শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

বাংলা সাহিত্য বিশ্বপাঠকের কাছে পৌঁছানোর আহ্বান

অমর একুশে বইমেলা উদ্বোধন প্রধানমন্ত্রীর

প্রকাশের সময় : ২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১১:৩৪ পিএম, ১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬

বিশেষ সংবাদদাতা : বাংলা ধ্রুপদী ও সাম্প্রতিক সাহিত্যের সুনির্বাচিত সম্ভার বিশ্বপাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে আরও ব্যাপকভিত্তিক ও মানসম্পন্ন অনুবাদের আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একইসঙ্গে তৃণমূলের গণমানুষের জীবন ও সংগ্রাম সাহিত্যকর্মে ফুটিয়ে তোলারও আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। গতকাল (সোমবার) বিকেলে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে মাসব্যাপী অমর একুশে বইমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী এ আহ্বান জানান। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক ড. শামসুজ্জামান খান, প্রকাশকদের পক্ষে অন্যপ্রকাশের প্রধান নির্বাহী মাজহারুল ইসলাম। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি প্রতিবছর বইমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাংলা সাহিত্যের অনুবাদের ওপর জোর দিয়ে আসছি। এ বছর বাংলা একাডেমি থেকে বাংলা সাহিত্যের মীর মশাররফ হোসেনের অমর উপন্যাস ‘বিষাদ সিন্ধু’র ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। আমি আমাদের ধ্রুপদী ও সাম্প্রতিক সাহিত্যের সুনির্বাচিত সম্ভার বিশ্বপাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে আরও ব্যাপকভিত্তিক ও মানসম্পন্ন অনুবাদের আহ্বান জানাই। সেই সঙ্গে আমাদের কবি-লেখকদের কাছে অনুরোধ- তৃণমূলের গণমানুষের জীবন ও সংগ্রাম আপনাদের সাহিত্যকর্মে ফুটিয়ে তুলুন। দেশের সকল নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীর ভাষা-সংরক্ষণ ও বিকাশেও আপনাদের সবাইকে আরও মনোযোগী হওয়ার অনুরোধ জানাই।
বক্তৃতার শুরুতে প্রধানমন্ত্রী বাংলা একাডেমি নিয়ে তার স্মৃতিচারণ করেন। তিনি জানান, বাংলা একাডেমিতে তার অনেক সময় কেটেছে। তার প্রয়াত বন্ধু বেবী মওদুদকে নিয়ে এখানকার লাইব্রেরিতে পড়াশোনা করতেন। অনেক সময় কাটাতেন।
শেখ হাসিনা বলেন, এখানে আসতে আমার খুব ভালো লাগে। তবে অনেক নিয়মে বন্দি থাকতে হয় এখন। সরকারি কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। আবার কবে বইমেলায় আগের মতো ঘুরে বেড়াতে পারবো! মুক্ত হয়ে বইমেলায় ঘুরে বেড়ানোর প্রত্যাশায় থাকলাম। তিনি আরও বলেন, সারা বছরই এখন অনেক আকাক্সক্ষা নিয়ে বসে থাকি বইমেলা কখন আসবে। ফেব্রুয়ারি আমাদের প্রেরণা দেয়। প্রতিবাদের ভাষা শেখায় এই মাস। বিজয়ের পথ দেখায় এই মাস।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় বাংলা ভাষার অধিকার আদায়ের সংগ্রাম এবং এতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, বাঙালি জাতি কোনোদিন মাথা নত করেনি। আন্দোলন-সংগ্রাম করে আর বুকের রক্ত দিয়ে বাঙালি যুগে যুগে তার ন্যায্য দাবি আদায় করেছে। এরই মহত্তম প্রকাশ ঘটেছিল ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি। প্রধানমন্ত্রী স্মরণ করেন, শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ছাত্র-জনতার প্রতিবাদ বিক্ষোভের কথা। ২১ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে রফিক, জব্বার, বরকত, সালামসহ অনেক নাম না জানা ছাত্র-জনতার আত্মদানের কথা। তিনি বলেন, ২১ ফেব্রুয়ারির আঘাত শুধু আন্দোলনকারীদের উপরই ছিল না, এটা ছিল বাংলা ভাষা এবং বাঙালি জাতিসত্তার উপর আঘাত। ভাষা আন্দোলনের পথ বেয়ে শিক্ষা আন্দোলন, ছয়-দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের ঐতিহাসিক নির্বাচন ও একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ বছরই বঙ্গবন্ধু উত্থাপিত ঐতিহাসিক ছয়-দফার পঞ্চাশ বছর অর্থাৎ সুবর্ণজয়ন্তী। যে ছয়-দফা ছিল প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধুর এক দফা অর্থাৎ স্বাধীনতা ঘোষণার প্রথম ধাপ। আমি জেনে অত্যন্ত আনন্দিত যে, বাংলা একাডেমি এবারের একুশের মাসব্যাপী আলোচনায় ছয়-দফাকে একটি আলোচ্য বিষয় হিসেবে নির্ধারণ করেছে।
তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বাংলা একাডেমি আমাদের সবার অত্যন্ত প্রিয় ও পবিত্র অঙ্গন। ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমির একুশের অনুষ্ঠান উদ্বোধন করতে এসে এই প্রাঙ্গণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- আমাদের হাতে যেদিন ক্ষমতা আসবে, সেদিন থেকেই দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হবে। বাংলা ভাষার প-িতেরা পরিভাষা তৈরি করবেন, তারপরে বাংলা ভাষা চালু হবে, সে হবে না। তার এই দূরদর্শী বক্তব্য সেদিন সবাইকে উদ্বেলিত করেছিল স্বাধীনতার স্বপ্নে। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালে জাতীয় সাহিত্য সম্মেলন উদ্বোধন করতে এসে এ বাংলা একাডেমি অঙ্গনেই বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- ‘আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতি যেন শুধু শহরের পাকা দালানেই আবদ্ধ না হয়ে থাকে, বাংলাদেশের গ্রাম-গ্রামান্তরে কোটি কোটি মানুষের প্রাণের স্পন্দনও যেন তাতে প্রতিফলিত হয়।
একুশে বইমেলা যাত্রার তিন দশক পেরিয়ে এখন বিশ্বের দীর্ঘ সময়ব্যাপী বইমেলার স্বীকৃতি পেয়েছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, এ বইমেলাকে কেন্দ্র করে দেশের নানাপ্রান্তের মানুষ এমনকি বহির্বিশ্বে বসবাসরত বাঙালিদের বিপুল সমাগম ঘটে। এই মেলা এখন পরিণত হয়েছে বৃহত্তর বাঙালির মিলনমেলায়। মননগত দিকের পাশাপাশি এর অর্থনৈতিক দিকও গুরুত্বপূর্ণ। গ্রন্থ বিপণন ও বাণিজ্যের মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতি সমৃদ্ধ হয়। সেই সঙ্গে বইমেলা উপলক্ষে বাংলা একাডেমি আয়োজিত মাসব্যাপী সেমিনার ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শিল্প-সংস্কৃতি ক্ষেত্রে সৃষ্টি করে নবতর চাঞ্চল্য।
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিয়ে বিশ্বের দরবারে এ ভাষার গৌরব ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আমি নিজেও জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ অধিবেশনে নিয়মিত বাংলায় ভাষণ দিয়ে আসছি। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর রফিকুল ইসলাম, আবদুস সালামের মতো প্রবাসী বাঙালিদের প্রচেষ্টায় এবং আওয়ামী লীগ সরকারের আন্তরিক উদ্যোগে ২১ ফেব্রুয়ারি ইউনেস্কো কর্তৃক ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
তিনি বলেন, গত কয়েক বছর ধরে একুশে বইমেলার মঞ্চে দেশের বাইরের বিদেশি লেখক-প-িতদেরও সমাগম হচ্ছে। তাদের উপস্থিতির মধ্য দিয়ে বাংলার সমৃদ্ধ ভাষা-সাহিত্যের বার্তা যেমন বহির্বিশ্বে পৌঁছে যাবে, তেমনি বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির আলোয় আমরা নিজেদের সমৃদ্ধ করতে সক্ষম হবো।
বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্তদের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি ক্ষেত্রে আমরা সুদূরপ্রসারী নানা উদ্যোগ ্র্রহণ করেছি। বছরের শুরুতে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিনামূল্যে পাঠ্যবই সরবরাহ করছি। চলতি বছর ৩৩ কোটি ৩৭ লাখ ৬২ হাজার ৭৭২টি বই বিতরণ করা হয়েছে। বিনামূল্যে এতো বিপুলসংখ্যক বই বিতরণের উদ্যোগ গোটা বিশ্বেই বিরল। আমরা সৃজনশীল প্রকাশনা-ক্ষেত্রে যেমন প্রণোদনা দিয়ে আসছি, তেমনি ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের অংশ হিসেবে পরিবর্তনশীল বিশ্বের প্রকাশনাধারায় প্রবেশের জন্য ই-বুক কার্যক্রম দ্রুতগতিতে এগিয়ে নিচ্ছি।
তিনি এ সময় বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের বিচারকাজ সম্পন্ন ও একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রমের বিষয়েও কথা বলেন। শেখ হাসিনা বলেন, সারাবিশ্বে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠেছে। কিন্তু আমাদের সাহসী ও সময়োপযোগী পদক্ষেপের ফলে সব ধরনের সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের মূলোৎপাটন করা হয়েছে। বিভিন্ন স্তরের স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহ শক্তিশালী হয়েছে।
নিহত ৫ পুলিশ পরিবারকে প্রধানমন্ত্রীর আর্থিক সহায়তা
বিভিন্ন সময় দায়িত্বপালনরত অবস্থায় নিহত ৫ পুলিশ সদস্যের পরিবারকে ৪০ লাখ টাকা আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল (সোমবার) দুপুরে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে তিনি এ সব সহায়তার চেক প্রদান করেন। পরে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম সাংবাদিকদের এ বিষয়ে অবহিত করেন। সহায়তা প্রদানকালে নিহত পুলিশ সদস্যদের পরিবারের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন প্রধানমন্ত্রী। এ সময় আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। প্রধানমন্ত্রী শোকাহত পরিবারের সদস্যদের সান্ত¦না দেন।
এ সময় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ, স্বরাষ্ট্র সচিব মোজাম্মেল হক খান, প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম, পুলিশের আইজিপি একেএম শহিদুল হকসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। দায়িত্ব পালনকালে নিহত ৫ পুলিশ সদস্য হলেন- পুলিশের সহকারী উপ-পরিদর্শক ইব্রাহিম মোল্লা, সহকারী উপ-পরিদর্শক সিরাজুল ইসলাম, কনস্টেবল মুকুল হোসাইন, কনস্টেবল বশির আহমেদ এবং কনস্টেবল সাবিনা ইয়াসমিন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন