ইনকিলাব ডেস্ক : তুরস্কের সামরিক অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা নিয়ে আলোচনা করতে সিএনএনের লাইভ প্রোগ্রামে এসেছিলেন সাবেক সিআইএ গোয়েন্দারা। তাদের আলোচনায় প্রাধান্য পেয়েছে অভ্যুত্থানের কৌশল। আলোচনায় তখন পর্যন্ত চলমান অভিযানের ব্যর্থতাগুলোকে এমনভাবে চিহ্নিত করা হচ্ছিল, যেন মনে হচ্ছিল এই ব্যর্থতায় তারা মর্মাহত।
দেশে দেশে সামরিক অভ্যুত্থানে মদদ দেওয়ার এক প্রমাণসাপেক্ষ ইতিহাস রয়েছে এই মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার। শুক্রবার মার্কিন টিভি চ্যানেল সিএনএনে হাজির হওয়া গোয়েন্দাদের আলোচনার ধরন দেখে মনে হচ্ছিল, তারা যেন সংস্থার ভূমিকার ধারাবাহিকতা রক্ষা করছেন অবসরে এসেও। যেন সহায়তা দিচ্ছেন একটি সামরিক অভ্যুত্থান সফল করতে। তুরস্কের অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা ইস্যুতে সাবেক সিআইএ কর্মকর্তাদের অবস্থান ও আলোচনার পদ্ধতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম হাফিংটন পোস্ট।
প্রতিবেদনে বলা হয়, শুক্রবার রাতে অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা নিয়ে আলোচনা করতে যেসব সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা সিএনএনে হাজির হয়েছিলেন তারা এ প্রচেষ্টাকে কৌশলগত ভুল হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কীভাবে কাজ করলে অভ্যুত্থান সফল করা যেত তারই পরামর্শ দিয়েছেন অনেকে। এদের মধ্যে অন্তত একজনকে অভ্যুত্থান প্রচেষ্টাকারীদের ব্যর্থতা নিয়ে হতাশ বলে মনে হয়েছে। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাতের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় স্বস্তি পাওয়ার বদলে তাকে নিরাশ হতে দেখা গেছে।
সিএনএনে আসা সাবেক সিআইএ কর্মকর্তাদের একজন রবার্ট বায়ের। তিনি একজন লেখকও। একসময় অভ্যুত্থানে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। সিএনএনের উপস্থাপক অ্যাংকর অ্যান্ডারসন কুপারকে রবার্ট বায়ের বলেন, ‘তুর্কি অভ্যুত্থানের এ প্রচেষ্টা পেশাদারিত্বের সঙ্গে করা হয়নি।’
নিজেও আগে বিভিন্ন অভ্যুত্থানে জড়িত ছিলেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তাদের উচিত ছিল সিএনএন তুর্কির দখল নেওয়ার প্রথম কয়েক মিনিটের মধ্যেই রেডিও স্টেশন, সোশ্যাল মিডিয়া ও ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তায়িব এরদোয়ানকে বন্দি না করলেও তাদের উচিত ছিল শুরুতেই তার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার।’
বায়ের
বায়ের জানান, গত কয়েক মাসে তুরস্কে একটি অভ্যুত্থানের সম্ভাবনা নিয়ে দেশটির সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে তার আলোচনা হয়েছিল। তিনি বলেন, ‘কয়েক মাস আগে থেকে তুর্কি কর্মকর্তাদেরকে আমি এ ধরনের একটি আশঙ্কার কথা জানাচ্ছিলাম। কিন্তু তারা তা নাকচ করে দিয়েছিল।’
তার মতে, আপাতদৃষ্টিতে অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা সফল না হলেও পরবর্তীতে তা আরও প্রবল হয়ে উঠতে পারে। কেননা, তুরস্কের সেনাবাহিনী কিংবা সরকারের ভেতরকার লোকজনের সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না।
উলসে
সিআইএ’র সাবেক পরিচালক জেমস উলসে সিএনএনকে তুরস্কের অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা সম্পর্কে বলেন, ‘এটি কৌশলগত ব্যর্থতা ছিল। অভ্যুত্থানের ক্ষেত্রে কখনও প্রথম অংশের পরিকল্পনা অনুযায়ী গোটা অভিযান পরিচালনা করা যায় না। বিভিন্ন ধাপে কৌশল পাল্টানোর মতো পরিকল্পনা থাকতে হয়। কিন্তু তুরস্কের অভ্যুত্থান প্রচেষ্টাকারীদের তেমন পরিকল্পনা ছিল বলে মনে হয় না।’
গত বছর তুরস্কে গিয়ে ছয় মাস থেকেছিলেন উলসে। তার দৃষ্টিতে তুরস্ক একটি সমৃদ্ধ ও প্রগতিশীল জায়গা। পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা থাকলেও দেশটির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক অক্ষুণœ রাখার পক্ষেই মত তার।
ওয়েসলি
অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা জেনারেল ওয়েসলি ক্লার্কও অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার সমালোচনা করেছেন। তবে এ ব্যাপারে খুব সতর্কভাবেই মন্তব্য করেছেন তিনি। বারবার বোঝাতে চেয়েছেন, তিনি সামরিক অভ্যুত্থানের পক্ষে নন। ওয়েসলি বলেন, ‘এ অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে যা হয়েছে তা আমরা উৎসাহিত কিংবা নিরুৎসাহিত কোনোটিই করছি না। কিন্তু ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, এ ধরনের অভ্যুত্থান প্রচেষ্টায় বুঝে-শুনে নামতে হয়।’
তুর্কি অভ্যুত্থানের ক্ষেত্রে সাবেক সিআইয়ের কর্মকর্তাদের মন্তব্য খুব উল্লেখযোগ্য। কারণ যেসব দেশে যুক্তরাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক স্বার্থ জড়িত সেগুলোতে অভ্যুত্থানে সিআইএ’র সংশ্লিষ্টতার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। বিশেষ করে স্নায়ুযুদ্ধের ক্ষেত্রে এ কথাটি সত্যি বলে প্রমাণিত হয়েছে। সে সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি সহানুভূতিপ্রবণ বেশ কয়েকটি দেশের সরকারকে উৎখাত করেছিল যুক্তরাষ্ট্র।
অবশ্য তুরস্কের অভ্যুত্থান প্রচেষ্টাকারীদের পক্ষে সিআইএ’র কর্মকর্তাদের অবস্থান স্পষ্ট বলে মনে হলেও ওবামা প্রশাসন অবশ্য তুরস্কের নির্বাচিত সরকারের প্রতিই সমর্থন জানিয়েছে।
উল্লেখ্য, শুক্রবার (১৫ জুলাই) রাতে ক্ষমতা দখলের ঘোষণা দিয়ে তুরস্কের ডানপন্থী সরকার উচ্ছেদের দাবি করে দেশটির সেনাবাহিনীর একাংশ। রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে প্রচারিত এক বিবৃতিতে তারা জানায়, ‘গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও মানবাধিকার রক্ষার স্বার্থে’ সশস্ত্র বাহিনী তুরস্কের ক্ষমতা দখল করেছে। টেলিভিশনের পর্দায় পড়ে শোনানো ওই বিবৃতিতে বলা হয়, এখন ‘শান্তি পরিষদ’ দেশ চালাবে এবং কারফিউ ও সামরিক আইন জারি থাকবে। একই সঙ্গে তুরস্কের বিদ্যমান বৈদেশিক সব সম্পর্ক বহাল থাকবে এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা প্রাধান্য পাবে। কারফিউর বিরোধিতা করে এরদোগানের সমর্থকরা রাস্তায় নেমে এলে সংঘর্ষ শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত সামরিক বাহিনীর সব অংশের সমর্থন না থাকায় এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের তৎপরতায় বিদ্রোহী সেনাদের উদ্যোগ ভেস্তে যায়। সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী এ পর্যন্ত ২৬৫ জন নিহত হয়েছে। এর মধ্যে অভ্যুত্থানের চেষ্টাকারী ১০৪ জন। বাকিরা পুলিশ ও বেসামরিক লোকজন। তুর্কি প্রধানমন্ত্রী বিনালি ইলদিরিম জানিয়েছেন, অভ্যুত্থান চেষ্টাকারীরা বাদে নিহতের সংখ্যা ১৬১ জন। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত তিন হাজারেরও বেশি বিদ্রোহীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সূত্র : হাফিংটন পোস্ট
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন