বিশেষ সংবাদদাতা : দেশের বিদ্যুৎকেন্দ্র, জ্বালানি তেলের ডিপো ও গ্যাস কূপগুলোতে জঙ্গি হামলার আশঙ্কা করা হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ভবনসহ বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের মতো অগ্রসরমান খাতের প্রকল্পগুলোর নিরাপত্তা নিয়ে এ খাতে বিনিয়োগকারী দেশী-বিদেশী সংস্থা, ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে এই শঙ্কা প্রকাশ করা হয়। এরই আলোকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের কাছে বাড়তি নিরাপত্তা চেয়ে চিঠি দিয়েছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ।
জানা যায়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দেশের সকল বিদ্যুৎকেন্দ্র, তেল শোধনাগার, জ্বালানি তেলের ডিপো ও গ্যাস কূপগুলোর নিরাপত্তা জোরদার করার নির্দেশ দিয়েছে। এমনিতেই সন্ত্রাসী হামলার আশঙ্কায় এসব গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় সার্বক্ষণিক আনসার ও পুলিশ মোতায়েন থাকতো। এবার জঙ্গি হামলাকে কেন্দ্র করে এই নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও বাড়ানো হয়েছে। এই নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে রেড এলার্ট বলা যাবে কী না? এমন প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, এটা রেড এলার্ট নয়; সতর্কতামূলক ব্যবস্থা আরও জোরদার বলা যেতে পারে।
এ ব্যাপারে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, দেশের বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো অতিগুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা হিসাবে চিহ্নিত। তাছাড়া এসব কেন্দ্র যেহেতু সন্ত্রাসী ও জঙ্গিদের টার্গেট-সেহেতু এর নিরাপত্তার দিকটি বিবেচনায় নিয়ে এর জন্য বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী গঠন প্রয়োজন। প্রয়োজনে বিদেশী নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির জন্য বিশেষ স্থাপনা নির্ধারণ বা কি পয়েন্ট ইন্সটলেশন (কেপিআই) নির্ধারণ করা হবে।
গুলশানের আর্টিসানে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার পর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজ উদ্যোগে ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা, আর্চওয়ে গেট স্থাপন, মেটাল ডিটেক্টর, অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র সংরক্ষণসহ যাবতীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারের নির্দেশনাও দেয়া হয়। এই নির্দেশনা মোতাবেক বাংলাদেশ বিদ্যুতায়ন বোর্ড (পিডিবি) ও বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (বিআরইবি) তাদের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোতে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশনা পাঠায়।
ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনার পর দেশের বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে এরই মধ্যে পুলিশি প্রহরা বাড়ানো এবং সতর্কতা জারির খবর পাওয়া গেছে। জানা গেছে, নির্দেশনা জারির পর থেকে চট্টগ্রামের ছয় সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও নিরাপত্তারক্ষীদের সব ধরনের ছুটি বাতিল করেছে কর্তৃপক্ষ। সংবেদনশীল স্থাপনা হিসেবে কেন্দ্রগুলোয় এমনিতেই নিরাপত্তা জোরদার থাকলেও গুলশান হামলার পর থেকে সতর্কতা জারি করা হয়েছে সেখানে। জঙ্গি হামলার আশঙ্কায় কেন্দ্রগুলোয় নিয়োজিত সেনাবাহিনী, আনসার ব্যাটালিয়ন ও কেন্দ্রের নিজস্ব নিরাপত্তারক্ষীদের সার্বক্ষণিক সতর্ক থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
নিরাপত্তা জোরদারের বিষয়টি নিশ্চিত করে পিডিবি চট্টগ্রাম দক্ষিণ অঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী নিখিল চন্দ্র চৌধুরী বলেন, এমনিতেই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো কেপিআই স্থাপনা। তাই স্বাভাবিক সময়েও বিদ্যুৎকেন্দ্রে নিরাপত্তা বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখা হয়। তবে দেশের বিভিন্ন জায়গায় সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী হামলার পর কেন্দ্রগুলোয় নিñিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এ নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয় সতর্ক অবস্থা জারি করা হয়েছে। এমনকি পরবর্তী নির্দেশনা না দেয়া পর্যন্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সব ধরনের ছুটি বাতিল করা হয়েছে।
বাড়তি নিরাপত্তা বলয় তৈরি করা হয়েছে সিদ্ধিরগঞ্জ বিদ্যুৎকেন্দ্রেও। এখানে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ফটকের সামনে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভেতরের কোয়ার্টারে বসবাসকারী এবং তাদের আত্মীয়-স্বজনদের দেহ তল্লাশি এবং নাম-ঠিকানা লিপিবদ্ধ করে ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে। ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রে আনসারের পরিবর্তে এখন একজন উপপরিদর্শকের নেতৃত্বে ১০ জন পুলিশ সদস্য মোতায়েন রয়েছেন।
একইভাবে দেশের সকল গ্যাস কূপ, জা¡লানি তেল শোধনাগার, পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা তেলের ডিপো, বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি, চুনা পাথর, হার্ড রকসহ সব ধরনের খনির নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে নসরুল হামিদ আরও জানান, গুরুত্বপূর্ণ এসব স্থাপনার নিরাপত্তার বিষয়টি এখন সবচেয়ে বড়। আমাদের এখানে যেসব বিদেশী বা কেপিআইয়ের অধীন প্রকল্প এবং স্থাপনা রয়েছে, তার নিরাপত্তা আরো সুসংহত করা ও পেশাদারিত্বের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। দেশের সব বিদ্যুৎ প্লান্ট ও স্থাপনাকে বিশেষ ব্যবস্থায় নিরাপত্তা দিয়ে একটি নীতি তৈরি করা হচ্ছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নিরাপত্তার বিষয়টি বিশেষ ফোর্সের অধীনে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি প্রস্তাব পাঠানো হবে।
তিনি আরো বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ‘সেন্ট্রাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল সিকিউরিটি ফোর্স’ নামে আলাদা নিরাপত্তা বাহিনী আছে, যারা প্রতিষ্ঠান, সরকারি ভবন, পাওয়ার প্লান্ট, রিফাইনারি, নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট ও এয়ারপোর্টসহ বিশেষ স্থাপনাগুলোয় নিরাপত্তা দিয়ে থাকে। আমরা বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগ থেকে এমন একটি প্রস্তাবনাই প্রস্তুত করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। দেশে বর্তমানে যে ধরনের অবস্থা বিরাজ করছে, তাতে প্রতিটি বিভাগের আলাদা নিরাপত্তা মানদ- তৈরি করতে হবে। কয়েক বছর ধরে দেশের বিভিন্ন স্থানে সন্ত্রাসী হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে দেশের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো। গত দুই বছরে হামলা হয়েছে হবিগঞ্জ, বগুড়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজবাড়ী, সিদ্ধিরগঞ্জ, সাতক্ষীরাসহ বেশ কয়েকটি স্থানের বিদ্যুৎকেন্দ্রে। সর্বশেষ চলতি বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের শিকলবাহ বিদ্যুকেন্দ্রে সন্ত্রাসী হামলায় পাঁচ প্রকৌশলী আহত হয়েছেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন