তারেক সালমান : সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীর গুলশানে স্প্যানিশ আর্টিজান রেস্টুরেন্ট ও কিশোরগঞ্জ জেলার শোলাকিয়া ঈদগাহে নজিরবিহীন ভয়াবহ জঙ্গি সন্ত্রাসী হামলার পর দেশে জাতীয় ঐক্য নিয়ে ব্যাপক আলোচনা উঠেছে। বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার পক্ষ থেকে এসব জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু ও ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ বিপর্যয় এড়াতে যেকোনো মূল্যে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার দাবি জোরালো হয়েছে। কিন্তু বিরোধী মহল থেকে এ ব্যাপারে প্রচ- আগ্রহ দেখানো হলেও সরকারি দল থেকে এখনও দৃশ্যত কোনো সাড়া দেয়ার লক্ষণ দেখা যায়নি। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটে দেশের অন্যতম বিতর্কিত রাজনৈতিক দল জামায়াতের অন্তর্ভুক্তিই এ ক্ষেত্রে প্রধান বাধা বলে ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে। অন্যদিকে, বিএনপির জাতীয় ঐক্যর ডাকে সরকার কোনো মূল্য দিচ্ছে না বলেও অভিযোগ করছে দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। দেশীয় রাজনীতির এমন পাল্টাপাল্টি অবস্থানের পর বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের রাজনীতি এবং জঙ্গি ইস্যুতেই যুক্তরাজ্যের হাউস অব লর্ডসে বাংলাদেশ নিয়ে আয়োজিত এক সেমিনারে অংশ নিতে লন্ডন গেল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও প্রধান বিরোধী দল বিএনপির উচ্চ পর্যায়ের পৃথক দুটি প্রতিনিধিদল। দল দুটির সূত্রে জানা গেছে, এরই মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচটি ইমাম ও বিএনপির পক্ষে নেতৃত্বে আছেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ১৯ জুলাই অনুষ্ঠিতব্য এ সেমিনারে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি, জঙ্গি ও সন্ত্রাসী হামলাসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনায় অংশ নেবেন। আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা গেছে, যুক্তরাজ্যের হাউজ অব কমন্সের সেমিনারে অংশ নিতে আওয়ামী লীগ প্রতিনিধিদলের অন্য সদস্যরা হলেন প্রধানমন্ত্রীর আরেক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান, ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ-বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ এবং আওয়ামী নেতা দীপকংর তালুকদার। অন্যদিকে বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, বিএনপির প্রতিনিধিদলের অপর সদস্যরা হলেন দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সাবিহ উদ্দীন আহমেদ, কেন্দ্রীয় নেতা নিতাই রায় চৌধুরী ও ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা গেছে, জঙ্গি-সন্ত্রাসবাদ ইস্যু সরকার নিজস্ব কৌশলেই মোকাবেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পাশাপাশি এ ইস্যুতে প্রয়োজনে তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অন্য শক্তিগুলোর সঙ্গে ঐক্য বা আলোচনা করতে রাজি আছে, কিন্তু বিএনপির সঙ্গে নয়।
অপর একটি সূত্রে জানা যায়, জঙ্গিবাদ ইস্যুতে সরকার ও বিএনপির মধ্যে ঐক্য হতে পারে। তবে তা শর্ত সাপেক্ষে। বিএনপিকে জামায়াতের সঙ্গ ছাড়তেই হবে। একই সঙ্গে বিগত দিনগুলোতে আন্দোলনের নামে দলটির সহিংস কর্মকা-ের জন্যে জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে হবে।
গত বুধবার ও বৃহস্পতিবার জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নিজ দলের নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট ও নানা পেশাজীবী নেতৃবৃন্দের সঙ্গে মতবিনিময় করেন দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। দু’দিনের বৈঠক সূত্রে জানা যায়, জাতির বৃহত্তর স্বার্থে খালেদা জিয়া জাতীয় ঐক্য চান। সেখানে কে কী পেল তা বড় কথা নয়। সূত্র আরও জানায়, জাতীয় ঐক্যর প্রশ্নে ক্ষমতাসীন দল ও জোটের সঙ্গে বিএনপি এবং বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের ঐক্য প্রচেষ্টায় জামায়াতে ইসলামীই বড় ‘দেয়াল’ বলে বৈঠকের দু’দিনের বক্তব্য উঠে এসেছে। সে ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থে ঐক্য প্রচেষ্টায় অদূর ভবিষ্যতে বিএনপি তার জোট থেকে জামায়াতকে ছেড়ে দিতে পারে বলেও গুঞ্জন চলছে।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অভিযোগ করেছেন, গুলশানে ক্যাফেতে বিদেশিদের হত্যাসহ সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলার পর পরিস্থিতি মোকাবেলায় খালেদা জিয়ার আহ্বানে সাড়া না দিয়ে সরকার দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিচ্ছে।
ফখরুল বলেন, ‘১৪ দলের নেতৃবৃন্দ ও আওয়ামী লীগের কিছু ঊর্ধ্বতন নেতা দেশনেত্রীর জাতীয় ঐক্যের আহ্বানকে উপেক্ষা করে প্রকৃতপক্ষে জাতির আশা-আকাক্ষাকে উপেক্ষা করেছেন এবং দলীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠতে না পেরে তারা দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি অভিযোগ করেন, জাতির যে মুহূর্তে ঐক্যবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন ভয়াবহ সঙ্কট থেকে উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য, সেই মুহূর্তে তারা জাতিকে বিভক্ত করতে চাইছে এবং জাতিকে বিভক্তির মধ্যে ফেলতে চাইছে।
এদিকে, গতকাল শনিবার বিকালে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব পেলে সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় বিএনপি চেয়ারপারসন যে জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছেন, সে বিষয়ে গণফোরাম আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে বলে জানিয়েছেন দলটির সভাপতি ড. কামাল হোসেন।
গণফোরাম সভাপতি কামাল হোসেন বলেন, তারা (বিএনপি) যদি আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের চিঠি দিয়ে জানায় তাহলে সেটি দলীয় ফোরামে আলোচনা করে আমরা সিদ্ধান্ত নেব। তিনিও গুলশানের মতো সন্ত্রাসী হামলা থেকে বাঁচার জন্য জাতীয় ঐক্যের ডাক দিনে বলেন, আমরা শুধু রাজনৈতিক দল নয়, ইতিবাচকভাবে বলছি, সকল জনগণের ঐক্য চাইÑ১৬ কোটি, ১৭ কোটি যাই হোক।
জামায়াতে ইসলামী গণফোরামের জাতীয় ঐক্যের ডাকে সাড়া দিলে তাদের গ্রহণ করবেন কি না জানতে চাইলে ড. কামাল হোসেন বলেন, যেসব রাজনৈতিক দল সংবিধানের মূল চার নীতি বিশ্বাস করে, তারা এগিয়ে আসলে আমরা স্বাগত জানাব।
অপরদিকে, দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জাতীয় ঐক্যের আহ্বানের বিষয়ে জামায়াত প্রশ্নে সরকারী দলের বিরোধীতার বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, মুক্তিযুদ্ধকে স্বীকার করে জামায়াতে ইসলামী জাতির কাছে ক্ষমা চাইলে জামায়াতকে নিয়ে জাতীয় ঐক্য গড়ার ক্ষেত্রে আপত্তির কিছু থাকবে না। অথবা জাতির বৃহত্তর স্বার্থে জামায়াত একপাশে সরে দাঁড়াতেও পারে।
তিনি বলেন, একটা প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়, যতক্ষণ ২০ দলে জামায়াত থাকবে ততক্ষণ কোনো কোনো মহল থেকে বাধা আসতে পারে। কিন্তু তিনি মনে করেন, জামায়াতের অধিকাংশ নেতাকর্মীর জন্ম ’৭১-এর পরে। তারা এ মাটিরই সন্তান। তারা যদি জাতির কাছে ক্ষমা চায় যে, তাদের ‘মুরব্বিদের’ ভুল হয়েছিল, তারা যদি মুক্তিযুদ্ধকে স্বীকার করে নেয় তাহলে আপত্তির কিছু থাকে না। অথবা জাতীয় স্বার্থে প্রয়োজন হলে জামায়াত চুপচাপ বসে থাকতে পারে। তারা এক পাশে সরে দাঁড়াতে পারে।
খালেদা জিয়ার আহ্বানকে স্বাগত জানিয়ে এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, জাতীয় ঐক্য গড়ার উদ্যোগ প্রধানমন্ত্রীর নেয়া উচিত ছিল। কিন্তু তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। তাই ক্ষমতা থেকে তাঁর সরে দাঁড়ানো উচিত। তিনি এটিকে বিএনপির জন্য ‘মস্ত বড়’ সুযোগ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
অন্যদিকে, জাতীয় ঐক্যর প্রশ্নে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারকদের মতে, জঙ্গি ইস্যুতে বিএনপি চেয়ারপারাসন খালেদা জিয়া যতবার কথা বলেছেন, প্রত্যেকবারই তিনি জঙ্গি মোকাবিলার পরামর্শ না দিয়ে দাবি করেছেন নির্বাচনের। এর অর্থ কী? এ প্রশ্নও তুলেছেন ক্ষমতাসীন দলের অনেকেই। তারা বলেন, নির্বাচনেই তিনি সমাধানের পথ দেখছেন! খালেদা জিয়ার এসব বক্তব্য থেকে প্রমাণ মেলে জঙ্গিবাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা বিএনপিই।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেন, কার সঙ্গে ঐক্য? যারা জঙ্গি-সন্ত্রাসবাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা, তাদের সঙ্গে? তিনি অভিযোগ করেন, আজকের এ পরিস্থিতির জন্যে বিএনপি-জামায়াত ও তাদের দেশি-বিদেশি দোসররা দায়ী। আর সেই জঙ্গি ইস্যু মোকাবেলার জন্য সরকারকে, আওয়ামী লীগকে বিএনপির পরামর্শ নিতে হবে! এটা একটি হাস্যকর প্রস্তাব। তিনি বলেন, বিএনপি চরিত্র না পাল্টালে জাতি তাদের ক্ষমা করবে না, তাদের কোন কৌশলই কাজে আসবে না।
সভাপতিম-লীর আরেক সদস্য কাজী জাফরউল্যাহ বলেন, চলমান পরিস্থিতিতে বিএনপি যদি সত্যিকার কোনো ভূমিকা রাখতে চায়, আগে তারা ঘোষণা দিক যে তারা মানবতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধী জামায়াতের সঙ্গ ছেড়ে দিয়েছে। তারপর বিএনপিকে ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পর তাদের সব কৃতকর্মের জন্য জাতির কাছে ক্ষমতা চাইতে হবে। তবেই বোঝা যাবে জঙ্গি মোকাবেলায় বিএনপির মানসিকতা সত্যিই পজিটিভ।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব-উল আলম হানিফ বলেন, জঙ্গি-সন্ত্রাসবাদ ইস্যুতে ঐক্যের আহ্বান জানিয়ে বিএনপি জাতির সঙ্গে আবারও তামাশা করছে। জঙ্গিদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে জঙ্গি-সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার প্রস্তাব জাতির সঙ্গে তামাশা।
হানিফ বলেন, বিএনপির আগে বলা উচিত ছিল, আমরা জামায়াতকে ছেড়ে দিয়েছি, অতীত কর্মকা-ের জন্য জাতির কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। আমরা আবার নতুন করে রাজনীতি শুরু করতে চাই। তাহলে তাদের ঐক্যের আহ্বান যুক্তিসঙ্গত হতো।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন