নি। এমতাবস্থায় করোনা ভাইরাসের ভয়াবহতা বিবেচনায় সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধে সরকার ও প্রশাসনের কাছে দাবি জানায় সংগঠনটি।
প্রস্তুতি নেই প্রশাসনের: ঢাবি পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, ক্যাম্পাসে ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতারা প্রচলিত হ্যান্ডশেক ও কোলাকুলি বহাল রেখেছে। যা করোনা ছড়িয়ে পড়ার অনুকূলে বলে বিবেচিত হচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ ও জনবহুল ভবনগুলোতে ওয়াশরুমে কোন প্রকার স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা করা হয়নি। সচেতনতা তৈরিতেও কোন ধরণের টাস্কফোর্স কিংবা কমিটি গঠন করেনি প্রশাসন। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টার থেকে একটি সচেতনতামূলক লিফলেট দেয়া হলেও প্রতিরোধের উদ্যোগ নেয়া কিংবা আক্রান্ত শিক্ষার্থীদের জন্য কোন প্রকার ব্যবস্থাও নেই সেখানে। এমনকি কোয়ারেন্টাইন, থার্মাল স্ক্যানার, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও মাস্কের কোন ব্যবস্থাও নেই।
মেডিকেল সেন্টারের প্রধান মেডিকেল অফিসার ডা. সারওয়ার জাহান মুক্তাফী বলেন, মেডিকেল সেন্টারে করোনা বিষয়ক কোন ধরনের সরঞ্জাম নেই। তবে আমরা বিভিন্ন হল ও বিভাগে সচেতনতামূলক নির্দেশনা পাঠিয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তুতি নেয়ার সে সক্ষমতা নেই। গণরুমের শিক্ষার্থীরা করোনা ঝুঁকিতে রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, যেহেতু এক রুমে অনেক শিক্ষার্থী থাকে, তাই তারা একটু ঝুঁকিতে থাকবে। যদি একজন আক্রান্ত হয় তাহলে অনেকেই আক্রান্ত হতে পারে। শিক্ষার্থীদের উদ্বেগ, বিশ্ববিদ্যালয়ের মত জনবহুল এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে করোনা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিষয়টি নিয়ে কোন ধরনের উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। প্রশাসন ও ডাকসুকে কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানান তারা।
ফার্মেসি বিভাগের উদ্যোগ: ভাইরাস থেকে সুরক্ষায় শিক্ষকদের সহায়তায় নিজস্ব অর্থায়নে ‘হ্যান্ড স্যানিটাইজার’ তৈরি করেছে ঢাবি ফার্মেসী অনুষদের স্নাতক ও স্নাতকত্তোর পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা। তৈরিকৃত স্যানিটাইজার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মাঝে বিতরণ করা হবে। শুক্রবার বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টারে প্রাথমিকভাবে এই স্যানিটাইজার তৈরি করা হয়। ইতোমধ্যে ২০০ বোতল তৈরির কাজ সম্পন্ন হয়েছে। নতুন করে আরও ২০০ বোতল তৈরির কাজ চলছে। যদিও উৎপাদন খরচ বেশি হওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের সকলের মাঝে বিতরণ করা নিয়ে অনিশ্চয়তাও দেখা দিয়েছে। বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক প্রফেসর আ ব ম ফারুক, ও ফার্মেসী অনুষদের ডিন প্রফেসর সিতেশ চন্দ্র বাছারের সহযোগিতায় ক্লিনিক্যাল ফার্মেসী ও ফার্মাকোলজি বিভাগের সহযোগী প্রফেসর আব্দুল মুহিত শিক্ষার্থীদের নিয়ে কাজটি করছেন। করোনা ভাইরাসের সংক্রামণ ঠেকাতে মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলে হ্যান্ডওয়াশ ও ন্যাপকিন বিতরণ করা হয়েছে। শুক্রবার সকালে হল প্রভোস্টের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের এসব সামগ্রী বিতরণ করা হয়।
ঢাবি ভিসি প্রফেসর ড. মো. আখতারুজ্জামান শিক্ষার্থীদের আতঙ্কিত না হয়ে কোনো জরুরি প্রয়োজনে হল প্রভোস্টের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেছেন। প্রক্টর প্রফেসর একে এম গোলাম রাব্বানী একাডেমিক কার্যক্রম স্থগিত করার বিষয়ে আপাতত কিছু ভাবছেন না উল্লেখ করে গণমাধ্যমকে বলেন, যদি কোনো শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে পড়ে, তাহলে আমরা যেকোনো ধরণের সহায়তা দিতে প্রস্তুত আছি। যদি কোনো শিক্ষার্থী করোনাভাইরাসে সংক্রামিত হয় বা দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতির অবনতি হয় সেক্ষেত্রে আমরা এটা (বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করা) বিবেচনা করব।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন