রফিকুল ইসলাম সেলিম : ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু আঘাত হানার দেড় মাস পরও ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না চট্টগ্রামের উপকূলীয় জনপদের বাসিন্দারা। বিধস্ত বেড়িবাঁধ উপচে নিয়মিত জোয়ারে প্লাবিত হচ্ছে দুর্গত এলাকা। বসতভিটা, ফসলের জমি, বাড়ির বাগান লোনা পানিতে প্লাবিত হচ্ছে।
জোয়ারের কারণে নতুন করে ঘর তোলা যাচ্ছে না। চাষাবাদও বন্ধ রয়েছে। লোনা পানির আগ্রাসনে মরে যাচ্ছে গাছপালা। হারিয়ে যাচ্ছে জীববৈচিত্র্য। ঘূর্ণিঝড়ে বিপর্যস্ত দুর্গত মানুষেরা এখন এক বৈরী পরিবেশের মুখোমুখি। এসব অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর যেন কেউ নেই। দুর্গত এলাকা জোয়ারের পানি থেকে রক্ষায় জরুরি ভিত্তিতে ভাঙা বেড়িবাঁধ মেরামতের কাজ শুরু হলেও তাতে নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।
গত ২১ মে ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু’র আঘাতে ল-ভ- হয়ে যায় চট্টগ্রামসহ দেশের বিস্তীর্ণ উপকূলীয় অঞ্চল। ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১২৭ কিলোমিটার গতিতে আঘাত হানে এ ঘূর্ণিঝড়। পূর্ণিমার ভরাকাটালে ভর করে আসা ঘূর্ণিঝড়ের তা-বের সাথে অন্তত ১০ ফুট জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হয় দেশের উপকূলীয় অঞ্চলসহ বিস্তীর্ণ এলাকা। ‘সিডর’ এবং ‘আইলার’ পর সাম্প্রতিককালে রোয়ানুই ছিল বড় ঘূর্ণিঝড়। ঘূর্ণিঝড়ের তা-বে চট্টগ্রামের বাঁশখালী, সীতাকু-, মহানগরীর ষোলশহর ও হালিশহরে ১২ জনের প্রাণহানী হয়।
জলোচ্ছ্বাসে চট্টগ্রাম-কক্সবাজারসহ উপকূলীয় জেলার বিস্তীর্ণ চর ও দ্বীপাঞ্চল জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যায়। বিলীন হয়ে যায় ক্ষেতের ফসল, খামারের মাছ ও বসতবাড়ি। সরকারি হিসাবে চট্টগ্রামে ৫ লাখের বেশি মানুষ এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চট্টগ্রামের বাঁশখালী, আনোয়ারা, সীতাকু-, মিরসরাই, সন্দ্বীপ এবং মহানগরীর বন্দর পতেঙ্গা হালিশহর এলাকায়ও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। রোয়ানুর প্রচ- আঘাতে ল-ভ- জনপদ এখনও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। বেড়িবাঁধ বিলীন হয়ে যাওয়ায় নিয়মিত জোয়ারের পানিতে ভাসছে এসব এলাকা। এর ফলে জোয়ার ভাটার সাথে লড়াই করতে গিয়ে বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি মেরামত করতে পারছে না দুর্গতরা। হতভাগ্য এসব উপকূলবাসী পায়নি পর্যাপ্ত সরকারি সাহায্য। বিধ্বস্ত ঘর পুননির্মাণ করতে পারেনি তারা। জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হওয়ায় টিকছে না ক্ষেতের ফসল।
সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাঁশখালী। এই উপজেলার তিনটি ইউনিয়ন রীতিমত বিরানভূমিতে পরিণত হয়। বাঁশখালীর উপকূল জুড়ে এখনও ধ্বংসের চিহ্ন। ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর জলোচ্ছ্বাসে ডুবে গিয়েছিল বাঁশখালীর খানখানাবাদসহ তিনটি ইউনিয়ন। পুকুরের চাষের মাছ ভেসে গেছে। লবণ পানিতে ভরে গেছে পুকুর। আবাদি জমির উর্বরা শক্তি নষ্ট হয়ে গেছে। নিষ্ফলা জমিতে থই থই করছে জোয়ারের পানি এখনো। উপড়ে পড়া গাছ এখনো সাক্ষী হয়ে আছে এখানে সেখানে। শূন্য ভিটি খাঁ খাঁ করছে। বিলীন হওয়া অংশে বসতির সাক্ষ্য দিচ্ছে নারকেল গাছ, খেজুর গাছ, ইট-পাথর। কেউ খুঁটি পুঁতলেও টিন লাগাতে পারেনি এখনো।
ভেঙে যাওয়া বেড়িবাঁধের ৫ কিলোমিটার অংশ দিয়ে প্রতিদিনই ঢুকছে সাগরের জোয়ারের পানি। ফলে উৎকণ্ঠায় দিন কাটে এখানকার ১৫ হাজার মানুষের। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ড অস্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণ শুরু করলেও তাতে নানা অনিয়মের অভিযোগ তুলেছেন স্থানীয়রা। এখনও ধ্বংসচিহ্ন বাঁশখালীর খানাখানাবাদ ইউনিয়নের প্রেমাশিয়া এলাকায়। সাগর আর সাঙ্গু নদীর মোহনায় এই জনপদের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত ঘর তৈরি করতে পারেননি এখনো। তাই ছোট ছোট ঝুপড়িতে দিন কাটছে তাদের। জলোচ্ছ্বাসে পাঁচ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ বিলীন হয়ে যাওয়ায় প্রতিনিয়ত জোয়ারের পানি ঢুকছে। ঘরের মধ্যেই মাচা বানিয়েছে অনেকে। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সেখানে নির্ঘুম রাত কাটছে তাদের।
এদিকে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় রিং বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু হলেও স্থানীয়দের অভিযোগ, এতে গাছের পরিবর্তে ব্যবহার করা হচ্ছে নিম্নমানের বাঁশ। ২ কোটি ৬৭ লাখ টাকা ব্যয়ে অস্থায়ী ভিত্তিতে নির্মিত হচ্ছে এই বাঁধ। তবে এতে অনিয়মের কথা অস্বীকার করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। আগামী নভেম্বর থেকে বাঁশখালীর উপকূলে প্রায় ১০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ স্থায়ীভাবে নির্মাণের কথা বলছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। যাতে ব্যয় হবে আড়াইশ’ কোটি টাকা। আনোয়ার দুটি ইউনিয়ন ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ভেঙে যায় বেড়িবাঁধ। সেই বাঁধ এখনও মেরামত না হওয়ায় জোয়ারে ভাসছে এসব এলাকা। মানুষের দুর্ভোগের শেষ নেই।
সরকারি হিসেবে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের আঘাতে চট্টগ্রাম মহানগরী ও জেলার উপকূলীয় এলাকার ১০৪টি ইউনিয়নের ৪ লাখ ৮৩ হাজার ৮৬ জন লোক কম-বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর মধ্যে সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৮১ হাজার ৪১১ জন মানুষ। আর আংশিক ক্ষতির শিকার হয় ৪ লাখ ১ হাজার ৬৭৫ জন মানুষ। চট্টগ্রামে রোয়ানুর আঘাতে মোট ১ লাখ ৩০ হাজার ৯৭টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর মধ্যে ১৯ হাজার ৪৩৭টি পরিবার সম্পূর্ণরূপে এবং ৮৩ হাজার ৬৬০টি পরিবার আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১৫৪ একর ফসল সম্পূর্ণ এবং ২ হাজার ৫৪১ একর ফসল আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
চট্টগ্রাম জেলায় ২০ হাজার ৮৯২টি বসতঘর সম্পূর্ণভাবে ও ২৫ হাজার ৭৬৬টি ঘর আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া ৩৪টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ১২টি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান আংশিক এবং ৪৭ কিলোমিটার রাস্তা সম্পূর্ণ এবং ১৪৪ একর সড়ক আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাশাপাশি ঘূর্ণিঝড়ে ২৭ কিলোমিটার উপকূলীয় বেড়িবাঁধ সম্পূর্ণ ও ৬৬ কিলোমিটার বাঁধ আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গবাদিপশুর মধ্যে ৮০টি গরু ও ৪০ হাজার ৫৫০টি হাঁস-মুরগি ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে ভেসে মারা গেছে। সরকারিভাবে ক্ষয়-ক্ষতির হিসাব দেয়া হলেও সে অনুযায়ী পর্যাপ্ত ত্রাণ সহযোগিতা পায়নি দুর্গতরা। নিহতদের পরিবারকে তাৎক্ষণিক কিছু আর্থিক সাহায্য দেয়া হলে দুর্গতদের পুনর্বাসনে উদ্যোগ নেয়া হয়নি। স্থানীয়রা বলছেন, আমরা ত্রাণ চাই না বেড়িবাঁধ চাই।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন