বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

বাংলাদেশকেন্দ্রিক স্নায়ুযুদ্ধে এবার এক ধাপ এগিয়ে গেল আমেরিকা

প্রভাব বিস্তারের ঠান্ডা লড়াইয়ে ভারত এখনো আপার হ্যান্ডে

প্রকাশের সময় : ১৪ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মোবায়েদুর রহমান : ভূ-মন্ডলীয় রাজনীতিতে বিশেষ করে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতিতে গণচীনকে ঠেকানোর জন্য আমেরিকা ও ভারতের (ইন্দো-আমেরিকান) মাঝে স্থাপিত সখ্য আজও বহাল আছে। কিন্তু বাংলাদেশে প্রভাব বিস্তারের বেলায় ভারত আমেরিকাকে কোন ছাড় দিতে প্রস্তুত নয়। এই নিয়ে বাংলাদেশ প্রশ্নে ইন্দো-মার্কিন স্নায়ু যুদ্ধ লেগেই আছে। এই ঠা-া লড়াইয়ে ভারত সব সময় আপার হ্যান্ডে আছে। কিন্তু গুলশান হত্যাকা-কে কেন্দ্র করে ভারত-মার্কিন স্নায়ু যুদ্ধে আমেরিকা এবার এক ধাপ এগিয়ে গেছে।
২০১৪ সালের ২৪ জানুয়ারি ভারতীয় বংশোদ্ভূত নিশা দেশাই বিসওয়াল প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার মন্ত্রী সভায় দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্র মন্ত্রী নিযুক্ত হন। তারপর আড়াই বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এই আড়াই বছরে সরকারি কাজে তিনি বেশ কয়েকবার বাংলাদেশ সফরে এসেছেন। কিন্তু কোন বারেই তার সফর সফল হয়েছে বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষক মহল মনে করেন না। কিন্তু এবারই সর্বপ্রথম ইন্ডিয়ান আমেরিকান এই মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্র মন্ত্রীর বাংলাদেশ মিশন অনেকাংশে সফল হয়েছে বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন। বাংলাদেশ ত্যাগের প্রাক্কালে গত ১২ জুলাই মঙ্গলবার নিশা দেশাই দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন যে, জঙ্গিবাদ ও জঙ্গিবাদী হামলা নিয়ে বাংলাদেশ সরকার এতদিন ধরে যে অবস্থানে ছিল, তার সাথে আলোচনার পর তার ধারণা হয়েছে যে বাংলাদেশ সেই অবস্থান থেকে সরে এসেছে। ‘দৈনিক ইনকিলাব’সহ গতকাল বুধবার একাধিক পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত খবর মোতাবেক নিশা দেশাই বলেন যে, অতীতে বাংলাদেশ সরকার জঙ্গি তৎপরতাকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিরাজমান রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের ফসল বলে মনে করত। এখনও তারা সরাসরি বলেনি যে এসব তৎপরতা আইএস বা আল-কায়েদা করেছে। তবে আগের অবস্থান থেকে সরে এসে তারা এটুকু স্বীকার করেছে যে, এসব জঙ্গি হামলার সাথে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ রয়েছে। মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্র মন্ত্রীর মতে এই যে আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততা বাংলাদেশ সরকার মেনে নিয়েছে, সেটি একটি ইতিবাচক দিক।
সফর আংশিক সফল কেন?
এই সফরের শেষ দিকে এসে মার্কিন মন্ত্রীকে অত্যন্ত উৎফুল্ল মনে হয়েছে। সফর শেষ করে তিনি ৫ টি টুইট বার্তা দিয়েছেন। এছাড়া সফর শেষ করার পূর্বাহ্নে তিনি বাংলাদেশের একটি প্রাইভেট টেলিভিশন চ্যানেলের সাথে খোলা মেলা আলাপ-আলোচনা করেছেন। ঐ আলোচনায় তিনি বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বাস করে যে বাংলাদেশী জঙ্গি এবং আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী নেটওয়ার্কের মধ্যে সংযোগ রয়েছে। তিনি বলেন, আমরা দেখেছি যে, জুলাই মাসের ১ তারিখে যে হামলা হলো তার দায় স্বীকার করেছে আইএস। এর আগেও আমরা দেখেছি যে, যেসব হামলা হয়েছে সেগুলোর দায় হয় আইএস, না হয় আল-কায়েদা স্বীকার করেছে। তিনি আরও বলেন, আমরা বিশ্বাস করি যে, বাংলাদেশী জঙ্গিদের দেশীয় নেটওয়ার্ক এবং আন্তর্জাতিক জঙ্গিদের নেটওয়ার্কের মধ্যে যোগাযোগ রয়েছে।
ইন্ডিয়ান-আমেরিকান এই মন্ত্রীর সফরকে পূর্ণাঙ্গ সফল না বলে আংশিক সফল বলার কারণ, সফর শেষ করে তিনি যে টুইট করেছেন সেখানে বলেছেন যে, সন্ত্রাস মোকাবেলা করার ব্যাপারে তিনি বাংলাদেশ সরকারের সাথে ‘সুনির্দিষ্ট পন্থা’ নিয়ে আলোচনা করেছেন। তবে বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামাল বলেছেন যে, আমেরিকা বাংলাদেশকে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদানের প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ এখনো ঠিক করেনি যে কোন কোন ক্ষেত্রে এই সহযোগিতা গ্রহণ করা হবে। এ ব্যাপারে আমেরিকার কাছে বাংলাদেশের অবস্থান পরিষ্কার করার পূর্বে বাংলাদেশ দেখবে যে, জঙ্গি মোকাবেলার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কোথায় কোথায় সক্ষমতার ঘাটতি রয়েছে। নিশা দেশাই যে ৫ টি টুইট করেছেন তার মধ্যে অন্তত ২ টিতে তিনি বাংলাদেশ সফরকে ‘গুরুত্বপূর্ণ সফর’ (Important Visit) বলে আখ্যায়িত করেছেন।
বেগম জিয়াকে এড়িয়ে গেছেন
নিশা দেশাইয়ের এই সফর ৩ দিনের হলেও এটিকে বাংলাদেশের মিডিয়া ঝটিকা সফর হিসেবে বর্ণনা করেছেন। সফরের প্রথম দিনে তিনি বাংলাদেশে কর্মরত ভারতীয় হাই কমিশনার হর্ষ বর্ধন শ্রিংলার সাথে দীর্ঘক্ষণ ধরে একান্ত বৈঠক করেন এবং তার সাথে বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন। পরদিন তিনি বাংলাদেশের সর্বশেষ জঙ্গি তৎপরতা নিয়ে যুক্তরাজ্য, কানাডা এবং অষ্ট্রেলিয়ার রাষ্ট্রদূত ও হাই কমিশনারদের সাথে বৈঠক করেন এবং বাংলাদেশের জঙ্গি তৎপরতা কিভাবে যৌথভাবে মোকাবেলা করা হবে সেটি নিয়েও আলোচনা করেন। মঙ্গলবার বিকালে তিনি অনেকগুলো দেশের রাষ্ট্রদূতদের সাথে নৈশ ভোজ করেন। তিনি তাদেরকে তার সফরের ফলাফল সম্পর্কে অবহিত করেন। ঢাকা ত্যাগের পূর্বাহ্নে তিনি সংবাদপত্র ও টেলিভিশনসহ ৭ টি মিডিয়ার সম্পাদকদের সাথে বৈঠক করেন। এই বৈঠককে ‘অফ দি রেকর্ড ব্রেক ফাস্ট বৈঠক’ বা অফ দি রেকর্ড প্রাতঃরাশ বৈঠক বলা হয়। এরা হলেন, ডেইলি স্টার ও প্রথম আলোর সম্পাদক মাহফুজ আনাম ও মতিউর রহমান, নিউ এজের সম্পাদক নুরুল কবির, বাংলা ট্রিবিউনের সম্পাদক জাফর সোবহান, ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেসের সম্পাদক মোয়াজ্জেম হোসেন, সমকাল সম্পাদক গোলাম সরোয়ার। এছাড়াও বৈশাখী চ্যানেলের সিইও মনজুরুল আহসান বুলবুল এই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বলে সংবাদপত্রের খবরে প্রকাশ। এদের মধ্যে একজন ছাড়া অবশিষ্টরা একটি বিশেষ রাজনৈতিক ঘরানার লোক হিসেবে ঢাকার পর্যবেক্ষক মহলে পরিচিত। নিশা দেশাই ৩ দিনে সমাজের এত লোকের সাথে বৈঠক করতে পারলেন, কিন্তু দেশের বৃহত্তম দুটি রাজনৈতিক দলের অন্যতম বিএনপির নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সাথে দেখা করতে পারলেন না। এর আগের বার উচ্চ পদস্থ যে মার্কিন কর্মকর্তা ঢাকায় এসেছিলেন তিনিও বেগম জিয়াকে এড়িয়ে গেছেন। এসব ঘটনা থেকেও কি বিএনপি বুঝতে পারেনি যে তাদের প্রতি মার্কিন সমর্থন ছিল নেহাত একটি লিপ সার্ভিস?
বিএনপির ভ্রান্তি বিলাস
গত ৩০ জুন এবং ১ জুলাই সকালে গুলশানে যে ভয়াবহ রক্তপাত ঘটে গেল সেটি বর্তমান জেনারেশন তাদের জীবদ্দশাতে কোনদিন দেখেনি। ফলে সারাদেশ এই নৃশংস হত্যাকা-ে কেঁপে উঠেছিল, শিউরে উঠেছিল। দেশের প্রধান বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি এবং দেশের বৃহত্তম জোট হিসেবে ২০ দলের এই রক্তক্ষয়ী ঘটনায় যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিত ছিল সেভাবে তারা দেখাতে পারেনি। ঘটনা ঘটার ৬ দিন পর ঈদ হয়েছে। এই ৬ দিন বা ৫ দিনেও কি বিএনপি এবং অন্যান্য ইসলামী দল রাজপথে প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারলো না? সেই প্রতিক্রিয়া দেখানোর জন্য তাদেরকে ১০ দিন অপেক্ষা করতে হলো? ফলে যা ঘটবার তাই ঘটেছে। বিএনপি তথা ২০ দল অনেক পেছনে পড়ে গেছে।
আ.লীগ সেক্যুলার ঘরানার সকলকে
একত্রিত করছে : কিন্তু বিএনপি?
রক্ত হিম করা এমন একটি ভয়াবহ ঘটনায় সকলেই ধারণা করেছিল যে, কোন রাজনৈতিক দলই এই দুঃখজনক ঘটনা থেকে পলিটিক্যাল মাইলেজ বা রাজনৈতিক ফায়দা লোটার চেষ্টা করবে না। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, আওয়ামী লীগের অন্তত ৩ জন মন্ত্রী এত বিপুল রক্তপাতের পরেও সেই পুরানা ব্লেম গেমে লিপ্ত হয়েছেন। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে, তাদের ভাষায়, তারা মুক্তিযুদ্ধের সমস্ত শক্তিকে এক কাতারে শামিল করার চেষ্টা করছেন। সেখানে বিএনপি কি করছে? বেগম খালেদা জিয়া বৃহত্তর ঐক্য গঠনের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। এই দেশের সাধারণ মানুষও সেদিনই বুঝেছিল যে বেগম জিয়ার ঐক্যের প্রস্তাব তাৎক্ষণিকভাবে প্রত্যাখ্যাত হবে। কারণ, ২০০৯ সাল থেকে আওয়ামী লীগ ‘একলা চলো’ নীতি অনুসরণ করে চলছে। এইতো কিছু দিন আগেও বিএনপি বারবার সংলাপের জন্য সরকারের দরবারে দরখাস্ত করেছে। সেই সব দরখাস্ত একটি সময়ে ভিক্ষাবৃত্তির পর্যায়ে চলে গেছে। সরকারও প্রতিবারই বিএনপিকে পত্রপাঠ বিদায় দিয়েছে। এবারও তাই দিয়েছে। তবে বিএনপি এখনও সেই পুরানা সুরেই গান গেয়ে চলেছে। সেই গান এখন জনগণের কাছে একঘেয়ে এবং বিরক্তিকর মনে হচ্ছে। আওয়ামী লীগ যেখানে বিশেষ ঘরানার সমস্ত শক্তিকে একত্রিত করছে সেখানে বিএনপি কি পারে না, দেশের সমস্ত জাতীয়তাবাদী, ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী এবং আধিপত্যবাদ বিরোধী শক্তিকে এক জামাতে শামিল করার উদ্যোগ নিতে?
আর নয় বিদেশ নির্ভরতা
এবার চাই জননির্ভরতা
মাঝে মাঝে আমার খটকা হয়, বিএনপি পলিটিক্স ঠিকমত বোঝে কিনা। বিগত সাড়ে ৭ বছর হলো দেখা গেছে, জনদুর্ভোগের কোন ইস্যু নিয়ে তারা মাঠে নামে না। আওয়ামী সরকারের সাথে মার্কিন সম্পর্ক ভাল না, তাই বিএনপি মার্কিন সমর্থন পাবে। অথবা নরেন্দ্র মোদি কংগ্রেস করেন না, তাই মোদি সরকারের সমর্থন বিএনপির দিকে আসবে। এমন ভ্রান্তি বিলাসে বিএনপি সাড়ে ৭ বছর কাটালো। এখন তাদের মোহ মুক্তি ঘটা উচিত। চাতক পাখির মত অথবা সূর্যমুখী ফুলের মত বিদেশের দিকে তাকিয়ে না থেকে বিএনপিকে এখন জনগণের মুখপানে তাকিয়ে থাকতে হবে। আবার তাদেরকে জনগণের মাঝে যেতে হবে। জনগণকে ডাকতে হবে। জনগণকে সাথে নিয়েই দৈনন্দিন সমস্যা নিয়ে হোক বা গুলশান হত্যাকা-ের মত ইস্যু হোক, সেই সব ইস্যু নিয়ে মাঠে নামতে হবে এবং জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। তারা যদি জনগণকে রাজপথে নামাতে পারে একমাত্র তখনই তাদের সামনে আসবে সুদিন। অন্য কোন পথে নয়।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন