কূটনৈতিক সংবাদদাতা : চলতি মাসের মাঝামাঝি সময়ে এশিয়া ও ইউরোপের দেশগুলোর জোট ‘আসেম’ সম্মেলনে যোগ দিতে মঙ্গোলিয়া যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় তিনি বিশ্ব নেতাদের সামনে বাংলাদেশের সর্বশেষ পরিস্থিতি তুলে ধরবেন। জঙ্গি ও সন্ত্রাস দমনে বাংলাদেশের নেয়া পদক্ষেপ এবং আন্তর্জাতিক সহায়তা নিয়েও কথা বলবেন তিনি। সেখানে ইতালির প্রধানমন্ত্রী মাত্তিও রেনজি ও জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের সঙ্গে বৈঠক করবেন প্রধানমন্ত্রী। এছাড়া সেখানে তিনি জার্মান চ্যান্সেলর, রুশ প্রেসিডেন্ট, চীনা প্রধানমন্ত্রী, মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট, মঙ্গোলিয়ার প্রেসিডেন্ট, ইউরোপিয়ান কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট এবং ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলাদা আলাদা বৈঠক করবেন। আসেম-এর ১১তম দ্বিবার্ষিক শীর্ষ সভায় যোগ দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ১৪ জুলাই তিন দিনের সরকারি সফরে মঙ্গোলিয়া যাচ্ছেন। আসন্ন আসেম সম্মেলনে এশিয়া ও ইউরোপের ৫১টি দেশের রাষ্ট্র কিংবা সরকারপ্রধানের অংশ নেয়ার কথা রয়েছে।
প্রসঙ্গত, গত ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার ঘটনার পর এ বৈঠক বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে। ওই হামলায় সাত জাপানি, নয় ইতালিয়ান ও এক ভারতীয় নাগরিকসহ ১৭ জন বিদেশিকে নির্মমভাবে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। তিনজন বাংলাদেশি নাগরিক ও দু’জন পুলিশ কর্মকর্তাও নিহত হন হামলায়। পরে হাসপাতালে মারা যান আটক আরও একজন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, আগামী ১৫ ও ১৬ জুলাই মঙ্গোলিয়ার রাজধানী উলানবাটারে এশিয়া ও ইউরোপের দেশগুলোর জোট আসেম-এর ১১তম দ্বিবার্ষিক শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। জানা গেছে, রাষ্ট্রনেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী গুলশান হামলাসহ বাংলাদেশে সন্ত্রাসী হামলা এবং তার সরকারের অবস্থান তুলে ধরবেন। বাংলাদেশ সরকার যে এরই মধ্যে সন্ত্রাস দমনে সন্ত্রাস দমন আইনসহ আরো নানা পদক্ষেপ নিয়েছে, তা তুলে ধরবেন প্রধানমন্ত্রী। বিশেষ করে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সরকারের ‘জিরো টলারেন্স নীতি’, সামাজিক উদ্যোগ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নজরদারি, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং অনুষ্ঠানে নিরাপত্তা-নজরদারি তুলে ধরা হবে। এর সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীতে জঙ্গিবিরোধী বিশেষায়িত ইউনিট, প্রযুক্তি ব্যবহারের কথাও তুলে ধরবেন প্রধানমন্ত্রী।
সাবেক কূটনীতিক মোহাম্মদ জমির এ বিষয়ে বলেন, গুলশান হামলার পর এই সম্মেলনটি বাংলাদেশের জন্য একটি বড় সুযোগ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের সর্বশেষ পরিস্থিতি এখানে একেবারে সরাসরি ইউরোপ ও এশিয়ার রাষ্ট্রনেতাদের কাছে তুলে ধরতে পারবেন। এতে করে পারস্পরিক বোঝাপড়ার একটি পরিবেশ তৈরি হবে আশা করছি। এই যেমন সন্ত্রাস দমনে বাংলাদেশ এরই মধ্যে মার্কিন সহায়তা নেয়ার কথা বলেছে। বাংলাদেশকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে ভারতও। তবে এশিয়ার অন্যান্য দেশে এবং ইউরোপের দেশগুলি এবার কীভাবে সহায়তা করতে পারে, তা নিয়ে কথা বলতে পারবেন প্রধানমন্ত্রী। এছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশকে সন্ত্রাস দমনে সাহায্যের যে প্রস্তাব দিয়েছে, সে ব্যাপারেও আরো বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ থাকবে।
তিনি বলেন, বলা বাহুল্য, ইটালি ও জাপানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলাদা বৈঠক করবেন শেখ হাসিনা। কারণ গুলশান হামলায় এই দু’টি দেশের নাগরিকরা নিহত হন। প্রধানমন্ত্রী এর আগে তাদের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন। তবে এবার সরসরি কথা বলবেন। এতে করে জঙ্গি দমনে বাংলাদেশের অবস্থান, হামলা-পরবর্তী তদন্ত এবং অপরাধীদের বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে, তা স্পষ্ট করার সুযোগ তৈরি হবে।
মোহাম্মদ জমিরের কথায়, গুলশান হামলার পর বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বহির্বিশ্বে এক ধরনের নেতিবাচক প্রচারণা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আশা করা যাচ্ছে, ইউরোপ এবং এশিয়ার নেতাদের এর জবাব দিতে পারবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
গুলশানের ওই হামলার পর জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করে সব ধরনের সহযোগিতাসহ সন্ত্রাস দমনে বাংলাদেশের পাশে থাকার কথা জানান।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখা থেকে জানা যায়, আসন্ন সম্মেলনে আসেমের কার্যক্রম পর্যালোচনা এবং ভবিষ্যৎ কার্যক্রম নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি কানেকটিভিটির বিষয়টি বিশেষভাবে গুরুত্ব পাবে। কানেকটিভিটি ইস্যুতে সম্মেলনে বক্তব্য রাখবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আসেম-এর সদস্য হিসেবে রয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত ২৮ দেশ, ইউরোপের আরও ২টি দেশ এবং এশিয়ার ২১ দেশ। এছাড়া আঞ্চলিক সংস্থা হিসেবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আসিয়ান এর সচিবালয় সদস্য। প্রতি দুই বছর পরপর একবার এশিয়ায় এবং একবার ইউরোপে আসেম শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সর্বশেষ ২০১৪ সালে ইতালির মিলানে আসেমের দশম শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ বছর এশিয়ার দেশ মঙ্গোলিয়ায় ১১তম সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
‘বাংলাদেশ সংকট’ নিয়ে প্রস্তাব উত্থাপনের সিদ্ধান্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের
ইউরোপ ও এশিয়ার দেশগুলোর সরকার প্রধানদের নিয়ে অনুষ্ঠিতব্য আন্তর্জাতিক আসেম সম্মেলনে বিশ্ব নেতাদের সামনে ‘বাংলাদেশের চলমান সংকট’ নিয়ে প্রস্তাব উত্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এই প্রস্তাবের মধ্যে বাংলাদেশের ‘নিরাপত্তা ঝুঁকি’ ও ‘রাজনৈতিক সংকটকে’ সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশের ‘রাজনৈতিক সংকট’ ও ‘নিরাপত্তা ঝুঁকির ইস্যুটির’ যদি উন্নতি না হয় তাহলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশের বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। এমন তথ্যই আন্তর্জাতিক আসেম সম্মেলনে বিশ্ব নেতাদের সামনে তুলে ধরবে ইউরোপের দেশসমূহের এই জোটটি। ঢাকার সর্বশেষ পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন কূটনৈতিক সূত্র জানিয়েছে।
এশিয়া ও ইউরোপের দেশগুলো নিয়ে গঠিত হয়েছে আসেম। বর্তমানে এর সদস্য সংখ্যা ৫৩। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এ জোটের সদস্য। আগামী ১৫ থেকে ১৬ জুলাই মঙ্গোলিয়ার রাজধানী উলানবাটারায় অনুষ্ঠিত হচ্ছে এ জোটের ১১তম দ্বি-বার্ষিক সম্মেলন। সম্মেলনে ইউরোপ ও এশিয়ার দেশসমূহের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানরা অংশ নেবেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা এ সম্মেলনে অংশ নেবেন। বিশ্ব নেতাদের মিলনমেলায় পরিণত হবে সম্মেলনস্থল।
কূটনৈতিক সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সময়ের জঙ্গি হামলার সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে ১১ জুলাই বৈঠক হয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের। সেই বৈঠকে বাংলাদেশের ‘নিরাপত্তা ঝুঁকি’ ও ‘রাজনৈতিক সংকট’ নিয়ে বিশেষ আলোচনা হয়েছে। জঙ্গি হামলার পরে মার্কিন কর্মকর্তা নিশা দেশাইর আকস্মিক ঢাকা সফরটিকেও গুরুত্বের সঙ্গে দেখেছে তারা। একই সঙ্গে ইইউতে থাকা বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে তাদের উদ্বেগের বিষয়টি বাংলাদেশ সরকারকে জানাতে বলেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। পাশাপাশি তাদের এ উদ্বেগের বিষয়টি প্রস্তাব আকারে আগামী আসেম সম্মেলনে তুলে ধরবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইইউ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন