শামসুল হক শারেক, কক্সবাজার অফিস : ৯ শত খ্রিস্টাব্দে সাগর বক্ষে জেগে উঠা দ্বীপ কুতুবদিয়া এখন অস্তিত্ব সংকটে। ইতোমধ্যে সাগরে বিলীন হয়েছে এক-তৃতীয়াংশ এলাকা। চারপাশে অব্যাহত ভাঙ্গনে কুতুবদিয়ায় চলছে এখন সকাল বিকাল জোয়ারভাটা। কুতুবদিয়া অচিরেই সাগরে বিলীন হয়ে যাবে কি না এনিয়ে শঙ্কিত দ্বীপবাসী। কুতুবদিয়া রক্ষায় প্রধানমন্ত্রীর সুনজর কামনা করে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানিয়েছেন দ্বীপবাসী।
বিশ^ আবহাওয়া সংস্থার তথ্য মতে, আগামী দশকে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা আরো দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়বে এবং এতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাও বৃদ্ধি পাবে। নদ-নদীতে বেড়ে যাবে লোনা পানির পরিমাণ। বিলুপ্তির মুখোমুখি হবে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ প্রজাতির প্রাণী। বাস্তুভিটা হারাবে সমুদ্র তীরবর্তী এলাকার হাজার হাজার পরিবার। এসব এলাকায় তীব্র সঙ্কট দেখা দিতে পারে বিশুদ্ধ পানির। আবহাওয়া পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীর যে সব দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে তার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়।
কক্সবাজারের উপকূলীয় এলাকার বিরাট একটি অংশ এ ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ আশঙ্কার মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ চট্টগ্রামের বাঁশখালীর হাটখালী, ছনুয়া, কক্সবাজারের চকরিয়ার মগনামা, উজানটিয়া ও বাতিঘর খ্যাত দ্বীপ কুতুবদিয়া। ইতোমধ্যে কুতুবদিয়াসহ উপকূলবাসীর ঘাড়ে চেপে বসেছে আবহাওয়াগত পরিবর্তনের মারাত্মক প্রভাব।
সাগরের অব্যাহত ভাঙ্গনে অধিকাংশ এলাকায় কুতুবদিয়া রক্ষাবাঁধের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে। বিশেষত, ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর পর থেকে ওসব ভাঙ্গা অংশ দিয়ে প্রতিনিয়ত জোয়ার-ভাটা চলছে। চাষাবাদতো হচ্ছেই না, তার ওপর মানুষের জানমাল ও সহায়-সম্পদ নিয়ে বসবাস করা মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কক্সবাজারের বিচ্ছিন্ন উপজেলা কুতুবদিয়ার প্রায় দু’লাখ মানুষের জন্মভিটা রক্ষায় প্রধানমন্ত্রীর জরুরী হস্তক্ষেপ দাবি করেছেন অসহায় দ্বীপবাসী।
৪০ কি.মি.দ্বীপ রক্ষাবাঁধের অস্তিত্ব নেই কোথাও, অধিকাংশই বিলীন হয়েছে সাগরে। যে ৫/৬ কি.মি. সিসিব্লকের বাঁধ ছিল তাও ল-ভ- হয়ে গেছে গত রোয়ানুর আঘাতে। একদিকে আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, অন্যদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সেকেলে ডিজাইনের বাঁধে দ্বীপবাসী কিছুতেই রক্ষা পাচ্ছে না সামুদ্রিক জোয়ার থেকে। নিয়মিত জোয়ার-ভাটার কারণে উত্তর ধুরুং, কৈয়ারবিল, লেমশীখালী, দক্ষিণ ধুরুং, বড়ঘোপ ও আলী আকবর ডেইলের প্রায় দেড় লাখ মানুষ নোনাপানিতে হাবুডুবু খাচ্ছে গত তিন বছর ধরে। ওসব এলাকার মানুষের কাঁচা ঘরবাড়ি রক্ষা পাচ্ছে না জোয়ারের পানি থেকে। এ ছাড়া রোয়ানুর আঘাতে বিচ্ছিন্ন প্রধান সড়ক আযম সড়কসহ দ্বীপের পূর্বদিকের বেড়িবাঁধ নির্ভর উত্তর ধুরুং থেকে তাবালেরচর এলাকার মানুষের নিত্যচলাচলে চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন কুতুবদিয়াবাসী।
জানা গেছে, ৪ কোটি টাকা ঘুষ নেয়ার অভিযোগে ঠিকাদাররা পাউবো ঘেরাও করে তালা ঝুলিয়ে দেয়ার হুমকি দিলে গত ৩০ জুন পাউবো কর্তৃপক্ষ ৭ প্যাকেজে প্রায় ৪ কোটি টাকার টেন্ডার করার কথা থাকলেও তা বাতিল করা করা হয়। দ্বীপ রক্ষার দাবীতে গত ৮ জুলাই উপজেলা সদরে স্টুডেন্ট ওয়েলফেয়ার এসাসিয়েশনের আয়োজনে শান্তিপূর্ণভাবে এক মানব বন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। এতে দ্বীপের বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অংশ গ্রহণ করে। মানব বন্ধন থেকে কুতুবদিয়ার মানুষের নিরাপত্তা বিধানে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের চরম ব্যর্থতাকে দায়ী করে পর্যাপ্ত পরিমাণ বরাদ্দ রেখে জরুরী ভিত্তিতে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করে কুতুবদিয়া বাঁচানোর জন্য প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়।
মানব বন্ধনে বক্তব্য রাখেন কুতুবদিয়া প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক হাছান কুতুবী, এনজিও ব্যক্তিত্ব জসিম উদ্দিন কাতেবী, বুয়েট থেকে সদ্য পাসকরা প্রকৌশলী সাদ্দাম হোছাইন, এড. সেলিম উল্লাহ, মৎস্যজীবী সমিতির সভাপতি আবুল কালাম আযাদ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সিহাব উদ্দিন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এজাম উদ্দিন, মাষ্টার জাকারিয়া, সাংবাদিক নজরুল ইসলাম, ব্যবসায়ী আবদুল মালেক, স্টুডেন্ট ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশনের সভাপতি হেলাল উদ্দিন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এর ১৯৯১ সালের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ৩১ বর্গমাইলের কুতুবদিয়া বর্তমানে কোথায় গিয়ে ঠেকেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে এ দ্বীপের সাগর তীরবর্তী এলাকাসমূহ নিয়মিত জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হওয়ায় মোট আয়তনের এক-তৃতীয়াংশ জায়গা দীর্ঘ সময় লোনা পানিতে নিমজ্জিত থাকে। এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, আনুমানিক ৯০০ খ্রিস্টাব্দে জেগে উঠা কুতুবদিয়া দ্বীপের অস্তিত্ব কি দেশের মানচিত্র থেকে অচিরেই মুছে যাচ্ছে?
১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে সাগরগর্ভে হারিয়ে গেছে আলী আকবর ডেইল ইউনিয়নের খুদিয়ারটেকসহ, বড়ঘোপ, কৈয়ারবিল ও ধুরুং ইউনিয়নের পশ্চিমাংশের বেশ বিস্তীর্ণ এলাকা। এসব এলাকার বাসিন্দারা অনেকেই বাধ্য হয়ে দ্বীপ ছেড়ে জেলার বিভিন্ন স্থানে বসতি গড়ে তুলেছেন। ’৯১’র পরে সর্বশেষ ‘রোয়ানু’ পর্যন্ত ছোট বড় ৯টি ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলা করেছে কুতুবদিয়াবাসী। গত ঘূর্ণিঝড় ‘রোয়ানু’তে বিলীন হয়েছে পাউবো’র ৭১ নং পোল্ডারের ৪০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের ২০ কিলোমিটার। ওই বিলীন হওয়া অংশ দিয়ে নিয়মিত জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হচ্ছে কুতুবদিয়ার নিম্নাঞ্চল। সুপেয় পানির অভাবে বিভিন্ন পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি সূত্রমতে, কুতুবদিয়ার চতুর্পাশে বিলীন হওয়া বেড়িবাঁধ সংস্কার কাজের জন্য একনেকে পাসকৃত ৫৪ কোটি টাকা বরাদ্দসহ অন্যান্য উৎস হতে আরো প্রায় ৩০ কোটি টাকার মত বাজেট হলেও এ পর্যন্ত টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষ করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ।
কুতুবদিয়ার চতুর্পাশে টেকসই ও পরিবেশ বান্ধব বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য দাবি উঠেছে বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে। সোচ্চার হয়েছে দ্বীপের অবহেলিত মানুষের অধিকার আদায়ের এ দাবী। এরই প্রেক্ষিতে উপকূলীয় জীবনমান ও কর্মসংস্থান জোট (গ্রীণ বেল্ট ট্রাস্ট) কুতুবদিয়া রক্ষার দাবীতে ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে প্রধানমন্ত্রী বরাবরে ছয় দফা দাবিনামা পেশ করেছে।
নেদারল্যান্ডভিত্তিক একটি গবেষেণা সংস্থায় কর্মরত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্য ও সমুদ্র বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের শিক্ষক এম. শাহনেওয়াজ চৌধুরীর নেতৃত্বে একদল গবেষক কুতুবদিয়া রক্ষার জন্য টেকসই বেড়িবাঁধের পাশাপাশি কস্তুরা তৈরি বাঁধ, ব্যাপকভাবে সল্টমার্স, ম্যানগ্রোভ ও ঝাউ বনায়নের প্রস্তাব করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, অতীতে বিভিন্ন সরকার কুতুবদিয়া রক্ষায় চারপাশে বেড়িবাঁধ নির্মাণে শত শত কোটি টাকা খরচ করলেও তার সিংহভাগ টাকাই হয়েছে লুটপাট। ওই টাকা স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার ও পাউবো কর্মকর্তাদের পকেট ভারী করলেও টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণে কোন কাজই হয়নি বলে জানান ভুক্তভোগী অনেকেই।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন